–দেখ, মা’র হয়ে ওকালতি করতে চাইছি না আমি, কিন্তু ভেবে দেখ, বেবির মনের ওপর যদি এর কোন প্রভাব পড়ে থাকে–
–তোমার কথা শুনলে আমার সুইসাইড করতে ইচ্ছে করে। ওইটুকু একটা বাচ্ছা– দুধের শিশু বললেও হয়, দুনিয়ার কিছুই যে জানে না–তার বিষয়ে এসব কথা ভাবো কি করে তাই আশ্চর্য! ওর আবার মন, তার ওপর আবার প্রভাব! একটা চকোলেটের ভাগ নিয়ে অভীর সঙ্গে বাবলুর সঙ্গে খুনসুড়ি করে
–তা করুক। শুনতে পাই–পৃথিবীতে আমার শুভ জন্মদিনে আমার মা সারাদিন নাকি কেঁদেছিলেন একটি মাটির পুতুলের বিয়োগ-ব্যথায়।
–থাক থাক, প্রত্যেক বিষয়ে তোমার মা’র উদাহরণ শোনবার শখ আমার নেই। ওঁদের আমলের মত অকালপক্ক ছেলেমেয়ে এখনকার নয়। নিশ্চয় জেনো, সেই বাজে ব্যাপারটা বেবি মোটেই মনে করে নেই। এবং যাতে আর কখনো মনে না পড়ে তার ব্যবস্থা করতে হবে আমাকে।–যাক সে কথা, বেবির জন্যে যে টিউটরের কথা বলেছিলাম তার কি করছ? ম্যাথমেটিকসে কি যাচ্ছেতাই কাঁচা ও তার খেয়াল রাখ?
–খেয়াল! আমি আর কি রাখব? তুমিই তো কিন্তু কি যেন নাম ভদ্রলোকের হিমাংশু বুঝি, তা তিনি কি আর পড়াবেন না?
–আঃ, তোমার সঙ্গে কথা কওয়া একটা বিরক্তিকর ব্যাপার! সেদিন অত কথা বললাম, সব ভুলে গেছ! হিমাংশুবাবু ইংলিশটা ছাড়া আর কিছু ভালো করে দেখেন না। অবশ্য সেইটাই প্রধান তা জানি, কিন্তু কোন কিছুতেই কঁচা থাকবে তা চাই না আমি।
–বেশ তো, ওঁকে নয় বলে দেখব সপ্তাহে চারদিন না এসে যদি ছ’দিন অন্ততঃ আসেন। অবশ্য ‘পে’টা কিছু বাড়াতে হবে–
-না।
–না মানে?
–‘না’ মানে না। ওর আর কোন মানে নেই। ছোটলোকের মত যে একই টিউটর ইংলিশ দেখবে–ম্যাথমেটিকস্ দেখবে–হিস্ত্রী, জিওগ্রাফী, বেঙ্গলী, গ্রামার সবই দেখবে–এটা আমার জঘন্য লাগে। তাহলে বাবলু অভীরই বা আলাদা টিউটরের দরকার কি–সাধারণ কেরানী বাড়ীর মত একটা টিউটর এসে তিনজনকে ধরে সবগুলো সাবজেক্টের মিক্সচার খানিকটা গিলিয়ে দিয়ে গেলেই চমৎকার হয়!
–সে কথা হচ্ছে না। মণীন্দ্র হতাশ ভঙ্গীতে বলেন–ও বেচারা আর কখন সময় পাবে? সপ্তাহের মধ্যে তিনদিন তো তোমার গান-বাজনা-এস্রাজ আর ডান্সিং মাস্টারের নিষ্ঠুরতা–বাকি চারদিন তো হিমাংশুবাবুই আছেন। সপ্তাহটা তো রবারের নয় যে টেনেটুনে বাড়িয়ে নেবে।
–কেন, সকালে? রুটিন হিসেবে চললে অনায়াসেই এক ঘণ্টা করে সময় বের করা যায়! –সকালে? আহা!
–এই সব বাজে সেন্টিমেন্টের কোন মানে হয় না। আহা কিসের? এই তো শিক্ষার সময়। জগতে যা কিছু শিক্ষণীয় বিষয় আছে সবগুলোই দেখতে হবে চেষ্টা করে। এত সুযোগ থাকতে
মণীন্দ্রনাথ মনে মনে বলেন–নিজের জীবনের সুযোগের অভাবই বোধ করি তোমাকে এমন জ্ঞানী করিয়া তুলিয়াছে! মুখে বলিতে সাহস পান না, শুধু ভাবিতে চেষ্টা করেন চিত্রলেখার ভাগ্যে সে সুযোগ ঘটিলে মণীন্দ্রর নিজের ভাগ্যে কি ঘটিত!
.
মেয়েকে সর্ববিদ্যা-পটিয়সী করিয়া তুলিবার দুরন্ত সাধনায় মেয়ের জীবনটা চিত্রলেখা দুঃসহ করিয়া তুলিয়াছে বলিয়া ভারি একটা ক্ষোভ ছিল মণীন্দ্রর, কিন্তু সহসা একদিন মেয়েরই এক নূতনতর আবদারে তাক লাগিয়া গেল তাঁহার। সপ্তাহের সব কয়টা দিনকে রবারের মত টানিয়া। টুনিয়া বাড়াইবার অপূর্ব কৌশল আয়ত্ত করিলেও, রবিবারের সকালটাকে উদার ঔদাসীন্যে বাদ দিয়া রাখিয়াছিল চিত্রলেখা। সেই দুর্লভ ক্ষণটুকুকেও কাজে লাগাইবার বায়না লইয়া বাবার দরবারে আসিয়া হাজির হইল বেবি।
মায়ের কাছে তাহার সব বিষয়েই কুণ্ঠা, বাবার কাছে নিশ্চিত প্রশ্রয়ের নিশ্চিন্ত। অতএব জগতের যাবতীয় শিক্ষণীয় বস্তু সম্বন্ধে মায়ের যতই উৎসাহ থাক, বেবি আসিয়া বাবাকেই ধরিয়া পড়িল–সে গাড়ী চালানো শিখিবে।
মেয়ের অভিনব ইচ্ছায় সস্নেহ হাসি হাসিয়া মণীন্দ্র কহিলেন–কেন বলো তো? অক্ষয় রিটায়ার করতে চায় নাকি?
তাপসী হাসিয়া বাবার চেয়ার ঘেঁষিয়া দাঁড়াইয়া বলে–বাঃ, তা কেন? শিখে রাখা ভাল নয় বুঝি? মোটর-ড্রাইভিং শেখে না মানুষ?
বলা বাহুল্য, বাবার দরবারে আবেদন করিবার কালে একটু নির্জন অবসরের জন্য যতই চেষ্টা করুক বেচারা, অমিতাভ তাহার সঙ্গ ছাড়ে নাই। দিদির কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই নিতান্ত অবজ্ঞাভরে বলিয়া উঠে–মানুষরা শেখে নিশ্চয়ই, দরকারও আছে শিখে রাখবার, মেয়েমানুষে শিখতে যাবে কি জন্যে?
–অভী, আবার? তীব্র নয়নে অগ্নি হানিয়া দিদি সরোষে বাবার কাছে অভিযোগ করে বাবা দেখছ? অভী আবার আমাকে মেয়েমানুষ’ বলে ঠাট্টা করছে।
অর্থাৎ বোঝা যায় ঠাট্টাটা পূর্ব-নিষিদ্ধ।
কিন্তু অমিতাভ কিছুমাত্র দমে না। সজোরে বলে–যে যা, তাকে তাই বললে ঠাট্টা হয় বুঝি? আমাকে ‘পুরুষমানুষ’ বলো না, কিছুই রাগ করব না আমি। যা সত্যি তা বলতে দোষের কি আছে?
তাপসী নিরুপায় আক্রোশে উত্তেজিত হইয়া বলে–কেন থাকবে না? কানাকে ‘কানা’ বললে দোষ হয় না? খোঁড়াকে ‘খোঁড়া’ বললে দোষ হয় না? গরীবকে–
অমিতাভর সহসা সশব্দ হাসিতে সব উদাহরণগুলা আর দাখিল করা সম্ভব হয় না তাপসীর পক্ষে।
মণীন্দ্রও অবশ্য মেয়ের যুক্তির মৌলিকত্বে হাসিয়া ফেলিয়াছেন, তবু দুর্বলের পক্ষগ্রহণ নীতির বশে ছেলের হাসির প্রতিবাদ করেন–বা রে অভী, হাসছ কেন তুমি? ঠিকই তো বলেছে বেবি। মেয়েদের ‘মেয়ে’ বললে তোমার মা চটেন না?