কিছুই না।
তোমার মা ভালো আছেন?
মা-বাবা দু’জনেই মারা গেছেন—বাড়িতে আমি একলা আছি।
বিয়ে করোনি?
সেও মারা গেছে।
মনে মনে অনুমান করিলাম এইজন্যই যাহাকে হোক ধরিয়া লইয়া যাইতে তাহার এত আগ্রহ। কথা খুঁজিয়া না পাইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, তোমাদের সেই গাদাবন্দুকটা আছে?
গহর হাসিয়া কহিল, তোর মনে আছে দেখছি। সেটা আছে, আর একটা ভালো বন্দুক কিনেছিলাম, তুই শিকারে যেতে চাস্ ত সঙ্গে যাবো, কিন্তু আমি আর পাখি মারিনে―বড় দুঃখ লাগে।
সে কি গহর, তখন যে এই নিয়ে দিনরাত থাকতে?
তা সত্যি, কিন্তু এখন অনেকদিন ছেড়ে দিয়েচি।
গহরের আর-একটা পরিচয় আছে—সে কবি। তখনকার দিনে সে মুখে মুখে অনর্গল ছড়া কাটিতে পারিত, যে-কোন সময়ে, যে-কোন বিষয়ে অনেকটা পাঁচালীর ধরনে। ছন্দ, মাত্রা, ধ্বনি ইত্যাদি কাব্যশাস্ত্র-বিধি মানিয়া চলিত কিনা সে জ্ঞান আমার তখনও ছিল না, এখনও নাই, কিন্তু মণিপুরের যুদ্ধ, টিকেন্দ্রজিতের বীরত্বের কাহিনী তাহার মুখে ছড়ায় শুনিয়া আমরা সেকালে পুনঃপুনঃ উত্তেজিত হইয়া উঠিতাম। এ আমার মনে আছে। জিজ্ঞাসা করিলাম, গহর, তোমার যে একদিন কৃত্তিবাসের চেয়ে ভালো রামায়ণ রচনার শখ ছিল, সে সঙ্কল্প আছে, না গেছে?
গেছে! গহর মুহূর্তে গম্ভীর হইয়া উঠিল, বলিল, সে কি যাবার রে! ঐ নিয়েই ত বেঁচে আছি। যতদিন জীবন থাকবে, ততদিন ঐ নিয়েই থাকব। কত লিখেচি, চল্ না আজ তোকে সমস্ত রাত্রি শোনাব, তবু ফুরোবে না।
বল কি গহর!
নয়ত কি তোরে মিথ্যে বলচি?
প্রদীপ্ত কবি-প্রতিভায় তাহার চোখমুখ ঝকঝক করিতে লাগিল। সন্দেহ করি নাই, শুধু বিস্ময় প্রকাশ করিয়াছিলাম মাত্র, তথাপি, পাছে কেঁচো খুঁড়িতে সাপ বাহির হয়, আমাকে ধরিয়া বসাইয়া সে সারারাত্রি ব্যাপিয়া কাব্যচর্চা করে, এই ভয়ে শঙ্কার সীমা রহিল না। প্রসন্ন করিতে বলিলাম, না গহর, তা বলিনি, তোমার অদ্ভুত শক্তি আমরা সবাই স্বীকার করি, তবে ছেলেবেলার কথা মনে আছে কিনা তাই শুধু বলছিলাম। তা বেশ বেশ—এ একটা বাঙ্গালাদেশের কীর্তি হয়ে থাকবে।
কীর্তি? নিজের মুখে কি আর বলব ভাই, আগে শোন, তারপরে হবে কথা।
কোনদিক দিয়াই নিস্তার নাই। ক্ষণকাল স্থির থাকিয়া কতকটা যেন নিজের মনেই বলিলাম, সকাল থেকেই শরীরটা এমন বিশ্রী ঠেকচে যে মনে হচ্ছে ঘুমোতে পেলে—
গহর কানও দিল না, বলিল, পুষ্পক-রথে সীতা যেখানে কাঁদতে কাঁদতে গয়না ফেলে দিচ্চেন, সে জায়গাটা যারা যারা শুনেচে চোখের জল রাখতে পারেনি, শ্রীকান্ত।
চোখের জল যে আমিই রাখিতে পারিব সে সম্ভাবনা কম। বলিলাম, কিন্তু—
গহর কহিল, আমাদের সেই বুড়ো নয়নচাঁদ চক্রবর্তীকে তোর মনে আছে ত, তার জ্বালায় আমি আর পারিনে। যখন-তখন এসে বলবে, গহর, সেইখানটা একবার পড় দেখি, শুনি।
৭৭৯
বলে, বাবা তুই কখনো মোছলমানের ছেলে নোস্—তোর গায়ে আসল ব্রহ্মরক্ত স্বচক্ষে দেখতে পাচ্চি।
নয়নচাঁদ নামটা খুব সচরাচর মেলে না, তাই মনে পড়িল। বাড়ি গহরদের গ্রামেই। জিজ্ঞাসা করিলাম, সেই চক্কোত্তি বুড়ো ত? যার সঙ্গে তোমার বাবার লাঠালাঠি মালি-মোকদ্দমা চলছিল?
গহর বলিল, হাঁ কিন্তু বাবার সঙ্গে পারবে কেন—তার জমি, বাগান, পুকুর, মায় বাস্তুসমেত বাবা দেনার দায়ে নিলেম করে নিয়েছিল; আমি কিন্তু তার পুকুর আর ভিটেটা ফিরিয়ে দিয়েচি। ভারী গরীব—দিনরাত চোখের জল ফেলত, সে কি আর ভাল শ্রীকান্ত!
ভাল ত নয়ই। চক্রবর্তীর কাব্য-প্রীতিতে এমনি কিছু-একটা আন্দাজ করিতেছিলাম, বলিলাম, এখন চোখের জল ফেলা থেমেচে ত?
গহর কহিল, লোকটি কিন্তু সত্যিই ভালোমানুষ। দেনার জ্বালায় একসময়ে যা করেছিল অমন অনেকেই করে। ওর বাড়ির পাশেই বিঘে-দেড়েকের একটা আমবাগান আছে, তার প্রত্যেক গাছটাই চক্কোত্তির নিজের হাতে পোঁতা। নাতি-নাতনী অনেকগুলি, কিনে খাবার পয়সা নেই—তা ছাড়া আমার কেই-বা আছে, কেই-বা খাবে।
সে ঠিক। ওটাও ফিরিয়ে দাও গে।
দেওয়াই উচিত শ্রীকান্ত। চোখের সামনে আম পাকে, ছেলেপুলেগুলোর নিঃশ্বাস পড়ে—আমার ভারি দুঃখ হয় ভাই। আমের সময় আমার বাগানগুলো ত সব ব্যাপারীদের জমা করেই দিই—ও বাগানটা আর বিক্রি করিনে, বলি, চক্কোত্তিমশাই, তোমার নাতিরা যেন পেড়ে খায়। কি বলিস রে, ভালো না?
নিশ্চয়ই ভালো। মনে মনে বলিলাম, বৈকুণ্ঠের খাতার জয় হোক, তাহার কল্যাণে গরীব নয়নচাঁদ যদি যৎকিঞ্চিৎ গুছাইয়া লইতে পারে, হানি কি? তাছাড়া গহর কবি। কবি-মানুষের অত বিষয়-সম্পত্তি কিসের জন্য, যদি রসগ্রাহী রসিক সুজনদের ভোগেই না লাগে?
চৈত্রের প্রায় মাঝামাঝি। গাড়ির কপাটটা গহর অকস্মাৎ শেষ পর্যন্ত ঠেলিয়া দিয়া বাহিরে মাথা বাড়াইয়া বলিল, দক্ষিণে বাতাসটা টের পাচ্ছিস শ্রীকান্ত?
পাচ্চি।
গহর কহিল, বসন্তকে ডাক দিয়ে কবি বলেচেন, ‟আজ দখিন দুয়ার খোলা—”
কাঁচা মেঠো রাস্তা, এক ঝাপটা মলয়ানিল রাস্তার শুকনো ধূলা আর রাস্তায় রাখিল না, সমস্ত মাথায় মুখে মাখাইয়া দিয়া গেল। বিরক্ত হইয়া বলিলাম, কবি বসন্তকে ডাকেন নি, তিনি বলেচেন এ সময়ে যমের দক্ষিণ-দোর খোলা—সুতরাং গাড়ির দরজা বন্ধ না করলে হয়ত সে-ই এসে হাজির হবে।
গহর হাসিয়া কহিল, গিয়ে একবার দেখবি চল্। দুটো বাতাবি লেবুর গাছে ফুল ফুটেচে, আধক্রোশ থেকে গন্ধ পাওয়া যায়। সুমুখের জামগাছটা মাধবী ফুলে ভরে গেছে, তার একটা ডালে মালতীর লতা ফুল এখনো ফোটেনি, কিন্তু থোপা থোপা কুঁড়ি। আমাদের চারিদিকেই ত আমের বাগান, এবার মৌলে মৌলে গাছ ছেয়ে গেলে, কাল সকালে দেখিস মৌমাছির মেলা। কত
দোয়েল, কত বুলবুলি, আর কত কোকিলের গান। এখন জ্যোৎস্না রাত কিনা, তাই রাত্রিতেও কোকিলদের ডাকাডাকি থামে না। বাইরের ঘরের দক্ষিণের জানালাটা যদি খুলে রাখিস তোর দু’চোখে আর পলক পড়বে না। এবার কিন্তু সহজে ছেড়ে দিচ্চিনে ভাই, তা আগে থেকেই বলে রাখচি। তা ছাড়া খাবার ভাবনাও নেই, চক্কোত্তিমশাই একবার খবর পেলে হয়, তোরে গুরুর আদর করবে।