কোম্পানির বাড়ি ছাড়ার পর কোথায় যাবেন?
খতিব মিঞা এ-পর্যন্ত সে-বিষয়ে একবারও ভাবে নি। কিছু অপ্রস্তুত হয়ে উত্তর দেয়, একটা ছোটখাটো বাড়ি ভাড়া করে নেব। বাড়ি তোলা পর্যন্ত–
মেঝের দিকে কয়েক মুহূর্ত স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে ছলিম মিঞা সহসা মুখ তোলে, যেন কোনো ব্যাপারে সে একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
মনের মতো ভাড়াটে বাড়ি যতদিন না পান ততদিন আমার ওখানেই থাকবেন। দুটিমাত্র প্রাণী, ছেলেপুলে নেই। আপনাদের কোনো তকলিফ হবে না।
অল্প সময়ের জন্যে অবসরপ্রাপ্ত স্টেশনমাস্টার খতিব মিঞা বাক্যহারা হয়ে পড়ে, তারপর তার চোখের প্রান্তে হয়তো অশ্রুর আভাস দেখা দেয় বলে সেখানে ঈষৎ উজ্জ্বল কিছু নজরে পড়ে। পরে একটু ভাঙ্গা গলায় উত্তর দেয়, তা আপনার ওখানেই থাকব। এবার তার চোখের পানি পরিষ্কারভাবে দেখা যায়।
শুধু খতিব মিঞার নয়, শহরের অনেক লোকের চোখ সেদিন অশ্রুসজল হয়ে ওঠে, কারণ খতিব মিঞা কুমুরডাঙ্গা সম্বন্ধে তার মাটি সম্বন্ধে যে-সব কথা বলে বেড়ায় তা অবিলম্বে সকলের কর্ণগোচর হয়; কুমুরডাঙ্গা সম্বন্ধে এমন সব কথা কেউ কখনো বলে নি। সহসা সেদিন থেকে সকলের মধ্যে নূতনভাবে জীবনসঞ্চার হয়, নৈরাশ্য নিরানন্দভাব দূর হয়।
দূরে রাতের অন্ধকারে সহসা ঘাটের আলো জেগে ওঠে : অনেক নদনদী অতিক্রম করে এ-ঘাট সে-ঘাটে থেমে যে-স্টিমারটি সেই সকাল থেকে চলছে তার চলা শেষ হতে আর দেরি নেই। ঘাটে আলো দেখে যাত্রীরা হঠাৎ চঞ্চল হয়ে ওঠে, যেমন অন্ধকারাচ্ছন্ন কারগারে অকস্মাৎ আলোকরশ্মি এসে পড়লে দরজা খুলে গিয়েছে বুঝে কয়েদিরা চঞ্চল হয়ে ওঠে। নিমেষের মধ্যে তাদের কণ্ঠস্বরে স্টিমারের এ-মাথা থেকে ও-মাথা মুখরিত হয়ে পড়ে, ব্যস্তসমস্ত হয়ে তারা স্থলে অবতরণ করার জন্যে তৈরি হয়। এবার তবারক ভুইঞা থামে, তারপর তার সামান্য তল্পিতল্পা গুছিয়ে নেবার জন্যে উদ্যত হয়।
আমি একটু নিরাশ হয়ে ভাবি : তবে মুহাম্মদ মুস্তফার নামটি একবারও উল্লেখ না করে তবারক ভুইঞা চলে যাবে। তার সঙ্গে হয়তো আবার কখনো দেখা হবে না; যে ঘাটে আমরা দুজনেই নাবব সে-ঘাটে শুধু মাত্র একটি দিন কাটিয়ে পরদিনই আমার ফিরে যাবার কথা।
মুহাম্মদ মুস্তফার বিষয়ে তার এই মৌনতার কারণ কী? কুমুরডাঙ্গা নামক শহরের যে বিচিত্র কাহিনী সে আমাদের বলে শুনিয়েছে তার সঙ্গে হয়তো মুহাম্মদ মুস্তফার কোনো যোগাযোগ ছিল না, তবু কোনোপ্রকারে তার নামটি কি একবার মুখে নিতে পারত না? সে কি তার কথা ভুলে গিয়েছে, না কোনো কারণে অসংখ্য লোকের নাম ধাম-বৃত্তান্তে পরিপূর্ণ স্মৃতিপটেও তাকে স্থান দেয় নি? ইচ্ছা হয় সরাসরি জিজ্ঞাসা করি। মুহাম্মদ মুস্তফার কথা তার মনে পড়ে কিনা, পড়লে কুমুরডাঙ্গা ছেড়ে যাবার পর তার কী হয়েছিল, সে কী করেছিল-তা জানে কিনা। তবে জিজ্ঞাসা করা হয় না, কারণ মনে হয় মুহাম্মদ মুস্তফার বিষয়ে তার মৌনতা অনিচ্ছাকৃত নয়। সে সব জানে এবং সব জানে বলেই, তার নাম নিতে পারে নি। হয়তো তার কথা সে ভালোভাবে বোঝেও না; মানুষ যা বোঝে না সে-বিষয়ে সে কিছু বলতে চায় না। হয়তো কে জানে, যা ঘটেছিল তার জন্যে সে নিজেকে কোনো প্রকারে দায়ী মনে করে।
মুহাম্মদ মুস্তফা কুমুরডাঙ্গা থেকে ঢাকা যায় নি, তার সুহৃদ বন্ধু তাসলিম বা আশরাফ হোসেন চৌধুরী সাহেবের সঙ্গে দেখা করে নি, সোজা দেশের বাড়িতে উপস্থিত হয়েছিল-চোখে ঘুমাভাবের রুক্ষতা, মুখে কী-একটা উদ্ভ্রান্ত ভাব। বেশভূষায় নূতন হাকিমের কোনো চিহ্ন ছিল না : মাথার চুল উস্কখুস্ক, পরনের লুঙ্গির প্রান্তভাগ কর্দমাক্ত, ছাত্র বয়সে কখনো-কখনো যেমন হাতে জুতা নিয়ে বাড়িতে উপস্থিত হত তেমনি হাতে একজোড়া নূতন জুতা। চেহারা দেখেই বুঝেছিলাম কিছু একটা হয়েছে। মা-জান পরে বলেছিল, সে যখন সন্ধ্যার কিছু আগে নিঃশব্দে উঠানের প্রান্তে দেখা দেয় তখন কী কারণে বুকটা ছাঁৎ করে উঠেছিল। তবে আমার বা বাড়ির অন্য কারো সাহসে কুলায় নি জিজ্ঞাসা করি তার কী হয়েছে, কেন এমন চেহারা নিয়ে বাড়ি ফিরেছে। তার মা আমেনা খাতুন সে-রাতেই তার জন্যে ভাপা পিঠা বানাতে বসে। তবে হাতে কেমন জড়তা বোধ করেছিল বলে সেবার তা তেমন মুখরোচক হয় নি।
আমি ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করি। জানতাম, মুহাম্মদ মুস্তফা নিজে থেকে না বললে তার কাছ থেকে কিছু জানতে পারা সহজ নয়। এ-ও জানতাম, বলবার কিছু থাকলে বা বলবার ইচ্ছা হলে এক সময়ে আমাকেই বলবে।
হয়তো দ্বিতীয় দিন সে বলে। বলে ধীরে-ধীরে, একটু-একটু করে, এমনভাবে যেন অন্য কোনো মানুষের কথা বলছে, বা যা-বলছে তা নিজের কাছেই অসম্ভব মনে হয়। সে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছিল তা সুস্পষ্টভাবে বলতে পারে নি। প্রথমে আমাকে আন্দাজ-অনুমান করতে হবে, পরে খণ্ড-খণ্ড কথা একত্র করে অত্যাশ্চর্য কথাটি বুঝতে সক্ষম হই। তবে তা সত্য মনে হয় নি, নিদারুণ ভীতির জন্যে কাজটি করতে পারে নি তাও বিশ্বাস করি নি; মূল কথায় বিশ্বাস না হলে আনুষঙ্গিক কথায় কি বিশ্বাস হয়? হয়তো-বা আমার মনে হয়, সে যদি আত্মহত্যার চেষ্টা করেও থাকে তাহলেও গোড়া থেকেই জানত শেষপর্যন্ত তাতে সফল হবে না কারণ তার উদ্দেশ্য ছিল যে-কাল্পনিক প্রতিহিংসাপরায়ণ আত্মা তাকে ভীতিবিহ্বল করে তুলেছিল তাকেই ফাঁকি দেয়া : ফাঁকি দেয়া কিছুতেই সম্ভব নয় জেনেও কোনোপ্রকারে ফাঁকি দিতে সক্ষম হবে-এমন একটা আশা মানুষ কখনো ছাড়তে পারে না!