ভাগ্যবশত সেবার মুহাম্মদ মুস্তফাকে পড়াশুনা বন্ধ করতে হয় নি; বৃত্তির কর্তৃপক্ষ নামে ভুল করেছিল।
সহসা তীরের দিকে তাকিয়ে দারোগা বলে, এই যে, কুমুরডাঙ্গা এসে পড়েছে।
ঈষৎ ঔৎসুক্যের সঙ্গে মুহাম্মদ মুস্তফা দারোগার দৃষ্টি অনুসরণ করে তীরের দিকে তাকায়, কিন্তু কোথাও কোনো শহরের চিহ্ন দেখতে পায় না।
ঝাউগাছটি দেখতে পাচ্ছেন? খোলা দরজা দিয়ে হাত প্রসারিত করে দারোগা। জিজ্ঞাসা করে। ঝাউগাছটি কুমুরডাঙ্গার নিশানা। তারপর একটি বাঁক, বাঁকের পাশে কুমুরডাঙ্গা।
যথাসময়ে একটি বাঁক পেরিয়ে স্টিমার কুমুরডাঙ্গার নিকটবর্তী হয়। তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। নদীর তীরে যে-স্টিমারঘাটটি সহসা দৃশ্যমান হয়, সে-ঘাট দিনান্তের ধূসর আলোয় বিষণ্ণ, একটু নিঃসঙ্গ দেখায়।
তবারক ভুইঞা (সে যে তবারক ভুইঞা সে-বিষয়ে সন্দেহের কোনোই কারণ দেখতে পাই না) বলছিল : যেদিন স্টিমার-চলাচল বন্ধ হয় সেদিন স্টিমারঘাটের ফ্ল্যাটের ওপর-তলায় নদীর ধারে তার ছোট আপিস-ঘরে স্টেশনমাস্টার খতিব মিঞা স্তব্ধ হয়ে বসে ছিল, মুখে দুশ্চিন্তার রেখা। এ-সময়ে সূর্যের আলো নদীর পানি থেকে আপিস-ঘরের ছাদে প্রতিফলিত হয়ে নিঃশব্দে নৃত্য করে; তারই ছিটেফোঁটা তার মুখে। বস্তুত সে-আলোর ঝলকানি তার মুখের দুশ্চিন্তার রেখাগুলি নিয়ে নির্মমভাবে খেলা করে যেন।
ঘন্টাখানেক আগে কোম্পানির সদর দফতর থেকে যে-সংক্ষিপ্ত তার এসে পৌঁছেছে, সে-তারের সংবাদ অপ্রকাশিত না-হলেও তা স্টেশনমাস্টার খতিব মিঞাকে কেমন বিচলিত করে ফেলেছে। সংবাদটি এই যে, স্টিমার আসবে না। কেন আসবে না-তার কোনো উল্লেখ নেই সে-সংক্ষিপ্ত তারে।
স্টিমার আসবে না-সে-কথাই স্টেশনমাষ্টার বার বার ভাবে : নিত্য একবার উজানে একবার ভাটিতে দু-দুবার ঘাটে জীবন-স্পন্দন জাগিয়ে অব্যর্থভাবে যে-স্টিমার এসেছে সে-স্টিমার আসবে না। সুগম্ভীর সুরে বাঁশি বাজিয়ে দূরত্বের বিচিত্র আবহাওয়া সৃষ্টি করে স্টিমারের আগমন, ঢেউ-এর উচ্ছল নৃত্য, যাত্রীদের ব্যস্ত ওঠা-নাবা, লস্করদের কর্মতৎপরতা, অবশেষে স্টিমারের প্রস্থানের পর আকস্মিক নীরবতা, আরো পরে উল্টো পথের স্টিমারের জন্যে প্রতীক্ষা-এ-সব দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতার পর নিতান্ত গতানুগতিক মনে হলেও খতিব মিঞার জন্যে একটি সত্যের পুনরোচ্চারণের মতোই: সে ঘাটের স্টেশনমাস্টার। তাছাড়া মানুষ জীবনের যে-ছন্দ শ্বসনের মতো স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করে নেয় তাতে অকস্মাৎ বাধা পড়লে নিরাপত্তার শত আশ্বাস সত্ত্বেও তার মনের অতলে লুক্কায়িত যে-শঙ্কাভীতি চিরজাগ্রত, সে-শঙ্কাভীতি অকারণেই মাথা নাড়া দিয়ে ওঠে অস্বাভাবিক কোনো আওয়াজে বিবরবাসী জীব যেন সভয়ে আত্মপ্রকাশ করে।
খতিব মিঞা নিজেকে কিছু সংযত করে। তবু অনভিজ্ঞ শিক্ষানবিশীর মতো অসহায় বোধ না করে পারে না। সে বুঝতে পারে না কী করবে : সহসা যেন কিছু করার নেই। কবর কীই-বা রয়েছে? একটু আগে একবার নিচে গিয়েছিল। তখন সে অল্পবয়স্ক টিকিটকেরানিকে নোটিশ টাঙিয়ে দিতে বলেছে, অধিকাংশ যাত্রী নিরক্ষর হলেও লিখিত নোটিশ জারি করা একটি অলঙ্ঘনীয় আইন। তারপর অনির্দিষ্টভাবে নিচে কিছু ঘোরাঘুরি করে ওপরে উঠে এসেছে। আসবার সময় কী কারণে যাত্রীদের কথা নয়, মালঘরে স্তূপাকার করে রাখা চালানি কলার কথাই একবার তার মনে পড়েছিল। কুমুরডাঙ্গা থেকে রাশি-রাশি কলা চালান যায়, যার জন্যে মাল-ঘরে সে-ফলের গন্ধ ভারি হয়ে থাকে সর্বক্ষণ, নদী থেকে অনবরত ভেসে-আসা হাওয়ায়ও তা দূর হয় না। খতিব মিঞা মনে-মনে বলেছিল, কলাগুলো পচবে। তারপর সিঁড়িতে পা দিয়ে ইতিমধ্যে সমাগত কয়েকজন নিম্নশ্রেণীর যাত্রীদের প্রতি একবার দৃষ্টি দিয়েছিল, তবে তাদের ঠিক দেখতে পায় নি। হয়তো কেবল তার মনে হয়েছিল, যাত্রীরা আজ বেশ সকালে-সকালেই এসে পড়েছে। কোনো কোনোদিন তারা অসময়েই ঘাটে উপস্থিত হয়। অধিকাংশ লোক ঘড়ি দেখে স্টিমার ধরতে আসে না, মেঘশূন্য দিনে আকারে সূর্যের দিকে চেয়ে সময় নির্ণয় করে এবং ঝড়বাদলের দিনে সময়-আন্দাজ করে ঘাট অভিমুখে রওনা হয়। তবে সময়ের বিষয়ে কখনো নিশ্চিত হতে পারে না বলে বা যাত্রায় একবার মনস্থির করে ফেলার পর আর দেরি সয় না বলে আগে-ভাগেই এসে পড়ে। তাছাড়া শহরের বাইরে থেকে এ-গ্রাম সে-গ্রাম থেকে হেঁটে গরুগাড়ি করে নৌকায় নদী পাড়ি দিয়ে যারা আসে তারাও অসময়ে ঘাটে এসে উপস্থিত হয়। তারা যে এসে পড়েছে সে-কথা মাল-ঘরে বা ওপরের আপিস-ঘরে থাকলেও খতিব মিঞা বুঝতে পারে, কারণ নিত্য একইভাবে ঘাটে তাদের আগমন ঘোষিত হয় : সম্পূর্ণ নীরবতার মধ্যে হঠাৎ আতসবাজির মতো আকস্মিক হাঁক-ডাক শোনা যায়, যে-হাঁক-ডাক পরে একটি অস্পষ্ট গুনে, আরো পরে একটি অবিচ্ছিন্ন কোলাহলে পরিণত হয়। তবে সে কেবল প্রথম হাঁক-ডাকটাই শোনে, এবং তখন চমকিত হয়ে পকেট থেকে জেবঘড়ি বের করে সময়টা যাচাই করে নেয়, কিন্তু পরে যাত্রীদের কোলাহল আর তার গোচর হয় না : দূর থেকে শোনা স্টিমারের বংশীধ্বনি বা স্টিমার কাছে এলে তার পাখার আঘাতে নির্মমভাবে আন্দোলিত মথিত পানির আর্তনাদের মতোই যাত্রীদের কোলাহল ঘাটের অন্যতম সুপরিচিত আওয়াজ মাত্র।