অকস্মাৎ মুহাম্মদ মুস্তফার প্রবল জ্বর শুরু হয়। তবারক ভুইঞা পূর্ণ উদ্যমে জ্বরাক্রান্ত নিঃসঙ্গ মুহাম্মদ মুস্তফার সেবা-শ্রয় লেগে যায়। একদিন রাতে মুহাম্মদ মুস্তফা দেখতে পায় তবারক ভুইঞা বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে স্থিরদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। সহসা সে একটি কণ্ঠস্বরও শুনতে পায়। তবে সে বুঝতে পারে, কণ্ঠস্বরটি তবারক ভুইঞার নয়, নিজেরই কণ্ঠস্বর। অকারণেই সে যেন চমকিত হয়ে পড়ে, অকারণে এ-জন্যে যে নিজের কণ্ঠস্বর শুনলে চমকিত হবার কোনো যথার্থ কারণ নেই। তারপর ঘরময় সহসা নীরবতা নাবে। অনেকক্ষণ সে-নীরবতা জমাট হয়ে থাকে, যে-নীরবতার মধ্যে বাইরে কোথাও বিদ্যুৎগতিতে চক্কর দিতে থাকা একটি বাদুড়ের আবির্ভাব হলে সে-বাদুড়ের শব্দ, পরে দূরে কোথাও একটি বিড়াল-ছানা ক্ষীণ-কাতর কণ্ঠে কাঁদতে শুরু করলে সে-কান্নার শব্দ-এ সব উচ্চরব ধারণ করে। তবারক ভুইঞা কেমন চঞ্চল হয়ে একবার হাত-পাখাটি তুলে নেয়, পরক্ষণে রোগীর তৃষ্ণা পেয়ে থাকবে ভেবে পুঁতি-ঝোলানো জালি দিয়ে ঢাকা পানির গেলাসটি ওঠায়। জালিটা তার বউ-এর হাতের কাজ, দুদিন হল মুহাম্মদ মুস্তফাকে এনে দিয়েছে। থাক পানি। মুহাম্মদ মুস্তফা বলেছিল। ততক্ষণে সে বুঝে নিয়েছে, শ্যাওলাপড়া ডোবার মতো ক্ষুদ্র পুকুরে খোদেজার মৃত্যুর কথা তবারক ভুইঞা বলে ফেলেছে। এবার সে অপেক্ষা করে। তার বিশ্বাস হয় তবারক ভুইঞা বলবে : মেয়েমানুষেরা কত আজে-বাজে কথা বলে। অবশেষে লণ্ঠনের তেজ কমিয়ে তবারক ভুইঞা বলেছিল, ওসব কথা এখন ভাববেন না।
তবারক ভুইঞা চলে যাবার পর মুহাম্মদ মুস্তফা কিছুক্ষণ নিথর হয়ে থাকে। জ্বর কমে নি, কিন্তু মাথাটি কেমন পরিষ্কার হয়ে উঠেছে। প্রথমে সে একটু লজ্জা বোধ করে। তার মনে হয় সে যেন জ্বরের অজুহাতেই শ্যাওলা-আবৃত ডোবার মতো পুকুরে যে-ঘটনা ঘটেছিল সে-ঘটনার কথা তবারক ভুইঞাকে বলেছে। লজ্জার সঙ্গে-সঙ্গে কিছু স্বস্তিও যেন পায়। হয়তো কথাটি কাউকে বলতেই হত। তাছাড়া, তবারক ভুইঞা লোকটি যেন ভালো, বিশ্বাসী, এবং বয়স তেমন না হলেও কেমন সমঝদার, দরবানও, তাকে বলায় কোনো ক্ষতি নেই। তবে একটি কথায় মনটা কেমন খচখচ করে। সে তবারক ভুইঞাকে জিজ্ঞাসা করেছিল কথাটি বিশ্বাসযোগ্য কিনা। তবারক ভুইঞা হাঁ-না কিছু বলে নি, কোনো মতও প্রকাশ করে নি। তবারক ভুইঞার প্রতিক্রিয়াটি ঠিক বুঝতে পারে না। অথচ সব কথাই সে যেন তাকে বলেছে, কিছুই ঢাকে নি।
মনের অধীরতা চেপে আমাকে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়, কারণ জলাপাড়া নামক একটি ঘাটে স্টিমার থামলে লোকটি যাত্রীদের ওঠা-নাবায় আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। তবে তেমন ওঠা-নাবা যে হয় তা নয়; ঘাটটি ছোটখাটো ধরনের হবে। সন্ধ্যা-উত্তীর্ণ অন্ধকারের মধ্যে কয়েকজন যাত্রী অদৃশ্য হয়ে যায়, সে-অন্ধকার থেকে আবার কয়েকজন নূতন যাত্রী স্বল্পালোকিত স্টিমারের পাটাতনে মূর্তিমান হয়।
স্টিমারটি পুনরায় মাঝ-নদীতে এসে পথ ধরেছে এমন সময়ে লোকটি কুমুরডাঙ্গা নামক ক্ষুদ্র একটি শহরের কথা বলতে শুরু করে; জলাপাড়া ঘাটের আগে স্টিমার যখন নদীর অগভীর স্থানটি সন্তর্পণে পার হয়ে আবার পূর্ণবেগে চলতে শুরু করেছে তখন সে শহরের নামই লোকটির মুখে শুনতে পেয়ে চমকে উঠেছিলাম; সে-শহরে মুহাম্মদ মুস্তফা ছোট হাকিমের পদে নিযুক্ত হয়েছিল। লোকটি বলে : অনেক মহকুমা শহর ক্ষুদ্র হয় কিন্তু কোনোটাই হয়তো কুমুরডাঙ্গার মতো ভাগ্যহীন নয়। জলাপাড়া ঘাটের আগে নদী যেমন অগভীর হয়ে উঠেছে তেমনি সে-শহরের পাশে দিয়ে প্রবাহিত বাকাল নদীটি একদিন অগভীর হয়ে ওঠে শহরবাসীদের অজান্তেই এবং তারপর স্টিমার চলাচলের জন্যে অনুপযোগী হয়ে পড়ে। কুমুরডাঙ্গা শহর এমনই এক অঞ্চলে অবস্থিত যেখানে রেলগাড়ির মতো লৌহদানব তো দূরের কথা, তেমন একটি সড়কও কল্পনাতীত যে সড়ক বর্ষাকালে তলিয়ে যাবে না, বৃষ্টিতে ভেসে যাবে না। নদী-খাল-বিল এবং বিস্তীর্ণ জলাভূমি পরিবেষ্টিত শহরটির জন্যে দ্রুত যানবাহন হিসেবে যে-স্টিমার ছাড়া আর কোনো গতি ছিল না সে-স্টিমারও বন্ধ হয়ে যায়। শহরের আর্থিক অবস্থা এমনিতে ভালো ছিল না। তার সমৃদ্ধি শুধু যে স্তব্ধ হয়েছিল তা নয়, দিন-দিন অবনতির দিকেই যাচ্ছিল। অনেকদিন ধরে ব্যবসা-বাণিজ্যে ঘুণ ধরেছিল, উকিল-মোক্তার, হেকিম ডাক্তারের তেমন পসার ছিল না; কাছারি-আদালত, ছোট একটি হাসপাতাল, হাই স্কুল, এমনকি মেয়েদের জন্যে একটি মাইনর স্কুল নিয়ে গর্ব করতে পারলেও যে-রহস্যময় কল্যাণস্পর্শে একটি জায়গা জীবিত থাকে, তার উন্নতি হয়, সে-কল্যাণস্পর্শ থেকে শহরটি সদা বঞ্চিত। তার ওপর স্টিমারঘাটও বন্ধ হলে মড়ার ওপর খাড়ার ঘা পড়ে আর কি।
লোকটির চোখে কয়েক মুহূর্তের জন্যে কী একটা ভাব জাগে। সে বলে, সে যখন সর্বপ্রথম শুনতে পায় বাকাল নদীতে চরা পড়েছে তখন সহসা তার মানস-চোখে বাল্যকালে দেখা একটি নদীর চিত্ৰই ভেসে উঠেছিল। সেটি একটি অতিশয় খরধার বিশাল নদী যার অপর তীরে প্রতি শরৎকালে মাঠের পর মাঠ ঢেকে বিস্তৃত কাশবন রূপালি শুভ্রতায় ধবধব করত, যার দ্রুতগতি স্রোতে ভেসে যেত জোটবাধা অজস্র কচুরিপানার দল এবং নূতন হাঁড়ি-পাতিলে বোঝাই ডুবু-ডুবু প্রায় অসংখ্য কুমোর-নৌকা, মধ্যে-মধ্যে ঝড় এসে যার পানিতে তুমুল তরঙ্গমালা সৃষ্টি করত আর যার গভীরতাসূচক গাঢ় রঙ দ্বিপ্রহরের সূর্যালোকেও হাল্কা হত না। তবে সে-নদীর বিশালতা, তার অপর তীরের রহস্যময় অস্পষ্টতা, সে-তীরের শরৎকালীন বিস্তৃত কাশবন বা তার পানির রঙ এ-সব লক্ষ্য করলেও যা বালকমনকে সবচেয়ে আকৃষ্ট করত তা নদীটির অবিরাম বলিষ্ঠ ধারা। সে-কারণেই হয়তো বালক-চোখ যখন কুমোর-নৌকা বা কচুরিপানার দিকে তাকাত তখন তাদের মধ্যে কোনো পার্থক্য দেখতে পেত না, সে-চোখ কেবল লক্ষ্য করত তাদের ভেসে যাওয়া, যে-ভেসে যাওয়ার মধ্যে নৌকাগুলি এবং গাঢ় সবুজ জলজ-উদ্ভিদ তাদের আকার-আকৃতি হারিয়ে একাকার হয়ে পড়ত, মনে এ-প্রশ্নও জাগত না কোথায় সে-সব উদ্ভিদের জন্ম কোথায়-বা তা যায়, কোন ঘাটেগঞ্জেই বা কুমোর-নৌকার পদ্রব্য বিক্রয় হয়। শুধু সে-সব বস্তুর মধ্যেই নয়, সে-সব বস্তু এবং স্রোতের মধ্যেও বালক-চোখে কোনো পার্থক্য ধরা পড়ত না : স্রোত, নৌকা, কচুরিপানা, বর্ষার দিনের অন্যান্য জিনিস-গাছের শাখা বা গৃহপালিত কোনো জীবজন্তুর মৃতদেহ, সবই ভেসে যায়, নিরন্তরভাবে, মানুষের জীবন সম্বন্ধে একটি দৃষ্টিহীন গভীর উদাসীনতায়। সে ভেসে-যাওয়া বালক-মনে অবশেষে একটি দুর্বোধ্য ভাবের সৃষ্টি করত, সুপরিচিত মাঠঘাট জনপদ ছেড়ে অস্পষ্ট তবু নিত্য দেখা দিগন্ত পেরিয়ে সে-মন তীরহীন কোনো নদীতে হারিয়ে যেত যে-নদীতেও সব কিছু ভাসত। এবং সেও ভাসত, প্রশ্ন না করে, সম্মুখে বা পশ্চাতে না তাকিয়ে, ভয় পেয়ে; বালক-মন আদি বা অন্তের সন্ধান করে না বলে ভীত হয় না। তারপর এক সময়ে নদীতে সহসা রাত নেমে আসত যে-রাতে কুমোর-নৌকা, কচুরিপানার দল, বর্ষাকালে ভাসমান অন্যান্য বস্তু, এমনকি শরৎকালের অপর তীরের ধবধব-করা কাশবনও নিমজ্জিত হত যেমন দিনান্তে রক্তিমাভাও নিশ্চিহ্ন করে নদীগর্ভে সূর্য নিমজ্জিত হয়। তখনো সে ভেসে-যাওয়া ক্ষান্ত হত না, যদিও সময়টা অপেক্ষার সময়-ঘুমের মধ্যে দিয়ে, কালো রাতে মৃদু আলো জ্বালিয়ে নদীর বুকে জাল ফেলে বসে, স্বপ্নের জন্যে নয়, মাছের জন্যেও নয়, সূর্য ওঠার জন্যে যাতে সে-নিরন্তর ভেসে-যাওয়া আবার দৃষ্টিগত হয়-স্রোতের কুমোর-নৌকার, কচুরিপানার, বর্ষার দিনে অন্যান্য অপ্রত্যাশিত বস্তুর। হয়তো কখনো এমন নদীর মৃত্যু হয় না। তাই একদিন বাল্যকালের বিশাল নদীটি ক্রমশ সঙ্কীর্ণ হয়ে-হয়ে একটি ছোটখাটো শাখানদীতে পরিণত হলেও দুই নদীর মধ্যে কোনো সংঘাত সৃষ্টি হয় নি, পূর্ণবয়স্ক চোখ স্বাভাবিকভাবেই এ-কথা মেনে নেয় যে বাস্তব নদীটির অপর তীর তেমন দূরে নয়, অস্পষ্টও নয়, সেখানে শরৎকালে যে-কাশবন দেখা দেয় তা দিগন্তপ্রসারী নয়, দুরন্ত ঝড় জাগলেও তার পানিতে তুমুল তরঙ্গমালা সৃষ্টি হয় না বা আকাশে কালো মেঘের সঞ্চার হলেও সে-পানি গাঢ় রঙ ধরে না, তার ধারাও দ্রুতগামী নয়, তাছাড়া এখনো সে-পথে কুমোর-নৌকা ভেসে গেলেও তাদের সংখ্যা অগণিত নয়। কোনো আক্ষেপ না করে সে-সব কথা সে গ্রহণ করে নেয় : বাকাল নদী ছোটখাটো শাখা নদী মাত্র।