স্টিমারের আগমন নিরীহ আমোদ-উল্লাসের মধ্যে দিয়ে নিরুদ্ৰবেই কাটত যদি কোম্পানির কর্তৃপক্ষ স্থানীয় নেতৃবৃন্দের স্টিমারের ডেক-এ চা-পানের দাওয়াতে মেহমানদের তালিকায় হিন্দু জমিদারবাবুর নাম অন্তর্ভুক্ত করতে ভুলে না যেত। ভুলটা হয়তো এই কারণেই ঘটেছিল যে সমগ্র অঞ্চলে অশেষ প্রতাপ-প্রতিপত্তি রাখলেও জমিদারবাবুর বাসস্থান ছিল শহর থেকে বেশ কয়েক ক্রোশ দূরে। তাছাড়া জমিদারবাবু কদাচিই তার বাসস্থান থাকত; শস্যসংগ্রহকাল ছাড়া বা অপ্রত্যাশিতভাবে কোনো বৈষয়িক ব্যাপারে দেশের বাড়িতে ডাক না পড়লে অধিকাংশ সময়ে শৌখিনহালে কলকাতার নেশায় মৌজ হয়ে সে-বৃহৎ শহরেই দিন কাটাত। ঘাট খোলর পূর্ব রাতে সে যে আচমকা দেশের বাড়িতে ফিরে এসেছে তা কেউ জানতে পায় নি।
দাওয়াত নেই দেখে জমিদারবাবু গভীরভাবে অপমানিত বোধ করে। তখন বঙ্গভঙ্গের আন্দোলনের জন্যে ইংরেজ এবং হিন্দুদের মধ্যে প্রচণ্ড মনোমালিন্যের ভাব বলে তার ধারণা হয়, কোম্পানির ইংরেজ কর্তৃপক্ষ ইচ্ছা করেই মেহমানদের তালিকা থেকে তাকে বাদ দিয়েছে। জমিদারবাবু তাগড়া-তাগড়া চেহারার বেহারি লাঠিয়াল পুষত। নির্ভেজাল খাঁটি দুধ-ঘি খেয়ে কুস্তি-বৈঠক-মল্লযুদ্ধ করে অন্য সময়ে নিষ্কর্মা আলস্যে নাকে তেল দিয়ে ঘুমিয়ে তারা তৃপ্ত বোধ করত না, একটু দাঙ্গা-হাঙ্গামা মারপিটের জন্য তাদের হাত সর্বদা নিশপিশ করত। জমিদারবাবু তাদেরই পাঠিয়ে দেয় কুমুরডাঙ্গার ঘাটে, ডাণ্ডাবাজির গন্ধ পেয়ে তারাও তিনলাফে যথাস্থানে উপস্থিত হয়। স্টিমার আসে, পুলিশের বাদ্যকদল রণবাদ্য শুরু করে, ঘাটে সমবেত জনতার মধ্যে ভয়শ্রদ্ধামিশ্রিত গভীর স্তব্ধতা নাবে। সমস্ত কিছু ঠিকভাবে চলছে এমন সময় রণবাদ্যে বিভিন্ন সুর ঢুকিয়ে জমিদারবাবুর লাঠিয়ালরা রৈরৈ আওয়াজ তুলে স্টিমারে ওঠার সুসজ্জিত পুলের ওপর দিয়ে স্টিমারে চড়ে তার ধ্বংসকার্যে লিপ্ত হয়। পুলিশ আসার আগেই স্টিমারের আসবাবপত্র জানলা-দরজা ভেঙে-চুরে তারা যে-কাণ্ড করেছিল তার জন্যে স্টিমারটি মাস কয়েক এ-পথে মুখ দেখাতে পারে নি।
সরকার ঘটনাটির তদন্ত করেছিল এবং লাঠিয়ালদের যথাবিহিত শাস্তি দিয়েছিল। তবে তাদের পশ্চাতে কে ছিল তা অনুমান করা সহজ হলেও সাক্ষীর অভাবে প্রমাণ করা সম্ভব হয় নি; লাঠিয়ালরা জমিদারবাবুর নাম নিতে অস্বীকার করেছিল। একমুখে কেবল বলেছিল, শত-শত দর্শকের মতো তামাশা দেখবার জন্যই তারা কয়েক ক্রোশ পথ ভেঙে স্টিমারঘাটে উপস্থিত হয়েছিল এবং বিচিত্র যন্ত্রদানবটি দেখে উত্তেজনায় সম্বিৎ হারিয়ে কী করেছিল বলতে পারবে না। একজন এ-কথাও বলেছিল যে, পুলিশের বাজনার জন্যে তার মতিভ্রম হয়েছিল; সে-বাজনা শুনে তার সমস্ত শরীরে রক্তস্রোত এমন টগবগ করে উঠেছিল যে সে নিজেকে সামলাতে পারে নি। নিঃসন্দেহে সেদিন জমিদাররা তাদের লাঠিয়ালদের খাঁটি দুধ-ঘিই দিত।
স্টিমারের ওপর আক্রমণের বিষয়ে রিপোর্ট লিখতে গিয়ে কোম্পানি সে-মতটি প্রকাশ করেছিল : কুমুরডাঙ্গার অধিবাসীদের চরিত্রটা অতিশয় হিংস্র প্রকৃতির। হয়তো জমিদারবাবু এবং তার দুর্ধর্ষ লাঠিয়ালরা কোম্পানির নজরে পড়ে নি, বা পড়লেও আসল আসামিকে যখন সরকার পর্যন্ত ধরতে পারে নি, চেলাসমেত তার নামও উহ্য রাখা তারা বুদ্ধিসঙ্গত মনে করে থাকবে; মানহানির আইনের বিষয়ে উচ্চ ব্যবসায়ীরা সদাসতর্ক, যে-সতর্কতার প্রয়োজন গোপন-রিপোর্ট লিখতে বসেও তারা ভোলে না। তাছাড়া, সূর্যালোক থেকে বঞ্চিত এ-সব গুপ্ত মন্তব্য কদাচিৎ সত্যের পথ অনুসরণ করে। মাস কয়েক পরে অনেক গবেষণা-আলোচনার পর কোম্পানি যেদিন কুমুরডাঙ্গা নামক ভয়ানক স্থানে আবার স্টিমার পাঠায় সেদিন সাবধানতার অন্ত থাকে নি। সেদিন স্টিমার অভ্যর্থনার জন্যে তারা কোনো জাকজমক-সমারোহের ব্যবস্থা তো করেই নি, বরঞ্চ পুলিশের এমন কড়াকড়ি করেছিল যে দু-একজন ন্যায্য যাত্রী ছাড়া আর কেউ ঘাটের ত্রিসীমানায় ঘেঁষতে পারে নি। বাদ্যযন্ত্র নিয়ে নয়, সেদিন বন্দুক নিয়েই পুলিশ ঘাটে মোতায়েন ছিল।
আজ সে-জমিদারবাবু নেই তার লাঠিয়ালরাও নেই। লাঠিয়ালদের কেউ কোথাও বেঁচে থাকলেও এতদিনে বার্ধক্যের প্রকোপে লাঠি ছেড়ে ছড়ি ধরে থাকবে। কেবল জমিদারবাবুর আদেশে লাঠিয়ালরা যে-কীর্তি করেছিল সে-কীর্তি কুমুরডাঙ্গার অধিবাসীদের স্মৃতির বুকে বীরত্বের স্বর্ণপদকের মতো উজ্জ্বলভাবে শোভা পায়। তবে সেটি অন্যায়ভাবে আত্মসাৎ করা পদকই বটে।
কুমুরডাঙ্গায় যাবার সময়ে একজন দারোগার মুখে মুহাম্মদ মুস্তফা স্টিমারের ওপর আক্রমণের কাহিনীটা শুনেছিল। সদরে কোনো মামলায় সাক্ষী দিয়ে দারোগাটি কর্মস্থলে ফিরছিল, একই স্টিমারে মুহাম্মদ মুস্তফা কুমুরডাঙ্গার ছোট হাকিমের পদ গ্রহণ করতে যাচ্ছে সে-খবর পেয়ে দারোগাটি অবিলম্বে সালাম জানাবার জন্যে তার নিকট হাজির হয়; কর্মভার নেবার আগে একটি হাকিমের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় করার সুযোগ দারোগাটির কাছে পরম সৌভাগ্যের বিষয় বলে মনে হয়ে থাকবে। তারপর কুমুরডাঙ্গা কী রকম জায়গা তা জানবার জন্যে নূতন হাকিম উদগ্রীব ভেবে সে-শহর সম্বন্ধে নানাপ্রকার ভালো-মন্দ খবরাখবর দিয়ে তাকে যথাসম্ভব ওয়াকিবহাল করার লোভও সম্বরণ করতে পারে নি। সে বলেছিল : কুমুরডাঙ্গা সম্বন্ধে কিছু বলা কি সম্ভব? সে অনেক জায়গা দেখেছে, অনেক ঘাটে পানি খেয়েছে-তার চাকুরিটি অনেক দিনের-কিন্তু কুমুরডাঙ্গার মতো এমন জায়গা বেশি দেখে নি। বহুদিন আগে স্টিমারঘাটের ওপর। আক্রমণের উল্লেখ করে বলেছিল, কুমুরডাঙ্গার লোকেরা এমনই হিংসুটে এবং নীচমনা যে নিজের নাক কেটেও পরের ক্ষতি করতে তারা সদা প্রস্তুত। অবশ্য কুমুরডাঙ্গার অর্থনৈতিক অবস্থাটা ভালো নয়, কিন্তু তার দৃঢ় বিশ্বাস, একটি সমাজে তখনই দারিদ্র দেখা দেয় যখন সে-সমাজে ধর্ম-দুর্বলতা এসে পড়ে; দারিদ্র হল অধার্মিকতার ফল, রাহাজানি খুনখারাবি নারীধর্ষণ এ-সবের মতো দারিদ্রও নৈতিক অবনতির একটি লক্ষণ। এরপর খাকি রঙের পুলিশি পোশাকের আড়াল থেকে দারোগাটির ধর্মপ্রাণ উঁকি মারতে সময় লাগে নি এবং এ-সময়ে তার গোঁফ-কামানো মাথা-মুড়ানো কিন্তু দীর্ঘ দাড়ি-শোভিত মুখাবয়বটিও মুহাম্মদ মুস্তফা প্রথম লক্ষ করে। গভীর দুঃখের সঙ্গে দারোগাটি বলে চলে : সে যদি কুমুরডাঙ্গার নিন্দা করে থাকে তার কারণ সে-শহরের ধর্মাভাব, যে-ধর্মাভাব শুধু জনসাধারণের মধ্যে নয়, শহরের নেতৃস্থানীয় শিক্ষিত এলেমদার লোকেদের মধ্যেও পরিলক্ষিত হয়। বাইরে তারা ধার্মিক, কিন্তু সে-ধার্মিকতা একটি মুখোশ মাত্র। খোদা তাদের যা দিয়েছেন তার জন্যে তারা যখন উচ্চৈঃস্বরে শোকর আদায় করে তখন তাদের কণ্ঠে আন্তরিকতার অভাব স্পষ্টভাবেই ধরা পড়ে যেন খোদার রহমতে তাদের সম্পূর্ণ আস্থা নেই, যেন খোদা ভুল করেই তাদের তার অপার দয়ার পাত্র করেছেন এবং সে-ভুল ভাঙলে আচম্বিতে সে-দয়া থেকে তাদের বঞ্চিত করবেন। তাদের নেতৃত্বের জুমাবারে শহরের মসজিদে এত নামাজির সমাগম হয় যে উঠানেও জায়গা হয় না, ঈদের দিনে ঈদগাহ এমনভাবে লোকে-লোকারণ্য হয়ে পড়ে যে প্রতিবছর ভিড়ের ঠেলায় একটা-দুটো দুর্ঘটনা ঘটেই থাকে। তারপর মিলাদ পড়ানো, শিন্নি-জাকাত দেওয়া, নামাজ কালামের শিক্ষার ব্যবস্থা-কোনোদিকে গাফিলতি দেখা যায় না। তবু সব কিছুর মধ্যে কেমন দ্বিধা-সংশয়, কী-একটা সদাজাগ্রত ভয়। যেন খোদাকে নয় খোদার সৃষ্টিকে তাদের ভয়, দোজখকে নয় নশ্বর জীবনকে তাদের ভয়! নশ্বর জীবনকে যে ভয় করে তার মনে কি শান্তি থাকা সম্ভব? এবং যাদের অন্তরে শান্তি নেই তারা কি ন্যায়জ্ঞান এবং বুদ্ধিবিবেচনার সাথে নিজের বা পরিবারের বা সমাজের জীবন পরিচালিত করতে পারে?