বাড়িতে আনিয়া আদর-যত্নের আর অবধি রহিল না। পুঁটুর বর যে আমিই পাঁচ-সাতদিনে এ-সম্বন্ধে গ্রামের মধ্যে আর কাহারো সন্দেহ রহিল না। এমন কি পুঁটুরও না।
ঠাকুর্দার ইচ্ছা আগামী বৈশাখেই শুভকর্ম সমাধা হইয়া যায়। পুঁটুর যে যেখানে আছে আনিয়া ফেলিবারও একটা কথা উঠিল। রাঙাদিদি পুলকিতচিত্তে কহিলেন, মজা দেখেচ, কে যে কার হাঁড়িতে চাল দিয়ে রেখেচ, আগে থাকতে কারও বলবার জো নাই।
আমি প্রথমটা উদাসীন, পরে চিন্তিত, তারপরে ভীত হইয়া উঠিলাম। সায় দিয়াছি কি দিই নাই―ক্রমশঃ নিজেরই সন্দেহ জন্মিতে লাগিল। ব্যাপার এমনি দাঁড়াইল যে, না বলিতে সাহস হয় না, পাছে বিশ্রী কিছু-একটা ঘটে। পুঁটুর মা এখানেই ছিলেন, একটা রবিবারে হঠাৎ বাপও দেখা দিয়া গেলেন। আমাকে কেহ যাইতেও দেয় না, আমোদ-আহ্লাদ ঠাট্টা-তামাশাও চলে―পুঁটু যে ঘাড়ে চাপিবেই, শুধু দিন-ক্ষণের অপেক্ষা—উত্তরোত্তর এমনি লক্ষণই চারিদিক দিয়া সুস্পষ্ট হইয়া উঠিল। জালে জড়াইতেছি—মনে শান্তিও পাই না—জাল কাটিয়া বাহির হইতেও পারি না। এমনি সময়ে হঠাৎ একটা সুযোগ ঘটিল। ঠাকুর্দা জিজ্ঞাসা করিলেন, আমার কোন কোষ্ঠী আছে কি না। সেটা ত দরকার।
জোর করিয়া সমস্ত সঙ্কোচ কাটাইয়া বলিয়া ফেলিলাম, আপনারা কি পুঁটুর সঙ্গে আমার বিবাহ দেওয়া সত্যিই স্থির করেচেন?
ঠাকুর্দা কিছুক্ষণ হাঁ করিয়া রহিলেন, পরে বলিলেন, সত্যিই? শোন কথা একবার!
কিন্তু আমি ত এখনো স্থির করিনি।
করোনি? তা হলে করো। মেয়ের বয়েস বারো-তেরোই বলি, আর যাই করি, আসলে ওর বয়েস হ’ল সতেরো-আঠারো। এর পরে ও মেয়ে বিয়ে দেবো আমরা কেমন করে?
কিন্তু সে দোষ ত আমার নয়!
দোষ তবে কার? আমার বোধ হয়?
ইহার পরে মেয়ের মা ও রাঙাদিদি হইতে আরম্ভ করিয়া প্রতিবেশী মেয়েরা পর্যন্ত আসিয়া পড়িল। কান্নাকাটি, অনুযোগ অভিযোগের আর অন্ত রহিল না। পাড়ার পুরুষেরা কহিল, এত বড় শয়তান আর দেখা যায় না, উহার রীতিমত শিক্ষা দেওয়া আবশ্যক।
কিন্তু শিক্ষা দেওয়া এক কথা, মেয়ের বিবাহ দেওয়া আর-এক কথা। সুতরাং ঠাকুর্দা চাপিয়া গেলেন। তারপরে শুরু হইল অনুনয়-বিনয়ের পালা। পুঁটুকে আর দেখি না, সে বেচারা লজ্জায় বোধ করি কোথাও মুখ লুকাইয়া আছে। ক্লেশবোধ হইতে লাগিল। কি দুর্ভাগ্য লইয়াই উহারা আমাদের ঘরে জন্মগ্রহণ করে! শুনিতে পাইলাম ঠিক এই কথাই উহার মা বলিতেছে, —ও হতভাগী আমাদের সবাইকে খেয়ে তবে যাবে। ওর এমনি কপাল যে, ও চাইলে সমুদ্দুর পর্যন্ত শুকিয়ে যায়,—পোড়া শোল মাছ জলে পালায়। এমন ওর হবে না ত হবে কার?
কলিকাতায় যাইবার পূর্বে ঠাকুর্দাকে ডাকিয়া বাসার ঠিকানা দিলাম, বলিলাম, আমার একজনের মত নেওয়া দরকার, তিনি বললেই আমি সম্মত হবো।
ঠাকুর্দা গদগদকণ্ঠে আমার হাত ধরিয়া কহিলেন, দেখো ভাই, মেয়েটাকে মেরো না। তাঁকে একটু বুঝিয়ে বলো যেন অমত না করেন।
বলিলাম, আমার বিশ্বাস তিনি অমত করবেন না, বরঞ্চ খুশি হয়েই সম্মতি দেবেন।
ঠাকুর্দা আশীর্বাদ করিলেন,—কবে তোমার বাসায় যাব দাদা?
পাঁচ-ছ’দিন পরেই যাবেন।
পুঁটুর মা, রাঙাদিদি রাস্তা পর্যন্ত আসিয়া চোখের জলের সঙ্গে আমাকে বিদায় দিলেন।
মনে মনে বলিলাম, অদৃষ্ট ! কিন্তু এ ভালোই হইল যে, একপ্রকার কথা দিয়া আসিলাম। রাজলক্ষ্মী এ বিবাহে যে লেশমাত্র আপত্তি করিবে না এ কথা আমি নিঃসংশয়ে বিশ্বাস করিয়াছিলাম।
শ্রীকান্ত – ৪র্থ পর্ব – ০২
দুই
স্টেশনে পদার্পণ মাত্র ট্রেন ছাড়িয়া গেল; পরেরটা আসিতে ঘণ্টা-দুই দেরি। সময় কাটাইবার পন্থা খুঁজিতেছি,—বন্ধু জুটিয়া গেল। একটি মুসলমান যুবক আমার প্রতি মুহূর্তকয়েক চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিল, শ্রীকান্ত না?
হাঁ।
আমায় চিনতে পারলে না? আমি গহর। এই বলিয়া সে সবেগে আমার হাত মলিয়া দিল, সশব্দে পিঠে চাপড় মারিল এবং সজোরে গলা জড়াইয়া ধরিয়া কহিল, চল্ আমাদের বাড়ি। কোথা যাওয়া হচ্ছিল, কলকাতায়? আর যেতে হবে না,—চল্।
সে আমার পাঠশালার বন্ধু। বয়সে বছর-চারেকের বড়, চিরকাল আধপাগলা গোছের ছেলে―মনে হইল বয়সের সঙ্গে সেটা বাড়িয়াছে বৈ কমে নাই। তাহার জবরদস্তি পূর্বেও এড়াইবার জো ছিল না, সুতরাং আজ রাত্রের মত সে যে আমাকে কিছুতেই ছাড়িবে না, এই কথা মনে করিয়া আমার দুশ্চিন্তার অবধি রহিল না। বলা বাহুল্য, তাহার উল্লাস ও আত্মীয়তার সহিত পাল্লা দিয়া চলিবার মত শক্তি আজ আমার নাই। কিন্তু সে নাছোড়বান্দা। আমার ব্যাগটা সে নিজেই তুলিয়া লইল, কুলি ডাকিয়া বিছানাটা তাহার মাথায় চাপাইয়া দিল, জোর করিয়া বাহিরে টানিয়া আনিয়া ভাড়া করিয়া আমাকে কহিল, ওঠ্।
পরিত্রাণ নাই,—তর্ক করা বিফল।
বলিয়াছি গহর আমার পাঠশালার বন্ধু। আমাদের গ্রাম হইতে তাহাদের বাড়ি এক ক্রোশ দূরে, একই নদীর তীরে। বাল্যকালে তাহারই কাছে বন্দুক ছুঁড়িতে শিখি। তাহার বাবার একটা সেকেলে গাদাবন্দুক ছিল, সেই লইয়া নদীর ধারে, আমবাগানে, ঝোপেঝাড়ে দু’জনে পাখি মারিয়া বেড়াইতাম, ছেলেবেলা কতদিন তাহাদের বাড়িতে রাত কাটাইয়াছি,—তাহার মা মুড়ি গুড় দুধ কলা দিয়া আমার ফলারের যোগাড় করিয়া দিত। তাহাদের জমিজমা চাষ-আবাদ অনেক ছিল।
গাড়িতে বসিয়া গহর প্রশ্ন করিল, এতদিন কোথায় ছিলি, শ্রীকান্ত?
যেখানে যেখানে ছিলাম একটা সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিলাম। জিজ্ঞাসা করিলাম, তুমি এখন কি করো গহর?