কুমুরডাঙ্গার স্টিমারঘাটের ফ্ল্যাটটি শহরের ছেলেদের জন্যে মস্ত আকর্ষণের বস্তু ছিল। লুকিয়ে-লুকিয়ে তাতে চড়ে আমরা দুঃসাহসের এবং বীরত্বের পরিচয় দিতাম। ধরা পড়লে লস্কর-সর্দার বাদশা মিঞা বাঘের মতো গর্জন করে উঠত যে-গর্জনে বুকের পানি জমে যেত, লোকটি বলে, চোখের কোণে হাসিটায় যেন দূরত্বের অস্পষ্টতা।
লস্কর-সর্দার বাদশা মিঞা শহরে বড় একটা দেখা দিত না। শহরবাসীদের প্রতি তার ছিল নাকউঁচু ভাব। স্টিমারের মতো অত্যাশ্চর্য কলের বস্তুর সে একটি অংশ; তার আত্মগর্ব অযথার্থ মনে হত না। তার শরীরটা ছিল তাগড়া-বলিষ্ঠ, লম্বাতেও কম ছিল না। মুখে ছিল বাহারি ধরনের গোঁফ যা সে তার গর্বিত ব্যক্তিত্বের ঝাণ্ডার মতোই ব্যবহার করত। তার খৈনি খাবার অভ্যাস ছিল। সে যখন কালে-ভদ্রে মুখে খৈনি পুরে অতি ধীরে-ধীরে চোয়াল নেড়ে দৃষ্টি উর্ধে রেখে শহরের পথে দেখা দিত তখন মনে হত হেলাফেলা করবার মতো লোক সে নয়। বস্তুত তার মুখভাব, হাঁটার ভঙ্গি, শরীরের গঠন, খৈনিরসসিঞ্চিত চোয়ালের শ্লথ সঞ্চালন, তার বাহারি গোঁফ- এসব জনসাধারণের মধ্যে অনিচ্ছাকৃত সমীহের ভাবই জাগাত। তবে সমীহটা কিছু ভাঙত যখন সে-কথা বলতে বাধ্য হত, কারণ তার জবানটি ছিল নিতান্ত স্থানীয়। প্রকৃতপক্ষে, নদীর অপর তীরে একটি গ্রামে সে জন্মগ্রহণ করেছিল, এবং কয়েক বছর ধরে স্টিমারঘাটে নোকরি করলেও কখনো স্টিমারে ভ্রমণ করে নি।
স্টিমারঘাটে যে-ফ্ল্যাটের নিচের তলায় লস্কর-সর্দার সপরিবারে বসবাস করত কোম্পানির সম্পত্তির পাহারাদারের অধিকারে এবং যে-ফ্ল্যাট কুমুরডাঙ্গার ছেলেদের নিত্য হাতছানি দিয়ে ডাকত, তাদের কল্পনায় উত্তাল তরঙ্গ সৃষ্টি করত, সেটি আবার তাদের চোখে ডানাকাটা পাখির মতোও ঠেকত। নিঃসন্দেহে সেটি একদিন রীতিমত স্টিমারই ছিল। তখন নিঃসন্দেহে অনেক কিছু তাতে শোভা পেত : ঝকঝকে পাটাতনের ওপর সুদৃশ্য ক্যাবিন-কামরা, ধুঁয়াত্যাগের জন্যে গোলাকার উত্তুঙ্গ চুঙ্গা, দু পাশে মস্ত দুটি পাখা, ছাদে সারেঙ্গের ঘর, বিশাল নদীর বুকে ঢেউ তুলে মাল ও যাত্রী বহন করে দূর-দূর ঘাট-বন্দরে যাতায়াত করবার জন্যে যথাবিধি কলকব্জা-আমূল পরিবর্তনের ফলে যে-সবের আর কোনো চিহ্ন ছিল না। কেবল একটি বসতবাটি সম্পূর্ণরূপে উৎপাটি হলেও মাটিতে যেমন তার ভিতের একটু আভাস-ইঙ্গিত থেকে যায়। তেমনি ফ্ল্যাটটির পূর্ব-চেহারার ঈষৎ আভাস-ইঙ্গিত ধরা পড়ত তীক্ষ্মদৃষ্টি দর্শকের চোখে। কতগুলি অস্পষ্ট রেখা থেকে সে অনুমান করতে পারত কোথায় ক্যাবিন-কামরা ছিল, কোথায় ছিল কলকব্জা যে-সকল কলকব্জা সারেঙ্গের সঙ্কেতে নিমেষে জীবন্ত হয়ে উঠত, কোথা দিয়ে ধুঁয়াত্যাগের চুঙ্গাটি উর্ধ্বগামী হত। অনেকদিন আগে শেষ হয়ে যাওয়া গৌরবময় জীবনের যা তখনো বিদ্যমান ছিল তা তার লৌহনির্মিত চ্যাপ্টা ধরনের তলদেশ এবং তার কাঠামো। তলদেশ অক্ষত ছিল এবং সে-কারণে ভেসে থাকার ক্ষমতা তখনো হারায় নি, কিন্তু তার কাঠামোটিকে যে-ভাবে স্থাবর জীবনের প্রয়োজনানুসারে কামরা কুঠরির নিমিত্তে বাঁশবাখারি টিনকাঠে বা নলখাগড়ার বেড়ার সাহায্যে আবৃত করা হয়েছিল তাতে তার চেহারা অনেকটা গ্রাম্য কুটিরের রূপই গ্রহণ করেছিল; আদি বস্তুটির কঙ্কাল যেন তাচ্ছিল্য এবং অযত্নের সঙ্গে কোনো প্রকারে পুনরাচ্ছাদিত করা হয়েছিল। কেবল একটি কথা অস্বীকার করা যেত না। সমস্ত গতিশক্তি হারিয়ে নিতান্ত স্থবির-অথর্ব হয়ে পড়লেও তখনো তা অকেজো হয়ে পড়ে নি, যাত্রী নিয়ে কোথাও আর না গেলেও তাদের পদস্পর্শ থেকেও বঞ্চিত হয় নি; প্রতিদিন যাত্রারম্ভে বা যাত্রাশেষে তারই বুকে যাত্রীরা কিছু সময়ের জন্যে আশ্রয় গ্রহণ করত। তাছাড়া তার দৌরাত্ম শেষ হয়েছিল, স্বাধীনতা বলশক্তির অবসান ঘটেছিল, যৌবনের রূপছটাও আর ছিল না, কিন্তু নদীর সঙ্গে আজীবনের সম্বন্ধ তখনো ছিন্ন হয় নি, কারণ নদনদী আর পাড়ি না দিলেও তখনো তার চতুষ্পার্শ্বে সে-নদনদীর শাশ্বত ধারা কলতান করত, বহুদিনের সহবাসের কথা স্মরণ করে হয়তো স্নেহভরেই তার অক্ষম দেহটি আলিঙ্গনে বদ্ধ করে রাখত।
ঘাটের কথায় একটি কথা মনে পড়ে গেল, লোকটি একটু থেমে আবার বলে। ঘাটের জন্যেই কুমুরডাঙ্গার অধিবাসীদের একটা দুর্নাম। তারা নাকি অতিশয় হিংস্র প্রকৃতির লোক।
কুমুরডাঙ্গার অধিবাসীরা অতিশয় হিংস্রকৃতির লোক-এই বলে সমগ্র অঞ্চলে যে একটা কুখ্যাতি সে-কুখ্যাতির উৎপত্তি হয় তাদের সম্বন্ধে লিপিবদ্ধ স্টিমার কোম্পানির একটি গুপ্ত মতে যা একদিন কী করে প্রকাশ পেয়ে মুখে-মুখে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল। যে-ঘটনার জন্যে কোম্পানি সমগ্র কুমুরডাঙ্গাকে জড়িয়ে এ-অন্যায্য মতটি লিপিবদ্ধ করেছিল সে-ঘটনাটি ঘটেছিল প্রায় আশি বছর আগে। সেদিনই সে-শহরে সর্বপ্রথম স্টিমারঘাট খোলা হয়েছিল।
ঘাট খোলার উপলক্ষটিকে একটি স্মরণীয় ব্যাপারে পরিণত করার জন্যে কোম্পানি বেশ জাঁকজমক-সমারোহের ব্যবস্থা করেছিল। তখনো ঘাটে ফ্ল্যাটটি বসানো হয় নি, তবে নদীতীরে উঁচু দরওয়াজা তৈরি করে সেটি নানা রঙের কাগজে আবৃত করে পতাকা ঝুলিয়ে শোভিত করেছিল, তারপর জেলা থেকে আমদানি করেছিল পুলিশের বাদ্যদল চমকপ্রদ রণবাদ্যের ঝঙ্কার তুলে শহরবাসীদের আমোদিত করার জন্যে। নির্দিষ্ট দিনে স্টিমার আসার অনেক আগে ঘাট লোকে-লোকারণ্য হয়ে পড়ে। শুধু শহর থেকে নয়, কোম্পানি দশ গ্রামে ঢাক-ঢোল বাজিয়ে ঘাট প্রতিষ্ঠানের খবরটি সাড়ম্বরে প্রচার করেছিল বলে সারা অঞ্চল থেকে মিছিল করে লোকেরা ঘাটে উপস্থিত হয়েছিল তামাশা দেখবার জন্য। দেখতে-না-দেখতে ঘাটের সামনে রীতিমত হাট-বাজারও বসে গিয়েছিল; জনতার সমাগম ব্যবসায়ী মানুষের মনে অবিলম্বে অর্থলিলা জাগায়। বস্তুত সব কিছু মিলে সদ্য-খোলা ঘাটটি একটি বৃহৎ মেলার রূপ ধারণ করে, আনন্দোশ্রু উদ্দীপনা উল্লাস-উত্তেজনায় স্থানটি সরগরম হয়ে ওঠে। বলতে গেলে তখন এ-অঞ্চলে কারো বাষ্পীয় জাহাজের সঙ্গে সাক্ষাৎ পরিচয় ছিল না, মুষ্টিমেয় যারা অত্যাশ্চর্য বস্তুটিকে সচক্ষে দেখেছিল তারা দূর থেকেই দেখেছিল কেবল; কখনো তাতে চড়ে নি। এক-আধজন সৌভাগ্যবান যারা শুধু দেখে নি তাতে আরোহণ করে ভ্রমণও করেছে, তারা এ-সুযোগে আসন্ন যন্ত্রদৈত্যের সম্বন্ধে চটকদার বিবরণ দিয়ে অজ্ঞদের ঔৎসুক্য মাত্রাতিরিক্তভাবে শাণিত করে তোলে।