বলিয়াছি আমাদেরই গ্রামের নদী ইহাদেরও গ্রামপ্রান্তে প্রবাহিত। বর্ষার পরিস্ফীত জলধারা বসন্তসমাগমে একান্ত শীর্ণ, সেদিনের স্রোতশ্চালিত অপরিমেয় পানা ও শৈবাল আজ শুষ্ক তটভূমিতে পড়িয়া শিশির ও রৌদ্রে পচিয়া সমস্ত স্থানটাকে দুর্গন্ধে নরককুণ্ড করিয়া তুলিয়াছে। পরপারে দূরে কয়েকটা শিমুলগাছে অজস্র রাঙ্গা ফুল ফুটিয়া আছে চোখে পড়িল, কিন্তু তাহার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করাটা কবির কাছেও এখন যেন বাড়াবাড়ি বলিয়া ঠেকিল। বলিল, চল্, ঘরে ফিরি।
তাই চলো।
আমি ভেবেছিলাম তোর এ-সব ভালো লাগবে।
বলিলাম, লাগবে ভাই লাগবে। ভাল ভাল কথা দিয়ে এ-সব তুমি কবিতায় লিখো, পড়ে আমি খুশিই হবো।
তাই বোধ হয় গাঁয়ের লোক ফিরেও চায় না।
না। দেখে দেখে তাদের অরুচি ধরে গেছে। চোখের রুচি আর কানের রুচি এক নয় ভাই। যারা মনে করে কবির বর্ণনা চোখে দেখতে পেলে লোকে মোহিত হয়ে যায়, তারা জানে না। দুনিয়ার সকল ব্যাপারই তাই। চোখে যা সাধারণ ঘটনা, হয়ত-বা সামান্য সাধারণ বস্তু, কবির ভাষায় তাই হয়ে যায় নতুন সৃষ্টি। তুমি দেখতে পাও সেও সত্যি, আমি যে দেখতে পেলাম না সেও সত্যি। এর জন্য তুমি দুঃখ করো না গহর।
তবুও ফিরিবার পথে সে কত কি যে আমাকে দেখাইবার চেষ্টা করিল তাহার সংখ্যা নাই। পথের প্রত্যেকটি গাছ, প্রত্যেকটি লতাগুল্ম পর্যন্ত যেন তাহার চেনা। কি একটা গাছের অনেকখানি ছাল কেহ বোধ হয় ঔষধের প্রয়োজনে চাঁচিয়া লইয়া গিয়াছে, তখনও আঠা ঝরিতেছে, গহর হঠাৎ দেখিতে পাইয়া যেন শিহরিয়া উঠিল। তাহার দুই চোখে ছলছল করিয়া আসিল—অন্তরে সে যে কি বেদনাই বোধ করিল তাহার মুখ দেখিয়া আমি স্পষ্ট বুঝিতে পারিলাম। চক্রবর্তী যে তাহার সমুদয় হারানো বিষয় ফিরিয়া পাইতেছিল, সে কেবল কৌশল বিস্তার করিয়া নয়—তাহার হেতু ছিল গহরের নিজেরই স্বভাবের মধ্যে। ব্রাহ্মণের প্রতি অনেকখানি ক্রোধ আমার আপনিই পড়িয়া গেল। চক্রবর্তীর সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটিল না, কারণ, শোনা গেল তাঁহার গৃহে গুটি-দুই নাতির ‘মায়ের অনুগ্রহ’ দেখা গিয়াছে। গ্রামে গ্রামে ওলাবিবি এখনো দেখা দেন নাই—পচা পুকুরের জল আর একটু শুকাইবার অপেক্ষায় আছেন।
সে যাই হোক, বাড়িতে ফিরিয়া গহর তাহার পুঁথি আনিয়া হাজির করিল, তাহার পরিমাণ দেখিয়া ভয় পায় না সংসারে এমন কেহ যদি থাকেও তাহা অত্যন্ত বিরল। বলিল, না পড়া হলে কিন্তু ছাড়া পাবে না, শ্রীকান্ত। সত্যি করে তোমাকে মত দিতে হবে।
এ আশঙ্কা ছিলই। স্পষ্ট করিয়া রাজী হইতে পারি এ সাহস ছিল না, তথাপি দিনের পর দিন করিয়া কবির বাটীতে কাব্য-আলোচনায় এ যাত্রায় আমার সাতদিন কাটিল। কাব্যের কথা থাক কিন্তু নিবিড় সাহচর্যে মানুষটির যে পরিচয় পাইলাম তাহা যেমন সুন্দর, তেমনি বিস্ময়কর। ৭৮৫
একদিন গহর বলিল, তোর কাজ কি শ্রীকান্ত বর্মায় গিয়ে। আমাদের দু’জনেরই আপনার বলতে কেউ নেই, আয় না দু’ভায়ে এখানেই একসঙ্গে জীবনটা কাটিয়ে দিই।
হাসিয়া বলিলাম, আমি ত তোমার মত কবি নই ভাই, গাছপালার ভাষাই বুঝিনে, তাদের সঙ্গে কথা কইতেও পারিনে, পারব কেন এই বনের মধ্যে বাস করতে? দু’দিনেই হাঁপিয়ে উঠবো যে !
গহর গম্ভীর হইয়া উঠিল, বলিল, আমি কিন্তু সত্যিই ওদের ভাষা বুঝি, ওরা সত্যিই কথা কয়—তোরা পারিস নে বিশ্বাস করতে?
বলিলাম, বিশ্বাস করা যে শক্ত এটা তুমিও ত বোঝো!
গহর সহজেই স্বীকার করিয়া লইল; কহিল, হাঁ তাও বুঝি।
একদিন সকালে তাহার রামায়ণের অশোকবনের অধ্যায়টা কিছুক্ষণ পড়ার পরে সে হঠাৎ বই মুড়িয়া আমার মুখের পানে চাহিয়া প্রশ্ন করিয়া বসিল, আছা শ্রীকান্ত, তুই কখনো কাউকে ভালোবেসেছিলি?
কাল অনেক রাত্রি জাগিয়া রাজলক্ষ্মীকে হয়ত আমার এই শেষ চিঠিই লিখিয়াছিলাম। ঠাকুর্দার কথা, পুটুর কথা, তাহার দুর্ভাগ্যের বিবরণ সমস্তই তাহাতে ছিল। তাঁহাদিগকে কথা দিয়াছিলাম একজনের অনুমতি চাহিয়া লইব—সে ভিক্ষাও তাহাতে ছিল ৷ পাঠান হয় নাই, চিঠিটা তখনও আমার পকেটে পড়িয়া। গহরের প্রশ্নের উত্তরে হাসিয়া বলিলাম, না।
গহর কহিল, যদি কখনো ভালোবাসিস, যদি কখনো সেদিন আসে, আমাকে জানাস শ্রীকান্ত।
জেনে তোমার কি হবে?
কিছুই না। তখন শুধু তোদের মধ্যে গিয়ে দিনকতক কাটিয়ে আসব।
আচ্ছা।
আর যদি তখন টাকার দরকার হয় আমাকে খবর দিস। বাবা অনেক টাকা রেখে গেছে, সে আমার কাজে লাগল না—কিন্তু তোদের হয়ত কাজে লেগে যাবে।
তাহার বলার ধরনটা এমনি যে, শুনিলেও চোখে জল আসিয়া পড়িতে চায়। বলিলাম, আচ্ছা, তাও জানাব। কিন্তু আশীর্বাদ ক’রো সে প্রয়োজন যেন না হয়।
আবার যাবার দিনে গহর পুনরায় আমার ব্যাগ ঘাড়ে করিয়া প্রস্তুত হইল। প্রয়োজন ছিল না, নবীন ত লজ্জায় প্রায় আধমরা হইয়া উঠিল, কিন্তু সে কানও দিল না। ট্রেনে তুলিয়া দিয়া সে মেয়েমানুষের মত কাঁদিয়া ফেলিল, বলিল, আমার মাথার দিব্যি রইল শ্রীকান্ত, চলে যাবার আগে আবার একদিন এসো, যেন আর একবার দেখা হয়।
আবেদন উপেক্ষা করিতে পারিলাম না, কথা দিলাম দেখা করিতে আবার আসিব।
কলকাতায় পৌঁছে কুশল সংবাদ দেবে বলো?
এ প্রতিশ্রুতিও দিলাম। যেন কত দূরেই না চলিয়াছি।
কলিকাতার বাসায় গিয়া যখন পৌঁছিলাম তখন প্রায় সন্ধ্যা। চৌকাঠে পা দিয়াই যাহার সহিত সাক্ষাৎ ঘটিল সে আর কেহ নহে, স্বয়ং রতন।