চিত্রলেখা উঠিয়া যাইবার কিছুক্ষণ পরেই সেজকাকীমার আবির্ভাব ঘটিল। বয়সে চিত্রলেখার চাইতে কয়েক বৎসর বড় হওয়াই সম্ভব, তবে সাজসজ্জায় চলনে-বলনে বয়স ধরা পড়ে না। চশমার কাঁচ মুছিতে মুছিতে ভাটিয়ালী শাড়ীর আঁচল পিঠে ফেলিয়া আসিয়া দাঁড়াইলেন।
পূজনীয়া খুড়শাশুড়ী মণীন্দ্র তাড়াতাড়ি উঠিয়া দাঁড়াইবার ভঙ্গীতে অবহিত হন, অবশ্য দাঁড়ান না। মাজা-ঘষা মিহি গলায় অনুযোগের সুর ঝঙ্কৃত হইয়া ওঠে–এ তোমার অন্যায় মণীন্দ্র। তোমার মা’র অসুখ, বেশি হোক কম হোক–তুমি যাবে, উচিতও যাওয়া কিন্তু ও বেচারাকে খামকা সেই জঙ্গলের মাঝখানে টেনে নিয়ে যাওয়া কেন?
মণীন্দ্র গম্ভীর সুরে বলেন–আমি তো বলিনি যেতে!
–ইচ্ছে প্রকাশ করেছ তো! সেও একরকম বলাই হল! আমাদের তো ইচ্ছে নয় যে ও তাড়াতাড়ি চলে যায়। তাছাড়া এখানে এসে ওর হেলথটা একটু ইমপ্রুভ করছিল–অবশ্য তোমার মতামতের ওপর কথা বলতে চাই না, তবে তোমাদের কাকাবাবু বলছিলেন ‘পরে আমাদের সঙ্গে গেলেই হত!
বোঝা গেল কাকাবাবুর দূত হিসাবেই আসিয়াছেন তিনি, নিতান্তই কর্তব্যের খাতিরে। তা নয়তো স্বেচ্ছায় ঝঞ্ঝাটকে আগলানো! একটু আশ্চর্য বৈকি! অবশ্য আগে আগে যখন চিত্রলেখার সেজকাকীমার প্রতি দৃষ্টিটা ছিল বিমুগ্ধ বিচঞ্চল, তখন ভাসুরঝিকে খুব পছন্দই করিতেন ভদ্রমহিলা, কিন্তু ইদানীং যেন চিত্রলেখাই তাহাকে তাক লাগাইয়া দিতে চায়। কাজেই পছন্দটা বজায় রাখা দুষ্কর। তাঁ, তবে বাহিরে সভ্যতার ঠাট বজায় রাখিবার ক্ষমতা তাঁহার যথেষ্টই আছে। ওটা এখনও কিছুকাল সেজকাকীমার কাছে শিখিতে পারে চিত্রলেখা।– শাশুড়ী-জনোচিত মর্যাদা তিনি রক্ষা করেন জামাতার কাছে মেয়েকে আরও কিছুদিন রাখিবার অনুরোধ জানাইয়া।
মণীন্দ্র এতক্ষণ ‘পাইপ’ সরাইয়া রাখিয়া ভিতরে ভিতরে অতিষ্ঠ বোধ করিতেছেন। কথায় ছেদ টানিয়া দিতে তাড়াতাড়ি বলিলেন–বেশ তো থাকুক না আপনাদের কাছে, আপত্তির কি আছে! আমি রাত্রের ট্রেনেই স্টার্ট করব।
সেজকাকীমা একটু ফাঁপরে পড়েন। দূত হিসাবে আসিয়াছেন বটে, কিন্তু নিজস্ব ইচ্ছাটা তো আর বি দিয়া আসেন নাই। তাই আরও মিহি আরও অমায়িক সুরে বলেন– অবশ্য জীবন মরণের কথা কিছুই বলা যায় না, চিত্রার সঙ্গে যে তোমার মা’র একবার শেষ দেখা হবে না–এটাও যেন না হয়, জোর করে আটকাতে আমি চাই না।
–না, আপনার আর দোষ কি, উনি নিজে যা বিবেচনা করবেন–বলিয়া যেন অন্যমনস্ক ভাবে পাইপটা টেবিলে ঠুকিতে থাকেন মণীন্দ্র। চিত্রলেখা কি আর সাধে বলে, ভিতরে ভিতরে গ্রাম্যতা ঘোচে নাই! শ্বশুর-শাশুড়ীর সামনে কে তাহাকে পাইপ ধরাইতে নিষেধ করিয়াছে মাথার দিব্য দিয়া?
.
টেলিগ্রামখানা ছাড়িয়া পর্যন্ত ঘর-বার করিতেছিলেন হেমপ্রভা।
কি বলিবেন? কি করিবেন? আসিবামাত্রই কঁদিয়া কাটিয়া ছেলে-বৌয়ের হাত ধরিয়া ক্ষমা চাহিবেন? না রোগের ভান করিয়া বিছানায় পড়িয়া থাকিবেন? তাপসীকে না হয় সিঁদুর ঢাকিয়া বাঁকা সিঁথি কাটিয়া রাখিবেন, ছেলেদের ও চাকরবাকরদের না হয় শিখাইয়া রাখিবেন কোন কথা প্রকাশ না করিতে। ধীরে ধীরে মেজাজ বুঝিয়া…কিন্তু তারপর? তারপর কি বলিবেন হেমপ্রভা? কি বলিবেন ভাবিতে গেলে যে বুদ্ধিবৃত্তি অসাড় হইয়া যায়!
বর্তমান যুগে দেবতারা যে বধির এ বিষয়ে আর সন্দেহ কি! হেমপ্রভার এত প্রার্থনা বিফল হইয়া স্বাভাবিক নিয়মে দিনরাত্রি আবর্তিত হইতে থাকিল, হেমপ্রভার, হার্টফেল হইল না, দৈব দুর্ঘটনা ঘটিল না, সামান্য একটু জ্বর পর্যন্ত দেখা দিল না।…সম্ভাব্য সময়ে স্টেশনে গাড়ি গেল এবং সেই খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই যথার্থ রোগিণীর মত নির্জীব হইয়া বিছানায় আশ্রয় লইলেন হেমপ্রভা।
কথায় বলে, বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরো! এমন নিরেট সাবধানতার মাঝখানে যে এত বড় ছিদ্র ছিল সে কথা কে হুশ করিয়াছিল! সব প্রথম যার সঙ্গে দেখা হওয়ার কথা–গাড়ীর সেই কোচম্যানটাকে যে সাবধান করিয়া রাখা হয় নাই, সেটা আর খেয়ালে আসে নাই হেমপ্রভার!
.
সময় যত নিকটবর্তী হইতে থাকে বুকের স্পন্দন তত দ্রুত হইয়া ওঠে। অবশেষে গাড়ীর চাকার শব্দ–গেট খোলা এবং বন্ধ করার শব্দ–পরিচিত জুতার শব্দ বুকের উপর যেন হাতুড়ি পিটিতে থাকে কিন্তু চিত্রলেখা কই? শুধু একটা ভারী জুতার শব্দ কেন?…না, চিত্রলেখা আসে নাই। ঈশ্বর আছেন’ শুধু এইটুকু চিন্তা করিতে না করিতে ছেলের মুখ দেখিয়া হেমপ্রভা চোখে অন্ধকার দেখেন।…না, গোপন নাই। সেই ভয়ঙ্কর কথাটা প্রকাশ হইয়া গিয়াছে! মুখ দেখিয়া সন্দেহ থাকে না কিছু। এক মিনিট..দুই মিনিট… প্রত্যেকটি মিনিট এক-একটি বৎসর। জলদগম্ভীর স্বরে শুধু একটি শব্দ উচ্চারণ করেন মণীন্দ্র–’মা’!
একটি শব্দের মধ্যে কত অজস্র ভাব!
হেমপ্রভা আর নিজেকে সামলাইতে পারেন না। হাউ হাউ করিয়া কাঁদিয়া ওঠেন– আমাকে তুই সাজা দে মণি, তোর যা মন চায় সেই শাস্তি দে আমাকে, মেয়েটাকে কিছু বলিসনি।
–বলবার তো আর কিছু রাখোনি মা, বলবার ভাষাও খুঁজে পাচ্ছি না আমি। মণীন্দ্রর কণ্ঠস্বরে রোষ ক্ষোভ হতাশা নিরুপায়ের বেদনা সব কিছু যেন ভাঙিয়া পড়ে।
–মণি, আমায় তুই মার! মেরে ফেল আমায়
–পাগলামি করো না মা, ঈশ্বর রক্ষা করেছেন যে চিত্রা আসতে চাইল না। কিন্তু এ কি করলে মা? কি করলে? বেবিটাকে মিথ্যে করে দিলে একেবারে? চিরদিনের মত মাটি করে দিলে?