–নিজের অপরাধ কমাতে চাই না মণি। হেমপ্রভা হঠাৎ যেন কোথা হইতে বল সঞ্চয় করিয়া উঠিয়া বসেন, অপেক্ষাকৃত ধীরস্বরে বলেন–জানি আমারই সমস্ত দোষ, তবু একটি কথা তোমায় বলব আমি–অপাত্রে পড়েনি তাপসী। হয়ত তুমিও সে ছেলেকে দেখলে
–থাক থাক, ও কথা আমার সামনে আর বলল না মা। একটা বাচ্ছা ছেলে–সে আবার অপাত্ৰ-সুপাত্র! কান্তি মুখুজ্জে কোলিয়ারি কিনে অনেক পয়সা করেছে বটে, কিন্তু মা-বাপ-মরা নাতিটাকে কি সুশিক্ষা দিয়েছে তার খবর জানো কিছু! ম্যাট্রিক পাস করেছে কি করেনি তাও জানো না বোধ হয়! উঃ, আমার সমস্ত আশা ধ্বংস হয়ে গেল! তোমার বুদ্ধির ওপর একটু আস্থা ছিল, কিন্তু তোমাকে যে লোকে এত বড় ঠকানোটা ঠকাতে পারে এটা কোনদিন ধারণা করতে পারিনি।
হেমপ্রভা সমস্ত অভিমান বিসর্জন দিয়া শান্তভাবে বলেন–ঠকা-জেতা তুমি নিজে একবার পরীক্ষা করে দেখ। সে ভদ্রলোক নিশ্চিন্ত হয়ে মরেছেন যে, মা-বাপ-মরা ছেলেটার একটা অভিভাবক ঠিক করে দিয়ে গেলেন। সেই অভিভাবকের কাজ তুমি করো, ও যাতে মানুষের মত মানুষ হয়ে ওঠে দেখো। পয়সার তো অভাব নেই তার
–বুঝেছি মা, পয়সার লোভটাই সামলাতে পারনি তুমি। মণীন্দ্র নীরস স্বরে মন্তব্য করেন–তোমার ওপর ধারণাটা অনেক উঁচু ছিল, যাক সে কথা, তবে পরের ছেলের অভিভাবক সাজবার স্পৃহা আমার নেই। বেবি-অভীদের তৈরি হতে বল, বিকেলের ট্রেনে বেরোব।
–আজকেই চলে যাবি মণি? তার একবার খোঁজ করবি না? বুড়ো মাকে তুই জীবনেও ক্ষমা না করতে পারিস করিসনে, কিন্তু মেয়েটার আখের ভাব! শুনেছি পাসের খবর বেরোলে কলকাতার হোস্টেলে পড়তে যাবার কথা, এখন ঠাকুর্দা মরে গিয়ে কি অবস্থায় আছে বেচারা, কোন খবরই নিতে পারিনি, তুই একবার খোঁজ করে দেখ–
–যে অনুরোধ রাখতে পারব না, সে রকম অসঙ্গত অনুরোধ করো না মা। ..অভী! অভী! এই যে, তোমরা এখনই তৈরি হয়ে নাও, বিকেলের গাড়ীতে কলকাতায় ফিরতে হবে।
মায়ের যাওয়ার নাম মাত্র উচ্চারণ করেন না মণীন্দ্র। রায় দিয়া গম্ভীরভাবে উঠিয়া যান।
হেমপ্রভা অবাক অনড় ভাবে বসিয়া থাকেন। না, মণীন্দ্র তাঁহাকে তিরস্কার করে নাই, গালি দেয় নাই, কিন্তু চিত্রলেখা এর চাইতে আর কত বেশী অপমান করিতে পারিত!
.
ভয়! ভয়!
ছোট মনটুকু আচ্ছন্ন করিয়া আছে এই করাল দৈত্য। অপরাধটা তার দিক হইতে হইল কখন একথা জানে না তাপসী, তবু সেই অজ্ঞাত অপরাধের ভারে বেচারা যেন আড়ষ্ট হইয়া গিয়াছে। অথচ বাবা তাহাদের কাহাকেও তোকই এতটুকু তিরস্কার পর্যন্ত করিলেন না!
নানির সঙ্গে কি কথাবার্তা হইল কে জানে, তবু নানির ঘর হইতে বাহির হইবার সময় বাবার অস্বাভাবিক থমথমে মুখ দেখিয়া, একলা তাপসী কেন, তিনটি ভাই-বোনই সন্ত্রস্ত হৃদয়ে বিরাট বাড়ীর একটু নির্জন কোণ খুঁজিয়া নীরবে বসিয়া ছিল।
ছোট্ট সিদ্ধার্থও যেন অনুভব করিতে পারিতেছে, যা ঘটিয়া গিয়াছে তাহা অন্যায় অসঙ্গত–না ঘটিলেই বাঁচা যাইত। এই অসঙ্গত আচরণের কৈফিয়ৎ বুঝি সকলকেই দিতে হইবে। কখন সেই রুদ্রমেঘ ভাঙিয়া পড়িবে, সেই আশঙ্কায় স্তব্ধ হইয়া থাকে তিনজন।
কিন্তু ভাঙিয়া পড়িল না। ছেলেমেয়েদের ডাকিয়া শুধু এইটুকু জানাইলেন মণীন্দ্র যে বিকালের গাড়ীতেই রওনা হইতে হইবে তাহাদের।
কিন্তু ভাঙিয়া যে পড়িল না সেইটাই কি স্বস্তির? বরং কঠিন তিরস্কারের ভিতর কিছুটা সান্ত্বনা খুঁজিয়া পাওয়া সম্ভব ছিল। বাবার মূর্তিটাই যে তিবস্কারের মত উদ্যত হইয়া রহিল।
ভয়! ভয়!
.
ট্রেনের গতি দ্রুত হইতেছে–আর নিকটবর্তী হইয়া আসিতেছে কলিকাতা–যেখানে চিত্রলেখা আছেন!…হায়, মা’র সঙ্গে মুসৌরী যাইলে তো এত কাণ্ডের কিছুই ঘটিত না! কেনই যে দেশে যাইবার শখ এত প্রবল হইল!..আচ্ছা সেই ছেলেটিও এই ট্রেনেই কলিকাতা আসিতেছে না তো? কলিকাতায় থাকিয়া পড়িবার কথা ছিল।…বুড়ো ভদ্রলোক তো মারা গেলেন–বাড়ীতে নাকি আর কোন লোক নাই।…কী আশ্চৰ্য্য, অতটুকু একটা মানুষ অত বড় একটা বাড়ীতে একলা থাকিতে পারে নাকি! কে যেন বলিতেছিল–বরাবর রাণীগঞ্জে থাকে ওরা। সেখানেই বা আছে কে? মা বাপ ভাই বোন কিছুই নাই, এ আবার কি রকম কথা! একটিমাত্র দাদু, তাও তো মরিয়া গেলেন…আচ্ছা সারাদিন কথা কয় কার সঙ্গে? চাকর? ঠাকুর? দূর!..কলকাতায় কত কলেজ…সব কলেজেই হোস্টেল থাকে?…তাপসীও ম্যাট্রিক পাসের পর কলেজে ভর্তি হইবে–উঃ, কত দেরি তার–তিন-তিনটি বছর পরে তবে ম্যাট্রিক পরীক্ষা!
–বেবি, জানলার ধার থেকে সরে এস, কয়লার গুঁড়ো লাগছে মুখে। বাপের কণ্ঠস্বরে অত চমকাইবার কারণ কি ছিল? যেন চুরি করিতে গিয়া ধরা পড়িয়াছে তাপসী। আবার সেই ভয়টা বুকের উপর চাপিয়া বসিতেছে শ্রীরামপুর…উত্তরপাড়া…লিলুয়া নামগুলো নূতন নাকি? বুকের ভিতর এত শব্দ কেন? চিত্রলেখা নিকটবর্তী হইতেছেন বলিয়া?
.
ছেলেমেয়েদের ও স্বামীর মুখ দেখিয়া শাশুড়ীর মৃত্যু সম্বন্ধে আর সন্দেহ রহিল না চিত্রলেখার। তা এত তাড়াহুড়া করিয়া মরিবার কি দরকার ছিল? চিত্রলেখার বদনাম করিতে ছাড়া আর কি! যাক তবু ভালো, মনের দুঃখে গেঁয়ো ভূতদের মত জুতা খুলিয়া পা খালি করিয়া আসিয়া হাজির হন নাই মণীন্দ্র! স্বামীর কাছে অন্ততঃ এটুকু সভ্যতাজ্ঞানের পরিচয় পাইয়া কিছুটা হৃষ্ট হয় চিত্রলেখা।