- বইয়ের নামঃ অগ্নিপরীক্ষা
- লেখকের নামঃ আশাপূর্ণা দেবী
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
১. ব্যাপারটা ঘটিয়া গেল
অগ্নিপরীক্ষা – উপন্যাস – আশাপূর্ণা দেবী
ব্যাপারটা ঘটিয়া গেল অবিশ্বাস্য অদ্ভুত।
হেমপ্রভা নিজেও ঠিক এতটা কল্পনা করেন নাই, কিন্তু ঘটিল। পাড়ার গৃহিণীরা বলিতে লাগিলেন–”ভগবানের খেলা”, “ভবিতব্য”! ভট্টাচার্য মহাশয় ভীত চিন্তিত হেমপ্রভাকে আশ্বাস আর অভয় দিয়া বলিলেন–বিধাতার নির্দিষ্ট বিধান! আমরা তো নিমিত্ত মাত্র মা!
কিন্তু এতখানি সারালো তত্ত্বকথার ভরসা সত্ত্বেও কোন ভরসা খুঁজিয়া পান না হেমপ্রভা। ছেলেকে গিয়া মুখ দেখাইবেন কোন্ মুখে? শুধুই কি ছেলে? তার উপরওয়ালা? মণীন্দ্র যদি বা কোনদিন মাকে ক্ষমা করিতে পারে, চিত্রলেখা কি কখনও শাশুড়ীকে ক্ষমা করিবে?
.
গোড়ার কথা এই–
ছেলে বৌ নাতি-নাতনীদের লইয়া একবার দেশের জমিদারিতে যাইবার শখ হেমপ্রভার অনেকদিনের, কিন্তু সাহেব ছেলের ইচ্ছা যদি বা কখনো হয়–ফুরসৎ আর হয় না, এবং সাহেব স্বামীর যোগ্য সহধর্মিণী চিত্রলেখার ইচ্ছা-ফুরসৎ কোনটাই হইয়া ওঠে না। বছরের পর বছর ঘুরিতে থাকে, মণীন্দ্র পূজার ছুটিতে পশ্চিম আর গ্রীষ্মের বন্ধে উত্তরে বেড়াইতে যান, হেমপ্রভার প্রস্তাবটা মুলতুবীই থাকে।
আসল কথা–বিষয়সম্পত্তি বা জমিদারি নামক বস্তুটার উপর কেমন একটা বিদ্বেষ ভাব ছিল মণীন্দ্রর, দেখাশোনা করা তো দূরের কথা, মায়ের খাতিরে একবার বেড়াইতে যাইতেও যেন রুচি হয় না। গুরুজনের সম্বন্ধে–তবু মণীন্দ্রর স্ত্রৈণ পিতা যে যথাসর্বস্ব স্ত্রীর নামে উৎসর্গ করিয়া দিয়া মণীন্দ্রকে মা’র মুখাপেক্ষী করিয়া রাখিয়া গিয়াছেন, এই অন্যায় ব্যাপারটা আর কিছুতেই . বরদাস্ত করিয়া উঠিতে পারেন না মণীন্দ্র, বিষয়ের সমস্ত উপস্বত্বটা নিজের সংসারে ব্যয় হওয়া। সত্ত্বেও নয়।
বাপের জমিদারির টাকা লইতে গেলে মায়ের সই লওয়া ছাড়া উপায় থাকে না এটা তো শুধু বিরক্তিকরই নয়, অপমানকরও বটে। অবশ্য বাপের বিষয়ের সুবিধাটুকু না থাকিলে যে দিন চলা ভার হইত এমন নয়, নিজের উপার্জনে যথেষ্ট ভদ্রভাবেই চলিয়া যায়, কিন্তু হেমপ্রভারই বা জগতে আছে কে? ‘মা’র টাকা লইব না বলিলে যে রীতিমত ঝগড়ার কথা হয়। কাজেই জীবনযাত্রার মানদণ্ড শুধু ভদ্রভাবে কাটানো’র অনেক ঊর্ধ্বেই উঠিয়া আছে। বিলাসিতার তো আর সীমারেখা নাই!
তাছাড়া চিত্রলেখা যা বলে সেটাও তো মিথ্যা নয়। জমিদারিটা মণীন্দ্রর বাপের জিনিস, তাতে তো আর ভুল নাই! কাজেই টাকাটা খরচ করিতে বিবেকে তেমন বাধে না, কিন্তু তদারক-তল্লাস করিতে রুচিতে বাধে।
হেমপ্রভাই বছরে তিনবার ছুটাছুটি করেন। বরাবরের জন্য যে দেশের বাড়িতে বাস করিতে পারেন না, সেটা শুধু নাতি-পুতির মমতাতেই নয়, ম্যালেরিয়া দেবীর নির্মমতার জন্যও বটে। যাই হোক, এবার গ্রীষ্মের বন্ধে অনেক দিনের সাধটা মিটিল হেমপ্রভার। জেদ ধরিল–চিত্ৰলেখারই ছেলেমেয়ে।
গ্রীষ্মের বন্ধের পূর্ব হইতেই তাহারা জোর গলায় বলিয়া বেড়াইতে লাগিল–আমরা এবার দেশে যাব।
চিত্রলেখা বিরক্ত হইয়া বলে–তা আর নয়? “দেশে যাব!” এই প্রচণ্ড গরমে দেশে গিয়ে মারা পড়া চাই যে!
যদিও মেয়ে তাপসীই বড়, তবু যুক্তি-তর্কের ধার অমিতাভর বেশী। সে বয়স ছাড়া বিজ্ঞ ভাব দেখাইয়া বলে–দেশে গিয়ে মারা পড়ব মানে কি? নানি’ যে প্রত্যেক বছর যান, কই মারা পড়েন না তো?
‘ঠাকুমা’ শব্দটি নেহাৎ সেকেলে বলিয়া চিত্রলেখা ‘নানি’ শব্দটা আবিষ্কার করিয়াছিল। …ছেলের এই ভেঁপোমিতে জ্বলিয়া উঠিয়া চিত্রলেখা বলে–ওঁর যা সয়, তোমাদের তা সইবে? উনি যে এই গরমে গিয়ে কতকগুলো আম কাঁঠাল খেয়ে দিব্যি হজম করেন, তোমরা পারবে তা?
–পারবই তো! অমিতাভর ছোট সিদ্ধার্থ সোৎসাহে বলে–আম খেতেই যাব যে আমরা। নানি বলেছেন আমাদের নিজেদের বাগান আছে, অনেক অনেক গাছ। দাদু মানে বাবার বাবা, নিজে হাতে করে কত গাছ পুঁতেছেন–দেখব না বুঝি? বা!
চিত্রলেখার বুঝিতে বাকি রহিল না হেমপ্রভা এবার চালাকি খেলিয়াছেন। এইসব সরলমতি বালক-বালিকারা যে নানি’র কুমন্ত্রণার প্রভাবেই বিপথগামী হইতে বসিয়াছে, এ বিষয়ে আর সন্দেহমাত্র থাকে না চিত্রলেখার।
রাগে সর্বাঙ্গ জ্বালা করে তার, চড়া গলায় ঝজিয়া বলে–আমি বলে দিচ্ছি এ সময় যাওয়া হতে পারে না কিছুতেই না। ব্যস্–এ বিষয়ে আর কোনো আলোচনা যেন ওঠে না কোনদিন।
এবার সুর ধরে তাপসী, মেয়েলী আবদারের সুরে বলে–বা-রে, আমরা বলে সব ঠিক করে ফেলেছি
–সব ঠিক করে ফেলেছ? চমৎকার! কিন্তু আমি জানতে চাই এ বাড়ীর কত্রী কে? তোমরা আমি?
তাপসী ভয় খাইয়া চুপ করিয়া যায়, কিন্তু অমিতাভ তাহার বদলে চটপট উত্তর দেয়–তাই বলে বুঝি আমরা নিজের ইচ্ছেয় কিছু করতে পাব না? দেশ-টেশ চিনতে হবে না আমাকে?
–কেন, চিনে কি স্বর্গের সিঁড়ি তৈরি হবে শুনি?
–স্বর্গের সিঁড়ি আবার কি, নানি বুড়ো হয়ে যাচ্ছেন না? আমাকেই এরপর খাজনা-টাজনা। আদায় করতে হবে তো? প্রজারা আমাকে ‘বাবুমশাই’ বলবে দেখো তখন!
চিত্রলেখার রাগে আর বাক্যস্ফূর্তি হয় না। শাশুড়ীর কুটিল চাল দেখিয়া স্তম্ভিত হইয়া যায় বেচারা। এমনিতেই তো তার বরাবর সন্দেহ, শাশুড়ী ছেলেমেয়েগুলি পর করিয়া লইতেছেন। আধুনিকার রঙিন খোলস খুলিয়া ঈর্ষার চেহারা অনেক ক্ষেত্রেই ধরা পড়ে, কিন্তু এবার যে হেমপ্রভা চিত্রলেখার কল্পনার উপরে উঠিয়াছেন! ছেলেদের মন ভাঙাইবার জন্য আরও কি কি লোভনীয় দৃশ্যের অবতারণা করিয়াছেন তিনি, সেটা আর শুনিবার ধৈর্য থাকে না।