স্বামীকে জিজ্ঞাসা করিতে সাহসে কুলায় না, বড় মেয়ে-ছেলের কাছেও কেমন যেন একটু লজ্জা করে, তাই চুপিচুপি সিদ্ধার্থকে ডাকিয়া প্রশ্ন করে–তোমাদের নানি কবে মারা গেলেন?
–নানি! দুই চোখ বড় করিয়া সিদ্ধার্থ মায়ের মুখের পানে তাকায়। মা কি হঠাৎ পাগল হইল নাকি? তীক্ষ্ণস্বরে কহিল–নানি মারা যাবেন কেন?
–ওঃ! যাননি তাহলে? ধন্যবাদ। তা তোমরা হঠাৎ অসুস্থ মানুষকে ফেলে চলে এলে যে? একটু ভাল আছেন বুঝি?
টেলিগ্রামের কথা ছেলেমানুষ সিদ্ধার্থ জানে না, জানিবার কথাও নয়, তাই একটু থামিয়া বলিয়া ফেলে–নানির অসুখ করতে যাবে কেন? শুধু তো মন খারাপ!
এক মুহূর্তে কঠিন হইয়া ওঠে চিত্রলেখা। ওঃ, অসুখটা তবে ছল! ছেলে-বৌকে দেশে টানিয়া লইয়া যাইবার ছুতা! মায়ের উপর তবে ক্রুদ্ধ হইয়া ছেলেমেয়েদের লইয়া আসিয়াছেন মণীন্দ্র! প্রলয়গম্ভীর মুখের কারণ এতক্ষণে বোঝা গেল। ভালই হইয়াছে যে এতদিনে মায়ের স্বরূপ চিনিয়াছেন মণীন্দ্র। ভালো! ভালো! উভয়পক্ষই বেশ জব্দ হইয়াছেন। চাপা হাসি চাপিয়া ছোট্ট ছেলেটাকেই বিদ্রূপব্যঞ্জক ভঙ্গীতে শুধায় চিত্রলেখা–তা হঠাৎ তার মন খারাপের কারণটা কি হল?
বাবার কাছে বলিয়া ফেলিবার ভয়ে সেখানে একটা নিষেধ ছিল বটে, কিন্তু মার কাছে বলিতে আলাদা করিয়া কোন নিষেধের অর্ডার পাওয়া যায় নাই, তাই সিদ্ধার্থ সোৎসাহে বলে–তা মন খারাপ হবে না–দিদির বিয়ে হয়ে গেল–তোমরা দেখতে পেলে না, কিছু উৎসব হল না–নেমন্তন্ন হল না–
ছেলেটা নিতান্ত মেল ট্রেনের গতিতে কথা কয় বলিয়াই এতগুলো কথা বলিয়া ফেলিতে পারে, কারণ প্রথমাংশটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে ছিলা-ছেঁড়া ধনুকের মত সোজা হইয়া উঠিয়াছে চিত্রলেখা–কী বললি? কী হয়ে গেল? দিদির কী হয়ে গেল?
মায়ের মূর্তি দেখিয়া উৎসাহটা নিতান্তই স্তিমিত হইয়া পড়ে বেচারার। ভয়ে ভয়ে বলে–দিদির হঠাৎ বিয়ে হল কিনা। সেই বুড়ো ভদ্দরলোক তাড়াতাড়ি মরে গেল যে আজ বিয়ে হল–কাল মরে গেল–ব্যস্!
চিত্রলেখা আর সিদ্ধার্থর কাছে দাঁড়াইয়া সময় নষ্ট করিবার প্রয়োজন অনুভব করে না। হার্টের অসুখ ভুলিয়া বিদ্যুৎবেগে মণীন্দ্রর বসিবার ঘরে আসিয়া দাঁড়ায়। ট্রেনের পোশাক এইমাত্র ছাড়িয়া বসিয়াছেন তিনি–পিতাপুত্রী দু’জনেই আছেন–চমৎকার!
বিদ্যুতের মত আসিয়া বাজের মত ফাটিয়া পড়াই সামঞ্জস্যপূর্ণ, তাই প্রশ্নটা বাজের মত শোনায়–ব্যাপারটা কি হয়েছে শুনতে পারি?
মণীন্দ্র গম্ভীরভাবে একবার সেই অগ্নিময় মুখচ্ছবির পানে চাহিয়া ধীরস্বরে বলেন– শোনবার মত নয়।
–বলতে লজ্জা করছে না? প্রকৃত ঘটনা শগগির বলো আমায়, কি ভেবেছ কি তোমরা?
–প্রকৃত ঘটনা–আমি যতটুকু জানি তা এই–একজনের প্ররোচনায় পড়ে মা বেবির একটা বিয়ে দিয়ে ফেলতে বাধ্য হয়েছেন…বেবি, তুমি ওপরে যাও, অভীর সঙ্গে খেলা করগে।
চিত্রলেখার লিপস্টিক রঞ্জিত ওষ্ঠাধরের পথ বাহিয়া যে লাভাস্রোত প্রবাহিত হইবে, সেটা কল্পনা করিয়া বোধ করি বালিকা কন্যার জন্য করুণা হইল মণীন্দ্রর। কিন্তু চিত্রলেখা অত
ভাবপ্রবণ নয়, তাই চিলের মত তীক্ষ্ণকণ্ঠে চীৎকার করিয়া ওঠেনা, উঠে যাবে না ও, সমস্ত পরিষ্কার শুনতে চাই আমি। জেনে রেখো, তোমার মা’র এসব স্বেচ্ছাচার কিছুতে সহ্য করব না। তোমার মা বলে রেহাই দেব না।
–কি করবে? মা’র নামে চার্জশীট আনবে?
–দরকার হলে তাও করতে কুণ্ঠিত হব না এটা জেনো।…এই বেবি, সরে আয় এদিকে, সরে আয় বলছিসিঁদুর পরেছিস! লজ্জা করছে না? উঠে আয় বলছি!
সিন্দুররেখা একটু ছিল বৈকি, নবোঢ়ার গৌরবদীপ্ত উজ্জ্বল রেখা নয়, ভীরু কুণ্ঠিত ক্ষীণ একটু আভাস…চিত্রলেখার রুমালের ঘর্ষণে সেটুকু মুছিয়া যায়–শুধু একটু বেদনাময় আভাস রাখিয়া।
তাপসী অমন শুষ্ক চোখে তাকাইয়া থাকে কেমন করিয়া? ঘন পল্লব বেষ্টিত বড় বড় দুই চোখের বড় বড় জলের ফেঁটাগুলি হারাইয়া গেল কোথায়? শুকনো পাংশুমুখে চোখ দুইটা বড় বেমানান দেখিতে লাগে।
–যাও সাবান দিয়ে ধুয়ে ফেল গে, আর দ্বিতীয় দিন যেন এসব অসভ্যতা দেখতে পাই না। মায়ের আদেশে অন্ততঃ এইটুকু উপকার হয় তাপসীর, মায়ের সম্মুখ হইতে সরিয়া যাইবার একটা ছুতা পায়।
মণীন্দ্র একটু তিক্ত হাসির সঙ্গে বলেন–চিহ্নটা মুছে ফেলতে পারো–ঘটনাটা তো মুছে ফেলবার নয়!
বিরক্তিটা কেবলমাত্র চিত্রলেখার ওপরই নয়, মায়ের উপর–হয়তো বা নিজের ভাগ্যেরও উপর।
চিত্রলেখা মুহূর্তে জ্বলিয়া উঠিয়া উত্তর করে–তুমি কি আশা করছ এই খেলাঘরের রাবিশ বিয়ে আমি সমর্থন করব?
–খেলাঘরের আর কি করে বলা চলে? অনুষ্ঠানের তো কিছুই ত্রুটি হয়নি শুনলাম– কুশণ্ডিকা সপ্তপদী পর্যন্ত হয়ে গেছে!
–কন্যা সম্প্রদান বলে একটা কথা আছে না? তোমার অনুপস্থিতিতে তোমার মেয়েকে সম্প্রদান করা হয় কোন্ আইনে? কোন্ অধিকারের বলে অপর কারো পক্ষে এ কাজ সম্ভব হয়?
–হিন্দু আইনের বলেই হয়। আমার পরিবর্তে আমার মা কন্যা সম্প্রদান করলে সেটা আইনের চক্ষে অসিদ্ধ নয় চিত্রা।
–তাহলে তুমি এটাকে বিয়ে বলে মেনে নিতে চাও?
–উপায় কি! ওপরে যতই ময়ূরপুচ্ছ এঁটে বেড়াই, ভেতরে তো হিন্দু ছাড়া আর কিছুই নই। আমরা! অগ্নি-শালগ্রাম সাক্ষ্য করা হিন্দু বিবাহ নাকচ করে দেব কিসের জোরে?