গহরের সংবাদ পাইবার উপায় চিন্তা করিতে করিতে আখড়ায় ফিরিয়া আসিয়া যখন পৌঁছিলাম তখন বেলা প্রায় তিনটা। ঠাকুরঘরের বারান্দায় মেয়েদের ভিড় জমিয়াছে; বাবাজীরা কেহ নাই, সম্ভবতঃ সুপ্রচুর প্রসাদসেবার পরিশ্রমে নির্জীব হইয়া কোথাও বিশ্রাম করিতেছেন। রাত্রিকালে আর একদফা লড়িতে হইবে তাহার বলসঞ্চয়ের প্রয়োজন।
উঁকি মারিয়া দেখিলাম ভিড়ের মাঝখানে বসিয়া এক গণক; পাঁজি, পুঁথি, খড়ি, শেলেট, পেন্সিল প্রভৃতি গণনার যাবতীয় উপকরণ তাঁহার কাছে। আমার প্রতি সর্বাগ্রে চোখ পড়িল পদ্মার, সে চেঁচাইয়া উঠিল, নতুনগোঁসাই এয়েছে।
কমললতা বলিল, তখনি জানি গহরগোঁসাই তোমাকে অমনি ছেড়ে দেবে না, কি খেলে সে—
রাজলক্ষ্মী তাহার মুখ চাপিয়া ধরিল—থাক দিদি, ও আর জিজ্ঞাসা করো না।
কমললতা তাহার হাত সরাইয়া দিয়া বলিল, রোদ্দুরে মুখ শুকিয়ে গেছে, রাজ্যের ধুলোবালি উঠেচে মাথায়—স্নানটান হয়েচে ত?
রাজলক্ষ্মী বলিল, তেল ছোঁন না, হলেও ত বোঝা যাবে না দিদি।
অবশ্য সর্বপ্রকার চেষ্টাই নবীন করিয়াছে, কিন্তু আমি স্বীকার করি নাই, অস্নাত অভুক্তই ফিরিয়া আসিয়াছি।
রাজলক্ষ্মী মহানন্দে কহিল, গণকঠাকুর আমার হাত দেখে বলেছে, আমি রাজরানী হবো।
কি দিলে?
পদ্মা বলিয়া দিল—পাঁচ টাকা। রাজলক্ষ্মীদিদির আঁচলে বাঁধা ছিল।
আমি হাসিয়া বলিলাম, আমাকে দিলে আমি তার চেয়েও ভালো বলতে পারতাম।
গণক উড়িয়া ব্রাহ্মণ, বেশ বাঙ্গালা বলিতে পারে—বাঙ্গালী বলিলেই হয়—সেও হাসিয়া কহিল, না মশাই, টাকার জন্যে নয়, টাকা আমি অনেক রোজগার করি। সত্যিই এমন ভালো হাত আমি আর দেখিনি। দেখবেন, আমার হাতদেখা কখনো মিথ্যে হবে না।
বলিলাম, ঠাকুর, হাত না দেখে কিছু বলতে পারো কি?
সে কহিল, পারি। একটা ফুলের নাম করুন।
বলিলাম, শিমুলফুল।
গণক হাসিয়া কহিল, শিমুলফুলই সই! আমি এর থেকেই বলে দেব আপনি কি চান। এই বলিয়া সে খড়ি দিয়া মিনিট-দুই আঁক কষিয়া হিসাব করিয়া বলিল, আপনি চান একটা খবর জানতে।
কি খবর?
সে আমার প্রতি চাহিয়া বলিতে লাগিল, না—মামলা-মকদ্দমা নয়; আপনি কোন লোকের খবর পেতে চান।
খবরটা বলতে পার ঠাকুর?
পারি। খবর ভালো, দু-একদিনেই জানতে পারবেন।
শুনিয়া মনে মনে একটু বিস্মিত হইলাম এবং আমার মুখ দেখিয়া সকলেই তাহা অনুমান করিল।
রাজলক্ষ্মী খুশি হইয়া বলিল, দেখলে ত! আমি বলচি ইনি খুব ভালো গোণেন, কিন্তু তোমরা কিছুই বিশ্বাস করতে চাও না—হেসে উড়িয়ে দাও।
কমললতা বলিল, অবিশ্বাস কিসের? নতুনগোঁসাই, দেখাও ত ভাই তোমার হাতটা একবার ঠাকুরকে।
আমি করতল প্রসারিত করিয়া ধরিতে গণক নিজের হাতে লইয়া মিনিট দুই-তিন সযত্নে পর্যবেক্ষণ করিল, হিসাব করিল, তারপরে বলিল, মশায়, আপনার ত দেখি মস্ত ফাঁড়া—
ফাঁড়া? কবে?
খুব শীঘ্র। মরণ-বাঁচনের কথা।
চাহিয়া দেখিলাম রাজলক্ষ্মীর মুখে আর রক্ত নাই—ভয়ে সাদা হইয়া গিয়াছে।
গণক আমার হাতটা ছাড়িয়া রাজলক্ষ্মীকে বলিল, দেখি মা তোমার হাতটা আর একবার—
না। আমার আর হাত দেখতে হবে না—হয়েছে।
তাহার তীব্র ভাবান্তর অত্যন্ত স্পষ্ট। চতুর গণক তৎক্ষণাৎ বুঝিল হিসাবে তাহার ভুল হয় নাই, বলিল, আমি ত দর্পণ মাত্র মা, ছায়া যা পড়বে তাই আমার মুখে ফুটবে—কিন্তু রুষ্ট গ্রহকেও শান্ত করা যায়, তার ক্রিয়া আছে—সামান্য দশ-কুড়ি টাকা খরচের ব্যাপার মাত্র।
তুমি আমাদের কলকাতার বাড়িতে যেতে পার?
কেন পারব না মা, নিয়ে গেলেই পারি।
আচ্ছা।
দেখিলাম তাহার গ্রহের কোপের প্রতি পুরা বিশ্বাস আছে, কিন্তু তাহাকে প্রসন্ন করার সম্বন্ধে যথেষ্ট সন্দেহ।
কমললতা বলিল, চল গোঁসাই তোমার চা তৈরি করে দিই গে—খাবার সময় হয়েচে।
রাজলক্ষ্মী কহিল, আমি তৈরি করে আনচি দিদি, তুমি ওঁর বসবার জায়গাটা একটু ঠিক করে দাও গে। রতনকে বলো তামাক দিতে। কাল থেকে তার ছায়া দেখবার জো নেই।
অন্যান্য সকলে গণৎকার লইয়া কলরব করিতে লাগিল, আমরা চলিয়া আসিলাম।
দক্ষিণের খোলা বারান্দায় আমার দড়ির খাট, রতন ঝাড়িয়া-ঝুড়িয়া দিল, তামাক দিল, মুখহাত ধোবার জল আনিয়া দিল—কাল সকাল হইতে বেচারার খাটুনির বিরাম নাই, অথচ কর্ত্রী বলিলেন তাহার ছায়া পর্যন্ত দৃষ্টিগোচর হয় না। ফাঁড়া আমার আসন্ন, কিন্তু রতনকে জিজ্ঞাসা করিলে সে নিশ্চয়ই বলিত, আজ্ঞে না, ফাঁড়া আপনার নয়—আমার।
কমললতা নীচে বারান্দায় বসিয়া গহরের সংবাদ জিজ্ঞাসা করিতেছিল, রাজলক্ষ্মী চা লইয়া আসিল, মুখ অত্যন্ত ভারী, সুমুখের টুলে বাটিটা রাখিয়া দিয়া কহিল, দ্যাখো, তোমাকে একশো বার বলেচি বনেজঙ্গলে ঘুরে বেড়িয়ো না—বিপদ ঘটতে কতক্ষণ? তোমাকে গলায় কাপড় দিয়ে হাতজোড় করচি, কথাটা আমার শোনো।
এতক্ষণ চা তৈরি করিতে বসিয়া রাজলক্ষ্মী বোধ হয় ইহাই ভাবিয়া স্থির করিয়াছিল—‘খুব শীঘ্র’ অর্থে আর কি হইতে পারে?
কমললতা আশ্চর্য হইয়া কহিল, বনেজঙ্গলে গোঁসাই আবার কখন গেল?
রাজলক্ষ্মী বলিল, কখন গেলেন সে কি আমি দেখে রেখেচি দিদি? আমার কি সংসারে আর কাজ নেই।
আমি বলিলাম, ও দেখেনি, ওর অনুমান। গণকব্যাটা আচ্ছা বিপদ ঘটিয়ে গেল। শুনিয়া রতন আর একদিকে মুখ ফিরাইয়া একটু দ্রুতপদেই প্রস্থান করিল।
রাজলক্ষ্মী বলিল, গণকের দোষটা কি? সে যা দেখবে তাই ত বলবে? পৃথিবীতে ফাঁড়া বলে কি কথা নেই? বিপদ কারও কখনো ঘটে না নাকি?