–মা তো সবতাতেই চটেন। মা’র কথা বাদ দাও…মা সম্বন্ধে এই নির্ভীক মন্তব্যটি উচ্চারণ করিয়া অমিতাভ নিতান্ত বিচক্ষণের মত বলে–আমি শুধু বলছি, দিদি এই বুদ্ধি নিয়ে গাড়ী চালালে প্রত্যেক দিনই তো অ্যাসিডেন্ট ঘটাবে!
–কেন রে শুনি? মেয়েদের গাড়ী চালাতে দেখিসনি কখনো? রোজ অ্যাসিডেন্ট করে তারা? তাপসী এবার নিজেই হাল ধরে।
–তারা তোর মত হাঁদা মেয়ে নয়। তোর পক্ষে ওই পিড়িং পিড়িং সেতার বাজানো, আর ‘চিঁ চিঁ’ করে গান শেখাই ভালো।
মণীন্দ্র সকৌতুক হাস্যে ছেলেমেয়েদের এই বাগবিতণ্ডা উপভোগ করিতেছিলেন। এবার হাসিয়া বলেন–ওঃ, তাহলে অভীবাবুর মতে গান-বাজনা শেখা হাঁদাদের উপযুক্ত কাজ! আমার তো তা ধারণা ছিল না!
অভী বেকায়দায় পড়িয়া ঈষৎ অপ্রতিভভাবে বলে–তা কেন? দিদির মত মেয়ে আর কি করবে
–সবই করবে। মণীন্দ্র সস্নেহ গাম্ভীর্যে বলেন–ইচ্ছে করলে চেষ্টা থাকলে সবাই সব করতে পারে, বুঝলে অভী? মেয়ে ছেলে বলে তফাৎ করবার কিছু নেই। হয়তো এমন হতে পারে বেবি তোমার চাইতে ভালো ড্রাইভিং শিখবে!
অমিতাভ একটা অবিশ্বাসের হাসি হাসিয়া দিদির দিকে দৃষ্টিপাত করে। অর্থাৎ ওই আনন্দেই থাকো ‘!
মণীন্দ্র মেয়ের দিকে তাকাইয়া বলেন–কিন্তু সপ্তাহে তো ওই একবেলা মাত্র ছুটি তোমার, সেটুকুও খরচ করে ফেলতে চাইছ?
বেবি সোৎসাহে বলে–ও তো ছুটির মতই মজা, ছুটির চেয়েও ভালো। মাকে বলে-টলে ঠিক করে দাও না বাবা!
–হ্যাঁ, ওই একটা দিক আছে বটে। দেখি তিনি কি বলেন!
অমিতাভ নিশ্চিন্ত স্বরে বলে–কি আবার বলবেন, মা তো ওই চান, খালি ফ্যাশন শিখুক মেয়েটি। হ্যাঁ, যদি আমি বলতাম–তাহলে ঠিক বলতেন—’এখন তোমার লেখাপড়ার সময়, এখন ওসব থাক।’–নিজের কণ্ঠস্বরে মায়ের কণ্ঠস্বরের গাম্ভীর্য নকল করিয়া হাসিয়া ওঠে।
-কিন্তু শেখাচ্ছে কে? অক্ষয়? রাজী হবে তো? মানে সময় হবে তার?
বেবি আগ্রহ-চঞ্চল স্বরে বলিয়া ওঠে–খুব খুব। অক্ষয়কে তো বলে-টলে ঠিক করে রেখেছি। শুধু মা’র মত হলেই
মাঝপথে কথা থামিয়া যায় স্বয়ং মাতৃদেবীর আবির্ভাবে। কথা থামাইয়া বাবার চেয়ারটার সঙ্গে আর একটু ঘনিষ্ঠ হইয়া দাঁড়ায় তাপসী, ভীত-চঞ্চল দৃষ্টি মেলিয়া।
–কি? কিসের পরামর্শ হচ্ছে তোমাদের?
–বিশেষ কিছু না। মণীন্দ্র নিতান্ত লঘুভাবে বলেন–বেবির শখ হয়েছে গাড়ী চালাতে শিখবে, তাই–
চিত্রলেখা শ্লেষ-মিশ্রিত একটু হাসির সঙ্গে বলেন–তবু ভালল! তোমার মেয়ের শখ বলে জিনিসটা আছে তাহলে! আমি তো জানি সবই আমার শখে করতে হয়!..শেখাচ্ছে কে? তুমি নাকি?
–আমি? তবেই হয়েছে। অক্ষয় আমার অভ্যাস খারাপ করে দিয়েছে। ওই অক্ষয়ই শেখাবে। অবশ্য অভীর মতে–
–থাক থাক, বালক-বৃদ্ধ সকলের মতামত শোনবার সময় আমার নেই। আমি বলতে এসেছিলাম–
কথার মাঝখানে একঝলক কাল-বৈশাখী ঝড়ের মত ছুটিয়া আসে সিদ্ধার্থ–দাদা, দিদি, তোমরা এখানে? ওদিকে দেখগে যাও কি মজা হচ্ছে! অক্ষয় একটা পাখী ধরেছে–একদম সবুজ। কি সুন্দর লাল লাল পা! একটা ঝুড়ি চাপা দিয়ে রেখে এখন কঞ্চি দিয়ে খাঁচা বানাচ্ছে। আমি ধরছিলাম–তোমরা দেখতে পাবে না বলে একবারটি শুধু–আসবে তো এসো!
অমিতাভ অবশ্য ‘একদম সবুজ’ পর্যন্তও দাঁড়াইয়া শুনিবার অপেক্ষা রাখে নাই। সংবাদদাতার সংবাদ-দানকার্য সম্পন্ন হওয়ার আগেই ঘটনাস্থল-উদ্দেশে দৌড়াইয়াছে। বেবিও নিজেকে সামলাইতে পারে নাই। সিদ্ধার্থর সঙ্গে সঙ্গে সেও প্রায় ছুটিয়া বাহির হইয়া যায়।
অক্ষয় ওদের অনেক দিনের লোক। অধস্তন ব্যক্তিদের সঙ্গে মেলামেশা করা চিত্রলেখার অত্যন্ত অপছন্দকর হইলেও অক্ষয় সম্বন্ধে ছেলেমেয়েদের ঠিক আঁটিয়া উঠিতে পারে না–”অক্ষয়টি হচ্ছে এদের দুষ্টু বুদ্ধির যোগানদার”–এর বেশী আর কিছু বলা হয় না। স্বামীর ঘরে আসিয়া পর্যন্ত অক্ষয়কে দেখিতেছে সে। স্বামীরও পুরনো লোক বলিয়া কেমন যে একটা সমীহ ভাব, দেখিলে হাসিও পায়, গাও জ্বালা করে। গ্রাম্য মনোভাব আর কি!
চিত্রলেখার ভাগ্যের সবদিকেই যেন কাঁটা ঘেরা। পাগড়ীধারী ছ’ফুট পাঞ্জাবী ড্রাইভার সম্বলিত গাড়ীর চেহারা কেমন আভিজাত্যপূর্ণ!…সে জায়গায় আধময়লা ছিটের শার্ট পরা বেঁটে খাটো অক্ষয়!
ছি!
স্ত্রীর মুখের উপরকার নানা বর্ণের খেলা বোধ করি মণীন্দ্রর চোখে পড়ে না। হালকা সুরে বলেন-বেবি ভাবনায় পড়েছে তোমার পাছে আপত্তি হয়। আপত্তির আর কি আছে, এ্যা! ছেলেমানুষের শখ–ক’দিন আর টিকবে?
মেয়ের হইয়া ওকালতির প্রয়োজন খুব বেশী ছিল না অবশ্য। চিত্রলেখার আপত্তি হইবার কথা নয়। তবে প্রস্তাবটা অপরপক্ষ হইতে আসায় বেশী উৎসাহ প্রকাশ করা যায় না এই যা। নিজে যে বিশেষ কিছুই শিখিতে পায় নাই, এই একটা দারুণ ক্ষোভ মাঝে মাঝে নিজের সন্তানদের উপরও কেমন যেন ঈর্ষান্বিত করিয়া তোলে।
বেবি ছুটিয়া বাহির হইয়া যাইবার পর অন্য একটা কথার ছুতা ধরিয়া স্বামীর সঙ্গে কথা কাটাকাটি করিয়া উঠিয়া যায় এবং মেয়ের এই শখের প্রস্তাবের স্বপক্ষেই বা কতটুকু রায় দেওয়া যায় এবং বিপক্ষেই বা কি কি যুক্তি দেখানো চলে, মনে মনে তাহার হিসাব করিতে থাকে।
স্বামীর সংসারে আসিয়া পর্যন্ত ক্রমাগত লড়াই করিতে করিতে স্বভাবটাই কেমন যেন ‘রণং দেহি’ গোছের হইয়া গিয়াছে তাহার। বুড়ী এক শাশুড়ী, আর কুসংস্কারাচ্ছন্ন স্বামীর হাতে পড়িয়া জীবনটাই মিথ্যা হইয়া গেল!