কে, রত্না? ও ব্যাটাকে বিশ্বাস নেই দিদি, আমি এসেচি বলেই হয়ত ও বেছে বেছে পচা মাছ কিনে আনবে—বলিয়াই হঠাৎ দেখিল রতন দ্বারপ্রান্তে দাঁড়াইয়া; জিভ কাটিয়া বলিল, রতন দোষ নিও না বাবা, আমি ভেবেছিলুম তুমি বুঝি ও-পাড়ায় গেছ—ডেকে সাড়া পাইনি কিনা।
রাজলক্ষ্মী হাসিতে লাগিল, আমিও না হাসিয়া পারিলাম না। রতন কিন্তু ভ্রুক্ষেপ করিল
না, গম্ভীর মুখে বলিল, আমি বাজারে যাচ্চি মা, কিষণ চায়ের জল চড়িয়ে দিয়েছে।—বলিয়া চলিয়া গেল।
রাজলক্ষ্মী কহিল, রতনের সঙ্গে আনন্দের বুঝি বনে না?
আনন্দ বলিল, ওকে দোষ দিতে পারি নে দিদি। ও আপনার হিতৈষী—বাজে লোকজন ঘেঁষতে দিতে চায় না; কিন্তু আজ ওর সঙ্গ নিতে হবে, নইলে খাওয়াটা ভালো হবে না। বহুদিন উপবাসী।
রাজলক্ষ্মী তাড়াতাড়ি বারান্দায় গিয়া ডাকিয়া বলিল, রতন, আর গোটাকয়েক টাকা নিয়ে যা বাবা, বড় দেখে একটা রুইমাছ আনতে হবে কিন্তু। ফিরিয়া আসিয়া কহিল, মুখহাত ধুয়ে এসো গে ভাই, আমি চা তৈরি করে আনচি। এই বলিয়া সেও নীচে নামিয়া গেল।
আনন্দ কহিল, দাদা, হঠাৎ তলব হ’লো কেন?
সে কৈফিয়ত কি আমার দেবার, আনন্দ?
আনন্দ সহাস্যে কহিল, দাদার দেখচি এখনো সেই ভাব—রাগ পড়েনি। আবার গা-ঢাকা দেবার মতলব নেই ত? সেবার গঙ্গামাটিতে কি হাঙ্গামাতেই ফেলেছিলেন। এদিকে দেশসুদ্ধ লোকের নেমন্তন্ন, ওদিকে বাড়ির কর্তা নিরুদ্দেশ। মাঝখানে আমি—নতুন লোক—এদিকে ছুটি, ওদিকে ছুটি, দিদি পা ছড়িয়ে কাঁদতে বসলেন, রতন লোক তাড়াবার উয্যুগ করলে—সে কি বিভ্রাট! আচ্ছা মানুষ আপনি।
আমিও হাসিয়া ফেলিলাম, বলিলাম, রাগ এবারে পড়ে গেছে, ভয় নেই।
আনন্দ বলিল, ভরসাও নেই। আপনাদের মত নিঃসঙ্গ, একাকী লোকেদের আমি ভয় করি। কেন যে নিজেকে সংসারে জড়াতে দিলেন তাই আমি অনেক সময়ে ভাবি।
মনে মনে বলিলাম, অদৃষ্ট! মুখে বলিলাম, আমাকে দেখচি তা হলে ভোলোনি, মাঝে মাঝে মনে করতে?
আনন্দ বলিল, না দাদা, আপনাকে ভোলাও শক্ত, বোঝাও শক্ত, মায়া কাটানো আরও শক্ত। বিশ্বাস না হয় বলুন, দিদিকে সাক্ষী মানি। আপনার সঙ্গে পরিচয় ত মাত্র দু-তিনদিনের, কিন্তু সেদিন যে দিদির সঙ্গে গলা মিলিয়ে আমিও কাঁদতে বসিনি—সেটা নিতান্তই সন্ন্যাসী-ধর্মের বিরুদ্ধ বলে।
বলিলাম, সেটা বোধ হয় দিদির খাতিরে। তাঁর অনুরোধেই ত এতদূরে এলে।
আনন্দ কহিল, নেহাত মিথ্যে নয় দাদা। ওঁর অনুরোধ ত অনুরোধ নয়, যেন মায়ের ডাক। পা আপনি চলতে শুরু করে। কত ঘরেই তো আশ্রয় নিই, কিন্তু ঠিক এমনটি আর দেখিনে। আপনিও ত শুনেচি অনেক ঘুরেছেন, কোথাও দেখেছেন এঁর মত আর একটি?
বলিলাম, অনেক—অনেক।
রাজলক্ষ্মী প্রবেশ করিল। ঘরে ঢুকিয়াই সে আমার কথাটা শুনিতে পাইয়াছিল, চায়ের বাটিটা আনন্দের কাছে রাখিয়া দিয়া আমাকে জিজ্ঞাসা করিল, কি অনেক গা?
আনন্দ বোধ করি একটু বিপদগ্রস্ত হইয়া পড়িল; আমি বলিলাম, তোমার গুণের কথা। উনি সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন বলেই সজোরে তার প্রতিবাদ করছিলাম।
আনন্দ চায়ের বাটিটা মুখে তুলিতেছিল, হাসির তাড়ায় খানিকটা চা মাটিতে পড়িয়া গেল। রাজলক্ষ্মীও হাসিয়া ফেলিল।
আনন্দ বলিল, দাদা, আপনার উপস্থিত বুদ্ধিটা অদ্ভুত। ঠিক উলটোটা চক্ষের পলকে মাথায় এলো কি করে?
রাজলক্ষ্মী বলিল, আশ্চর্য কি আনন্দ? নিজের মনের কথা চাপতে চাপতে আর গল্প বানিয়ে বলতে বলতে এ বিদ্যের উনি একেবারে মহামহোপাধ্যায় হয়ে গেছেন।
বলিলাম, আমাকে তা হলে তুমি বিশ্বাস করো না?
একটুও না।
আনন্দ হাসিয়া কহিল, বানিয়ে বলার বিদ্যেয় আপনিও কম নয় দিদি। তৎক্ষণাৎ জবাব দিলেন—একটুও না।
রাজলক্ষ্মীও হাসিয়া ফেলিল, বলিল, জ্বলেপুড়ে শিখতে হয়েছে ভাই। তুমি কিন্তু আর দেরি ক’রো না, চা খেয়ে স্নান করে নাও, কাল গাড়িতে তোমার যে খাওয়া হয়নি তা বেশ জানি। ওঁর মুখে আমার সুখ্যাতি শুনতে গেলে তোমার সমস্ত দিনে কুলোবে না। এই বলিয়া সে চলিয়া গেল।
আনন্দ কহিল, আপনাদের মত এমন দুটি লোক সংসারে বিরল। ভগবান আশ্চর্য মিল করে আপনাদের দুনিয়ায় পাঠিয়েছিলেন।
তার নমুনা দেখলে ত?
নমুনা সেই প্রথম দিনে সাঁইথিয়া স্টেশনে গাছতলাতেই দেখেছিলুম। তারপরে আর একটিও কখনো চোখে পড়ল না।
আহা! কথাগুলো যদি ওঁর সামনেই বলতে আনন্দ!
আনন্দ কাজের লোক, কাজের উদ্যম ও শক্তি তাহার বিপুল। তাহাকে কাছে পাইয়া রাজলক্ষ্মীর আনন্দের সীমা নাই। দিনরাতে খাওয়ার আয়োজন ত প্রায় ভয়ের কোঠায় গিয়া ঠেকিল। অবিশ্রাম দু’জনের কত পরামর্শই যে হয় তাহার সবগুলো জানি না, শুধু কানে আসিয়াছে যে, গঙ্গামাটিতে একটা ছেলেদের ও একটা মেয়েদের ইস্কুল খোলা হইবে। ওখানে বিস্তর গরীব এবং ছোটজাতের লোকের বাস, উপলক্ষ বোধ করি তাহারাই; শুনিতেছি একটা চিকিৎসার ব্যাপারও চলিবে। এই-সকল বিষয়ে কোনদিন আমার কিছুমাত্র পটুতা নাই। পরোপকারের বাসনা আছে কিন্তু শক্তি নাই, কোন কিছু একটা খাড়া করিয়া তুলিতে হইবে ভাবিলেও আমার শ্রান্ত মন আজ নয় কাল করিয়া দিন পিছাইতে চায়। তাহাদের নূতন উদ্যোগে মাঝে মাঝে আনন্দ আমাকে টানিতে গেছে, কিন্তু রাজলক্ষ্মী হাসিয়া বাধা দিয়া বলিয়াছে, ওঁকে আর জড়িয়ো না আনন্দ, তোমার সমস্ত সঙ্কল্প পণ্ড হয়ে যাবে।
শুনিলে প্রতিবাদ করিতেই হয়, বলিলাম, এই যে সেদিন বললে আমার অনেক কাজ, এখন থেকে আমাকে অনেক কিছু করতে হবে!