লোকটির কথা মন দিয়ে শুনছিলাম। একবার মনে হয়, তার কথা আমার স্মৃতির পর্দায় কোথায় যেন ঈষৎ আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। তবে ধারণাটির কোনো যথার্থ কারণ দেখতে না পেলে ভাবি, অন্যের জীবন সম্বন্ধে গভীরভাবে কৌতূহলী মানুষের প্রতি আমি কি বরাবর কেমন একটা আকর্ষণ বোধ করি না? তেমন মানুষ নিয়ে কত প্রশ্ন জাগে মনে : এই কৌতূহলের পশ্চাতে কী, মানুষের জীবনে কী তারা সন্ধান করে, এবং অবশেষে কীই-বা খুঁজে পায়? নিরন্তর মানুষের মনে নিরাশা দেখে তাদের কৌতূহল কি বালুচরে হারিয়ে-যাওয়া নদীর মতো সহসা অদৃশ্য হয়ে যায় না, মানুষের কুচিন্তা কুকাজের প্রভূত প্রমাণে তাদের মনে কি অবশেষে একটি গভীর বিতৃষ্ণা জাগে না? কখনো-কখনো সহজ এবং সম্ভবত সত্য উত্তরটিই গ্রহণ করি। অন্য মানুষের মনের কথা জানা কিছুতেই সম্ভব নয় তা সন্ধানকারী যতই কৌশলী-কারসাজিবাজ থোক না। কেন, এবং যারা জানে বলে দাবি করে তারা বড়াই করে কেবল। সেজন্যেই মানুষের মধ্যে সমাজের মধ্যে তারা সুস্থ মনে বসবাস করতে পারে, নিশ্চিন্ত মনে রাতে ঘুমাতে পারে, হাসতে পারে, বন্ধুত্ব করতে পারে অন্যের সঙ্গে।
লোকটিও বড়াই করে থাকবে-এ-বিশ্বাস সত্ত্বেও সে কী বলছে তা শুনবার জন্যে আবার সকর্ণ হয়েছি এমন সময়ে বুঝতে পারি সমগ্র স্টিমারময় কেমন নীরবতা নেবেছে। তখন সূর্যাস্ত শুরু হয়েছে। যারা স্টিমারযোগে নিয়মিতভাবে ভ্রমণ করে তারা জানে এ-সময়ে যাত্রীদের মধ্যে তাদের অজান্তেই নীরবতা নেবে আসে, যে-নীরবতার মধ্যে এবার স্টিমারের ঘূর্ণমান মস্ত পাখা দুটির, সে-পাখা দুটির নির্মম আঘাতে ক্ষতবিক্ষত পানির, এবং নিচে জীবন্ত ইঞ্জিনের আওয়াজ হঠাৎ সুস্পষ্টভাবে শোনা যায়। যাত্রীরা সহসা নীরব হয়ে গিয়ে সে-সব আওয়াজ শোনে যেন তা আগে শোনে নি। এ সময়ে যাত্রীরা স্টিমারের দেহের স্পন্দন এবং গতি সম্বন্ধেও যেন সর্বপ্রথম সজ্ঞান হয়, তারপর তাদের দৃষ্টি যায় দূরে তীরের দিকে দিগন্তের দিকে ম্লান নিষ্প্রভ আকাশের দিকে; উন্মুক্ত আকাশের তলে দিন-রাতের সন্ধিক্ষণে যে-বিচিত্র অসীমতা প্রকাশ পায় তারই স্পর্শে তারা বিমূঢ় হয়ে পড়ে। নীরবতা আরো ঘনীভূত হয়। এবার শুধু নিকটের পানির গর্জন নয়, দূরে যে-ঢেউ দীর্ঘশ্বাসের মতো অস্ফুট শব্দ করে ছড়িয়ে পড়ে তার ক্ষীণ শব্দও শুনতে পায়, আরো দূরের ঢেউ-যে-ঢেউ-এর শব্দ শোনা যায় না-সে ঢেউ সহসা দৃষ্টিগোচন হয়, হয়তো-বা ছায়াচ্ছন্ন আকাশে দৃষ্টিহীনভাবে উড়তে থাকা পথ হারা কোনো পাখিও নজরে পড়ে।
তবে শীঘ্ৰ বুঝতে পারি, শুধু সূর্যাস্তের জন্যে নয়, মাঝ-নদীতে স্টিমারটি হঠাৎ ধীরে ধীরে চলতে শুরু করেছ বলেও যেন যাত্রীরা নীরব হয়ে পড়েছে। এ-স্থানে নদীর গভীরতা বেশ কম হবে। স্টিমারটি কিছুক্ষণ গভীরতা মেপে মেপে অতি ধীরে ধীরে অগ্রসর হয়, তারপর থেমেই পড়ে, যেন আর এগুলে সাহস হয় না। স্টিমারটি আবার যখন চলতে শুরু করে তখন বেশ সাবধানতার সঙ্গে চলে, কখনো এদিক-ওদিক মোড় নিয়ে, কখনো একটু পশ্চাতে হটে, কখনো-বা পুনরায় অল্প সময়ের জন্যে নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। বাইরে দ্রুতভাবে সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়ে আসে, যে-অন্ধকারে তেরপলের ঝুলে-পড়া অংশটি সশব্দে আন্দোলিত করে আবার প্রবলবেগে হাওয়া ছুটতে শুরু করে।
একবার লোকটির দিকে দৃষ্টি দেই। ইতিমধ্যে বুঝে ফেলেছি যে বেশিক্ষণ নীরব হয়ে থাকা তার পক্ষে সহজ নয়; কী সে বলে কেনই-বা বলে-তা নিজেও সব সময়ে না বুঝলেও তাকে কথা বলতেই হয়, না বললে হয়তো কেমন নিঃসহায় এবং নিরস্ত্র বোধ করে। কিন্তু এখন সে-লোকের মুখে কথা নেই। মনে হয় গভীর মনোযোগ-সহকারে স্টিমারের সঙ্গে-সঙ্গে সে-ও নিরাপদ পথ খুঁজছে, অনেকটা রুদ্ধশ্বাসে। তার চোখের হাসিটি মিলিয়ে গিয়েছে, দৃষ্টি নদীর দিকে, হাসিশূন্য কথা শূন্য মুখে অপেক্ষার, কিছু আশঙ্কার ভাব।
অবশেষে স্টিমারটি বিপদজনক অঞ্চলটি নিরাপদে অতিক্রম করতে সক্ষম হয়। তেজ বাড়িয়ে স্টিমার পূর্ণোদ্যমে চলতে শুরু করলে মুক্তি-পাওয়ার আনন্দেই যেন তার সমগ্র দেহ কাঁপতে শুরু করে থরথর করে; তার চতুষ্পার্শ্বে পানির গর্জন আর্তনাদের মতো নয়, শৃঙ্খলামুক্ত প্রাণীর উল্লাসধ্বনির মতো শোনায়। যাত্রীদের মধ্যে আবার গুঞ্জন জাগে। সামনের ঘাট আর দূরে নয়।
লোকটি আরো কয়েকমুহূর্ত নীরব হয়ে থাকে। তারপর সহসা সে একটি শহরের নাম নেয় যে-নাম শুনে প্রথমে চমকিত হই, তারপর এ-কথা বুঝতে পারি যে তখন স্মৃতির পর্দায় অকারণে দোলা লাগে নি। তবে লোকটি কি তবারক ভুইঞা? তাকে কখনো স্বচক্ষে দেখি নি, কিন্তু সহসা কেমন নিঃসন্দেহ হয়ে পড়ি যে সে তবারক ভুইঞাই হবে। সে-বিষয়ে নিশ্চিত হলে মনে-মনে বড় উত্তেজিত হয়ে পড়ি, একটি মানুষের স্মৃতি অন্তরে উদ্বেলিত হয়ে ওঠে সহসা। স্মৃতি নয়, একটি ভার, যে-ভার এত বছরেও হাল্কা হয় নি। উত্তেজিত হয়ে ভাবি : তবে লোকটির মুখে মুহাম্মদ মুস্তফার কথা শুনতে পাব কি? আমি জানি মুহাম্মদ মুস্তফার সঙ্গে লোকটির পরিচয় হয়েছিল। শুধু তাই নয়; যে-বিচিত্র দ্বন্দ্বে সে-সময় মুহাম্মদ মুস্তফা সমগ্র মনে-প্রাণে নিপিড়ীত হয়েছিল সে-দ্বন্দ্বের কথা এবং সে-দ্বন্দ্বের কারণের কথাও জানতে পেরেছিল। তখন শিক্ষানবিশী শেষ হবার পর মুহাম্মদ মুস্তফা সবেমাত্র সে-শহরে ছোট হাকিমের পদে নিযুক্ত হয়েছে এবং তবারক ভুইঞা সে-শহরেরই স্টিমারঘাটে টিকেট-কেরানির কাজ করত। কীভাবে তবারক ভুইঞা মুহাম্মদ মুস্তফার সঙ্গে পরিচয় করে নিয়েছিল জানি না, তবে তবারক মিঞার মতো লোকের পক্ষে কাজটি তেমন কিছু কঠিন নয়। প্রথমে পরিচয়, তারপর একরকম ঘনিষ্ঠতার মতো। হয়তো ঘনিষ্ঠতা কথাটা ঠিক নয়, কারণ যাদের সঙ্গে সমানে-সমানে মেলামেশা করা যায় না, পদমর্যাদায় যারা তার চেয়ে উঁচু স্থান রাখে, তাদের সঙ্গে হয়তো সে ভাবমিতালি করে না, ভাবমিতালির প্রয়োজনও বোধ করে না। তবে তেমন কোনো লোকের নিকটবর্তী হবার প্রয়োজন বোধ করলে সে কেবল আলগোছে কোথাও একটি দেউড়ি পেরিয়ে যায় যার পর সে-লোকটির অন্তরের গভীরতম অঞ্চলেও দৃষ্টি দিতে আর বাধে না, এবং সহসা তার সান্নিধ্য সম্বন্ধে লোকটি যদি সচেতন হয়ে কেমন আশাঙ্কিত হয়ে পড়ে তখন তার দিকে একবার দৃষ্টি দিলে আবার আশ্বস্ত হতে দেরি হয় না। মুহাম্মদ মুস্তফাও অবিলম্বে আশ্বস্ত হয়েছিল। অল্পবয়স্ক টিকেট-কেরানির দিকে তাকালে সে দেখতে পায়, বিশ্বস্ততার আদর্শ চিরশ্রদ্ধ মানুষটির মধ্যে কোনো পরিবর্তন হয় নি, তার চোখের অন্তরস্পর্শী, সরলতায়, মুখের নিরীহ ভাবে থুতনির পরিচ্ছন্ন রেখাতে বা নিত্যকার সজ্জনতায় কোনো কিছুতেই তারতম্য ঘটে নি, তাছাড়া এত কাছে বসেও সে যেন অনেক দূরে, এমনকি সে যে কিছু শুনছে তাও নিশ্চিত করে বলা যায় না; কত সে এমনই মানুষ যার ওপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করা যায় যদিও কী কারণে নির্ভর করা যায় তা বলা মুশকিল। তবু সে ভয়ানক জ্বরে না পড়লে হয়তো তবারক ভুইঞা কথাটা জানতে পারত না।