–কিসের জোরে নাকচ করা যায় সে তোমাকে শেখাবার রুচি নেই, কিন্তু কি করে করা যায় দেখিয়ে দেব জেনো। বেবির যদি উপযুক্ত সময়ে উপযুক্ত বিয়ে আমি না দিই, তাহলে আমি–, সভ্যতা ভব্যতা এবং আধুনিকতার বহির্ভূত কটু একটা দিব্যি উচ্চারণ করিয়া ঠিকরাইয়া বাহির হইয়া গেল চিত্রলেখা।
.
মণীর নিষ্ঠুরের মত চলিয়া যাওয়ার পর হেমপ্রভা প্রথমটা বজ্রাহতের মতই স্তম্ভিত হইয়া গিয়াছিলেন, ক্রমশ নিজেকে প্রস্তুত করিয়া লইলেন। ভালোই হইল যে মায়ার বন্ধন মুক্ত করিয়া দিতে ভগবান এমন করিয়া সাহায্য করিলেন। কি মিথ্যার উপরই প্রাসাদ গড়িয়া বাস করা। সে প্রাসাদ যদি ভাঙিয়া পড়ে তো পড়ক, হয়তো ঈশ্বরের আশীর্বাদ সেটা।
পয়সার খোঁটাটাই বড় কঠিন হইয়া বাজিয়াছে। পয়লার লোভে হেমপ্রভা একটা অসঙ্গত কাজ করিয়া বসিতে পারেন–এত অনায়াসে এত বড় কথাটা উচ্চারণ করিল মণীন্দ্র! ছেলের উপর দুরন্ত অভিমানটা বৈরাগ্যের বেশে আসিয়া দেখা দেয়।
নিজের দিকটাই এত বড় হইয়া উঠিল। মায়ের মনের দিকটা একবার তাকাইয়া দেখিল না! কী লজ্জায় কুণ্ঠায় মরমে মরিয়া আছেন তিনি, সেটা অনুভব করিবার চেষ্টা মাত্র করিল না! যা ঘটিয়া গিয়াছে তাহার তো চারা নাই, কিন্তু এত অগ্রাহ্য করিয়াই লাভ কি? একেবারে স্থির বিশ্বাস করিয়া বসিল–অপাত্র! নিজেই একবার দেখাশোনা করো, ম্লেচ্ছ খৃষ্টান নও যৈ মেয়ের আবার বিবাহ দিবে! অল্প বয়সে বিবাহ দিয়া অনেকে তো ছেলেকে জামাইকে বিলাতেও পাঠায়। তাই কেন মনে করো না? না হয় পাঁচ-সাত বৎসর ছাড়াছাড়িই থাকত?-বারো বছরের মেয়ের যৌবন আসিতে কত যুগ লাগে? পরিপুষ্ট গঠনভঙ্গির ভিতর এখনই কি ছোঁয়া লাগে নাই তার?…আচ্ছা বেশ, ফ্যাশানের দায় চাপাইয়া নবযৌবনা কন্যাকে শিশু করিয়া রাখ–কিন্তু হেমপ্রভা যদি মনে-প্রাণে নিষ্পাপ থাকিয়া থাকেন, একদিন নিজেদের ভুল বুঝিতে হইবে তোমাদের।
ভগবানের কাছে বার বার প্রার্থনা করিতে থাকেন হেমপ্রভা–অগ্রাহ্য অবহেলায় যার নামটা পর্যন্ত শুনিতে রুচি করিল না মণীন্দ্র, সেই ছেলেই যেন শিক্ষায়দীক্ষায় চরিত্র-গৌরবে উজ্জ্বল হইয়া ওঠে, লোভনীয় হইয়া ওঠে। নিতান্তই বড় স্নেহের তাপসীর ভাগ্যের সঙ্গে জড়িত তাই, তা নয়তো হয়তো হেমপ্রভা অভিসম্পাত দিয়া বসিতেন–সেই লোভনীয় বস্তুর পানে চাহিয়া যেন একদিন অনুতাপের নিঃশ্বাস ফেলিতে হয় মণীন্দ্রকে চিত্রলেখাকে।…না থাক, হেয়প্রভা কায়মনে আশীর্বাদ করিতেছেন–তাপসীর ভবিষ্যৎ যেন অন্ধকারাচ্ছন্ন না হয়। তবে হেমপ্রভা এবার সরিয়া যাইতে চান।
নিজস্ব সমস্ত সম্পত্তি তাপসীর নামে দানপত্র করিয়া দিয়া হেমপ্রভা আষাঢ়ের এক বর্ষণমুখর রাত্রে সর্বতীর্থসার বারাণসীর উদ্দেশে রওনা হইয়া গেলেন। কলিকাতার বাড়ীতে আর ফিরিলেন না।
তাপসীর উপর অনিচ্ছাকৃত যে অপরাধ করিয়া ফেলিয়াছেন তাহারই খেসারৎ স্বরূপ বোধ করি এই দানপত্র।
শাশুড়ীর আক্কেল দেখিয়া চিত্রলেখা আর একবার স্তম্ভিত হইল। এ কি ঘোর শত্রুতা! তাছাড়া বেবিকে লায়েক’ হইয়া উঠিবার আবার একটি সুযোগ করিয়া দেওয়া হইল! একেই তো মেয়ে মায়ের তেমন বাধ্য নয়, আবার অতগুলো বিষয়-সম্পত্তির মালিক হইয়া উঠিলে রক্ষা থাকিবে?…চিত্ৰলেখার বিরুদ্ধে এ যেন যুদ্ধ ঘোষণা হেমপ্রভার! শাশুড়ীর কাশীবাসের সংবাদে যথেষ্ট হৃষ্ট হইবার সুযোগ আর পাইল না বেচারা!
যাক তবু নিষ্কণ্টক!
২. মেয়ে-ছেলেদের সুশিক্ষিত
এতদিনে চিত্রলেখা উঠিয়া পড়িয়া লাগে মেয়ে-ছেলেদের সুশিক্ষিত করিয়া তুলিতে। সদ্য দেখিয়া আসা সেজকাকীর ও তস্য ভগিনীর ছেলেমেয়েদের দৃষ্টান্ত তো আছেই, তাছাড়া আছে চিরদিনের স্বপ্নসাধ । শাশুড়ীর জ্বালায় যেটা সম্পূর্ণ বিকশিত হইতে পায় নাই।
গভীর রাত্রে রাত্রি জাগিয়া স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে-না প্রেমালাপ নয়–তর্ক হইতেছিল।
–চিত্রলেখার স্বর স্বভাব-অনুযায়ী তীক্ষ্ণ অসহিষ্ণু, মণীন্দ্র গম্ভীর কিন্তু কতকটা যেন অসহায়। তর্কের বস্তু তাপসী। মণীন্দ্রর ধারণা–তাপসী ছেলেমানুষ হইলেও বিবাহ ব্যাপারটায় তার মনে হয়তো কিছুটা রেখাপাত করিয়াছে, সে রেখা সিঁথির সিঁদুর রেখার মত অত সহজে মুছিয়া ফেলা বোধ হয় সম্ভব নয়। চিত্রলেখার হিসাবে হয়তো ভুল আছে, মেয়েকে অতি আধুনিক করিয়া গড়িয়া তুলিয়া যথাসময়ে যথার্থ বিবাহের জন্য প্রস্তুত করিবার ইচ্ছাটা একটু যেন অসঙ্গত জেদের মত। কিন্তু চিত্রলেখার কথার উপর তেমন জোর দিয়া কথা বলার ক্ষমতা মণীন্দ্রর কই?
তাই দ্বিধাগ্রস্ত ভাবে বলেন–হয়তো শেষ পর্যন্ত সেই বিবাহটাকেই মেনে নিতে হবে। অবশ্য এখন নয়–যাক দু’চার বছর হয়তো ছেলেটা–
চিত্রলেখা এতক্ষণ নিজের খাটেই ছিল, কিন্তু এখন সঙ্গীন অবস্থায় অত দূর পাল্লা হইতে অস্ত্র নিক্ষেপ কার্যকরী না হওয়ার আশঙ্কায় উঠয়া আসিয়া স্বামীর শয্যাপার্শ্বে বসিয়া পড়িয়া স্বামীর বদলে বালিশের উপর একটি প্রবল চাপড়’ বসাইয়া তিক্ত তীক্ষ্ণ স্বরে বলে কী, সেই জোচ্চোরদের সঙ্গে আপস করে? তার চেয়ে মনে করব বেবি বিধবা, গোঁড়া হিন্দুঘরের বালবিধবা!
–ছি চিত্রা!
–ছি আবার কিসের? আমার কাছে এই সাফ কথা। তোমাদের সেই পুতুলখেলার বিয়ের বর যদি রাজপুত্তুরও হয়, সে বিয়ে আমি মানব না, মানব না, মানব না। তোমার মা’র স্বেচ্ছাচারিতার কাছে কিছুতেই হার মানব না।