তবু বহুদিন ধরে সে যেন কেবল দর্শকই ছিল-যে-দর্শক দেখে কিন্তু কিছু অনুভব করে না, যা দেখে তার অর্থ বুঝলেও সে-অর্থ তার হৃদয় স্পর্শ করে না, সহসা চোখে অশ্রুর আভাস দেখা দিলেও সে-অশ্রু চোখ থেকেই নাবে অন্তর থেকে উঠে আসে না। নূতন বধূটির ব্যথায় অকস্মাৎ তার চোখে পানি আসার কথা এখনো তার মনে পড়ে।
দুদু মিঞার বাড়িতে নূতন বউ এসেছে শুনতে পেয়ে সেখানে উপস্থিত হতে তার দেরি হয় নি। টকটকে লাল শাড়ি পরে নূতন বউ সুদৃশ্য একটি চাটাইর ওপর বসে ছিল, মাথায় দীর্ঘ ঘোমটা, গায়ে অলঙ্কার, হাতে-পায়ে মেহেদি। প্রথমে দূর থেকে তাকে চেয়ে-চেয়ে দেখে, কখনো কখনো তার উজ্জ্বল লাল শাড়ি লেলিহান শিখার মতো আচমকা জেগে উঠে তার চোখে ধাঁধা লাগায়। পরে নিকটে এসে মাথা নিচু করে ঘোমটা-ঢাকা মুখের দিকে তাকায়। সে-সময়ে তার চোখে পানি দেখতে পায় : চোখ মুখ নিথর গাল বেয়ে কী ব্যথায় নিঃশব্দে অশ্রুধারা নেবে আসছে। কৌতূহলী দৃষ্টি সম্বন্ধে সজ্ঞান হলে নূতন বউ হঠাৎ লজ্জিত হয়ে ভেঙচি কাটে। তার মুখ-ভেঙচানিতে সে বিব্রত বোধ করে নি, তবে তার চোখে-গালের অশ্রুধারার দিকে তাকিয়ে তার চোখও সহসা অশ্রুসজল হয়ে ওঠে। অজানা মেয়েটির দুঃখে সে যে বুকে কোথাও ব্যথা বোধ করেছিল তা নয়, মেয়েটির চোখের অশ্রু পুষ্পরেণুর মতো অদৃশ্যভাবে ভেসে এসে তার চোখ ভিজিয়ে দিয়েছিল কেবল। সে-অশ্রু চোখেরই অশ্রু, হৃদয়ের অশ্রু নয়; হৃদয়ের অশ্রু দেখা দিতে সময় লাগে।
এমনি অনেক বাড়ির উঠানে দাওয়ায় অন্দরমহলে দাঁড়িয়ে বা খাটুমালা হয়ে বসে পেঁচা-চোখ মেলে সে সময় কাটাত, নিঃশব্দে, ছায়ার মতো। কোনো বাড়িতে এন্তেকাল ঘটলে ক্রন্দনরত শোকাকুল পরিবারের অজান্তে অলক্ষিতে সে যেমন সেখানে উপস্থিত হত তেমনি কোথাও নবজাত শিশু আকস্মিক কান্নার সাহায্যে তার আগমন-বার্তা ঘোষণা করতেই তার সান্নিধ্যে হাজির হত। সে দেখত, শুনত-কিছুই তার চোখ-কান এড়াত না। দেখে-দেখে শুনে-শুনে এক সময়ে মানুষের জীবন সম্বন্ধে এমনই পারদর্শী হয়ে পড়ে যে দূর থেকে কেবল মুখভঙ্গি দেখেই বলতে পারত কে ধানের কথা বলছে কে-বা বলছে খাজনার কথা।
বাল্যকালের সে-কৌতূহল বয়ঃপ্রাপ্তির সঙ্গে-সঙ্গে কমে না গিয়ে দিন-দিন বেড়েই চলে। তবে যা বাল্যকালে সম্ভব, পরে সম্ভব নয়; বড় হয়ে উঠলে পেঁচা-চোখ লোকেরা সহ্য করে না। তাই ধীরে ধীরে সে নানাপ্রকার ছলনা-কৌশলের শরণাপন্ন হয়, এবং কীভাবে আলগোছে-অলক্ষিতে মানুষের অন্তরের গভীরতম কক্ষে প্রবেশ করে কেউ কিছু সন্দেহ করার আগেই যা জানবার তা জেনে নিতে হয়-এ-সব কায়দা শিখে নেয়। না নিয়ে উপায় কী? ততদিনে কৌতূহলটি নেশার মতো পেয়ে বসেছে তাকে।
সেজন্যেই জীবনে কিছু হয় নি। পরের জীবনের দিকে তাকিয়ে দিন কাটিয়েছি, নিজের জীবনের কথা ভাবার সময় হয়ে ওঠে নি। হঠাৎ একটু আফসোসের সঙ্গেই যেন লোকটি বলে।
বাল্যকালে সে মেধাবী ছিল। বর্ষান্তের পরীক্ষায় প্রতিবছর প্রথম স্থান দখল করত, প্রাইজ-পুরস্কার পেত। তার পেশকার বাপ আশা করেছিল ছেলে যথাসময়ে ক্ষুদ্র মফস্বল শহরের সঙ্কীর্ণ সীমানা অতিক্রম করে বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজায় উপস্থিত হবে, পরে জজ হাকিম বা উকিল-ডাক্তার হবে। বাপের প্রতি আদর্শ-বাধ্যতা প্রদর্শন করে স্টিমারে সওয়ার হয়ে একদিন উচ্চশিক্ষার্থে অন্যত্র গিয়েছিল, কিন্তু উচ্চাশার অভাবেই হোক, নিজের ক্ষুদ্র শহরের জীবনধারা থেকে বেশিদিন বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকা সম্ভব হয় নি বলেই হোক, স্বগৃহে প্রত্যাবর্তন করতে তার দেরি লাগে নি। বাপকে নয়, বন্ধুবান্ধবকে বলেছিল : গাঁদা-ফুল গাঁদা-ফুলই হয়ে থাকবে, গোলাপ ফুল হবে না কখনো। এই বলে পূর্ণ উদ্যমে তার সুপরিচিত জীবনযাত্রায় আবার পরিপূর্ণভাবে নিমজ্জিত হয়ে পড়েছিল, কোনো ক্ষোভ-মনস্তাপ অনুভব করেছিল কিনা সন্দেহ। তবে মানুষকে জীবিকার ব্যবস্থা করতে হয়। তাই বাপের মৃত্যু ঘটলে কিছু তদবির করে প্রথমে স্থানীয় স্টিমারঘাটে টিকেট-কেরানির পদে নিযুক্ত হয়, পরে স্টিমারঘাট বন্ধ হলে কাছারি-আদালতেই ছোটখাটো একটি কলম-ঠেসার কাজ নিয়ে নেয়। বলতে গেলে শ্রদ্ধেয় জন্মদাতার পদাঙ্কানুসরণই করে; তাতে খেদ-দুঃখের কিছু সে দেখতে পায় না। স্টিমারঘাটে চাকুরি নিয়ে একটি বিয়েও করে নিয়েছিল। বউ-এর সন্ধানে নদী পাড়ি দিয়ে হাসনাতপুর নামক একটি গ্রামে চলে গিয়েছিল; হয়তো তার ক্ষুদ্র শহরের সব ঘরের খবর-বৃত্তান্ত তার জানা ছিল বলে বউ খুঁজতে অন্যত্র যাওয়া তার কাছে যুক্তিসঙ্গত মনে হয়েছিল। তবে তার মনে পড়ে, বিয়ে করতে যাবার সময়ে একটি কথা বুঝতে পেরে বেশ উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল। সেটি এই যে, বয়ঃপ্রাপ্তির পর যে-সব বাড়ির অন্দরমহলে তার গতিবিধি বন্ধ হয়ে পড়েছিল সে-সব অস্পষ্ট-হয়ে-ওঠা অন্দরমহলের অভ্যন্তর তার স্ত্রীর দৃষ্টির সাহায্যে আবার পরিষ্কারভাবে দেখতে পাবে। তখন বউ সুন্দরী হবে কিনা তা নয়, তার সঙ্গে মন মিলবে কিনা-এই চিন্তায় সে বড় অধীর হয়ে পড়ে। তার চিন্তা দূর হয় তখন যখন সে দেখতে পায় একজোড়া সপ্রতিভ কৌতুকোজ্জ্বল চোখ যে-চোখে নিমিষেই হাসি জেগে ওঠে; সলজ্জ অপ্রস্তুত হাসি নয়, মন-খোলা হাসি, যেন ঘোমটা তোলার রসটি পুরানো বন্ধুর মধ্যে লুকোচুরির খেলা মাত্র। তখনই বুঝেছিল বউ-এর সঙ্গে মন মিলবে। তারপর সব ভালো লেগেছিল। হয়তো প্রচলিত রেওয়াজ একেবারে উপেক্ষা করা উচিত হবে না মনে করে স্ত্রী যখন মান-অভিমানের খেলা করেছিল তখন তাও ভালো লেগেছিল। একবার মনের মিল হলে মান-অভিমানের পালা ফলবৃক্ষে ফলের ওপর ফুলের বাহারের মতো, সুন্দরী নারীর দেহে মণিমুক্তার বিচ্ছুরণের মতো, অপরূপ সূর্যাস্তের সময়ে রঙধনুর বর্ণশোভার মতো উপরিলভ্য; সে-সব ফাউ।