তবে একটি কথায় বড়ই বিস্মিত হই। সেটি এই যে, খোদেজা তার জন্যে আত্মহত্যা করেছে-বাড়ির লোকেদের এই ভিত্তিহীন অমূলক ধারণাটি কী করে মুহাম্মদ মুস্তফা বিশ্বাস করে নিয়েছে। কিন্তু কেন বিস্মিত হয়েছিলাম? সে কি সব কথাই নির্বিবাদে মেনে নেয় না? সে যে তা অস্বীকার করার চেষ্টা করেছিল, তাই কি অস্বাভাবিক নয়? কে জানে, খোদেজা তার জন্যে আত্মহত্যা করেছে-এমন কথা সে বিশ্বাস করে তা আমার পছন্দ হয় নি।
আমি বিস্মিত হয়েছিলাম, অসন্তুষ্ট হয়েছিলাম, তবে প্রথমে মুহাম্মদ মুস্তফার মনের অবস্থাটা ঠিক বুঝতে পারি নিঃ কারো চিন্তাধারা কোনো বিশেষ সীমানা অতিক্রম করে গেলে সে কীভাবে কেন ভাবে-এ-সব বোঝা দুষ্কর। আমি অনেক কথাই বুঝতে পারি নি। এ-কথাও বুঝতে পারি নি যে আমিই তাকে রক্ষা করতে পারব-এই বিশ্বাসে মরিয়া হয়ে সে আমার কাছে এসে উপস্থিত হয়েছে।
আমার অবিশ্বাস্য মনে হলেও সে সত্যিই আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছিল। এমন একটি নিদারুণ কাজ করতে বসেছিল তা নিজেই উপলব্ধি করলে সে ভয়ানকভাবে বিচলিত হয়ে পড়ে, এ-ও পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারে যে তার মধ্যে সাংঘাতিক কিছু না-ঘটলে এমন একটি কাজ করার কথা ভাবতেও পারত না। কিন্তু তার মানসিক বিভ্রান্তি যদি ঘটে থাকে তার কারণ কী? সে কেবল একটি উত্তরই খুঁজে পায়। তার মনে হয় যে-মেয়েটি আত্মহত্যা করে একটি প্রতিহিংসাপরায়ণ আত্মায় পরিণত হয়েছে, তাকে ছায়ার মতো অনুসরণ করতে শুরু করছে, সে-ই দায়ী তার বিভ্রান্তির জন্যে, সে ই তাকে মৃত্যুর দ্বারে নিয়ে গিয়েছিল; তার কার্যকলাপ আর তার ক্ষমতার অধীন নয়, মেয়েটির আত্মা তার মন দখল করে তার ইচ্ছাশক্তি কাবু করে ফেলেছে, তাকে পরিচালিত করেছে নির্দয় ধ্বংসকারিণীর রূপ নিয়ে। চমকিত হয়ে সে এবার অনেক কিছুর মধ্যে গুঢ় অর্থ দেখতে পায়। যে-দিন বিয়ে করার উদ্দেশ্যে কুমুরডাঙ্গা থেকে স্টিমারযোগে ঢাকা অভিমুখে রওনা হবে সে-দিনই কেন স্টিমার-চলাচল বন্ধ হবে, পরদিন কি বন্ধ হতে পারত না? তারপর সহসা তার জ্বরে পড়া, আরোগ্যলাভ করেও ঢাকা যাওয়ার বিষয়ে গড়িমিসি বা হচ্ছে-হবে ভাব, পরে তসলিমের চিঠি বা তারের জবাব না দেয়া। এ-সবের পশ্চাতে সেই প্রতিহিংসাপরায়ণ আত্মার ইচ্ছাই নিহিত : তার মনে হয় এ-সবের অন্য কোনো ব্যাখ্যা সম্ভব নয়। যে-মেয়ে মৃত্যুর পর অবিমিশ্র জিঘাংসায় পরিণত হয়েছে, তার ক্ষমতা দেখে মুহাম্মদ মুস্তফা এবার অতিশয় ভীত হয়ে পড়ে। হয়তো এ-সময়ে সে কিছু সম্বিৎ ফিরে পায়, একটু সুস্থিরভাবে ভাবতে সক্ষম হয়। সে বুঝতে পারে তাকে কিছু করতেই হবে, যে করে হোক নিজেকে বাঁচাতে হবে। সহসা তার মনে হয়, আমার সঙ্গে দেখা করা একান্ত প্রয়োজন। আমি কী ভাবি? আমিও কি বিশ্বাস করি খোদেজা আত্মহত্যা করেছিল? আমাকে কথাটা আগে জিজ্ঞাসা করে নি, জিজ্ঞাসা করার প্রয়োজনও বোধ করে নি। হয়তো আমি জানি তা সত্য নয়। এবং আমি যদি বলি তা সত্য নয়, বাড়ির লোকেদের ধারণাটির পশ্চাতে উদ্ভট কল্পনা ছাড়া আর কিছু নেই, তবেই খোদেজার নামে কী-একটা দুরাত্মা যে তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে, তাকে কী একটা অতল গহ্বরের দিকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে-তার হাত থেকে মুক্তি পাবে।
আমাকে এই কথা জিজ্ঞাসা করার জন্যেই সে এমনভাবে কুমুরডাঙ্গা ছেড়ে বাড়িতে এসে হাজির হয়েছিল।
তবে আমার যেন কী হয়েছিল, সত্য উত্তর মুখে এসেও মুখেই থেমে গিয়েছিল। কেবল বলেছিলাম,
কী করে বলি? আমি তখন বাড়ি ছিলাম না।
এমনভাবেই উত্তরটি দিয়েছিলাম যেন খোদেজা আত্মহত্যা করেছে তা আমি নিশ্চিতভাবে জানি, কিন্তু তা মুখ ফুটে বলা সম্ভব নয়।
কেন সত্য কথাটি বলিনি, যা একেবারে ভিত্তিহীন বলে জানতাম বা ভিত্তিহীন বলে দ্বিধাশূন্য কণ্ঠে ঘোষণা করিনি কেন? আমার মনেও কি অবশেষে সন্দেহ দেখা দিয়েছিল? না, সন্দেহ নয়, মনে সহসা মুহাম্মদ মুস্তফার প্রতি ভয়ানক ক্রোধ বোধ করেছিলাম; তার প্রতি কখনো এমন ক্রোধ বোধ করি নি। ক্রোধ বোধ করেছিলাম এই দেখে যে খোদেজা আত্মহত্যা করেছে তেমন একটা বিশ্বাস হলেও মুহাম্মদ মুস্তফার মনে একটু অনুতাপ নয়, মৃত মেয়েটির প্রতি ঈষৎ স্নেহমমতা নয়, সামান্য বিয়োগশোক নয়, নিদারুণ ভীতিই দেখা দিয়েছে। হয়তো তাও সহ্য হত যদি সরলা নিষ্পাপ খোদেজা তার চোখে একটি প্রতিহিংসাপরায়ণ দুষ্ট আত্মায় পরিণত না হত। তা কিছুতেই সহ্য হয় নি। বোধ হয় সেজন্যেই সত্য কথা বলা সম্ভব হয় নি।
তবু বলতাম যদি জানতাম সত্য কথা না বললে কী পরিণতি হবে, যদি বুঝতাম ইতিমধ্যে মুহাম্মদ মুস্তফা একটি অতল গহ্বরের প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে : যারা তেমন একটি গহ্বর থেকে বহুদূরে তারা তার অস্তিত্বের কথা ভাবতেও পারে না।
পরদিন তখনো সূর্য ওঠেনি, এমন সময়ে মুহাম্মদ মুস্তফার মা আমেনা খাতুনের মর্মান্তিক আর্তনাদ শুনতে পাই। তেমন একটি আর্তনাদ শুনেছিলাম বেশ কয়েক বছর আগে, চাঁদবরণ ঘাটে সেদিনও আমেনা খাতুনই আর্তনাদ করে উঠেছিল। আর্তনাদ শোনামাত্র বুঝতে পারি। তবে তখন আর করার কিছু ছিল না; কেউ আর কিছু করতে পারত না।
যখন বাড়ির পশ্চাতে উপস্থিত হই তখন দেখতে পাই, যে তেঁতুলগাছের তলে বাল্যবয়সে একটি অদৃশ্য সীমারেখা পেরিয়ে গিয়েছিল সে গাছ থেকে মুহাম্মদ মুস্তফার নিষ্প্রাণ দেহ ঝুলছে, চোখ খোলা। সে চোখ শ্যাওলা-আবৃত ডোবার মতো ক্ষুদ্র পুকুরে কী যেন সন্ধান করছে।