রতন কহিল, সঙ্গে একটি সতেরো-আঠারো বছরের মেয়ে আছে।
এ পুঁটু। এই নির্লজ্জ মানুষটা তাহাকে কলিকাতার বাসায় পর্যন্ত টানিয়া আনিয়াছে। সকালের আলো তিক্ততায় ম্লান হইয়া উঠিল। বলিলাম, তাঁদের এই ঘরে এনে বসাও রতন, আমি মুখহাত ধুয়ে আসচি, এই বলিয়া নীচে স্নানের ঘরে চলিয়া গেলাম।
ঘণ্টাখানেক পরে ফিরিয়া আসিতে ঠাকুর্দাই আমাকে সমাদরে অভ্যর্থনা করিলেন, যেন আমিই অতিথি,— এসো দাদা, এসো। শরীরটা বেশ ভালো ত?
আমি প্রণাম করিলাম। ঠাকুর্দা হাঁকিলেন, পুঁটু গেলি কোথায়?
পুঁটু জানালায় দাঁড়াইয়া রাস্তা দেখিতেছিল, কাছে আসিয়া আমাকে নমস্কার করিল।
ঠাকুর্দা কহিলেন, ওর পিসিমা বিয়ের আগে ওকে একবার দেখতে চায়। পিসেমশাই হাকিম-পাঁচ শ’ টাকা মাইনে। ডায়মণ্ডহারবারে বদলি হয়ে এসেছে-ঘর-সংসার ফেলে পিসির বার হবার জো নেই, তাই সঙ্গে নিয়ে এলুম, বললুম, পরের হাতে তুলে দেবার আগে ওকে একবার দেখিয়ে আনি গে। ওর দিদিমা আশীর্বাদ করে বললে, পুঁটি এমনি অদৃষ্ট যেন তোরও হয়।
আমি কিছু বলিবার পূর্বে নিজেই বলিলেন, আমি কিন্তু সহজে ছাড়ছি নে ভায়া। হাকিমই হোন আর যেই হোন, আত্মীয় ত- দাঁড়িয়ে থেকে কাজটি সমাধা করে দিতে হবে- তবে তাঁর ছুটি। জানোই তো দাদা, শুভকর্মে বহু বিঘ্ন—শাস্ত্রে কি যে বলে—শ্রেয়াংসি বহু
বিঘ্নানি,—অমন একটা লোক দাঁড়িয়ে থাকলে কারুর টুঁ-শব্দ করবার ভরসা হবে না। আমাদের পাড়াগাঁয়ের লোককে ত বিশ্বাস নেই—ওরা সব পারে। কিন্তু হাকিম কিনা, ওদের রাশই আলাদা।
পুঁটুর পিসেমশাই হাকিম। খবরটা অবান্তর নয়—তাৎপর্য আছে।
নতুন হুঁকা কিনিয়া আনিয়া রতন সযত্নে তামাক সাজিয়া দিয়া গেল, ঠাকুর্দা ক্ষণকাল ঠাহর করিয়া দেখিয়া বলিলেন, লোকটিকে কোথায় যেন দেখেছি বলে মনে হচ্চে না?
রতন তৎক্ষণাৎ কহিল, আজ্ঞে হাঁ, দেখেচেন বৈ কি। দেশের বাড়িতে বাবুর অসুখের সময়ে।
ওঃ—তাই ত বলি। চেনা মুখ।
আজ্ঞে হাঁ। বলিয়া রতন চলিয়া গেল।
ঠাকুর্দার মুখ ভয়ঙ্কর গম্ভীর হইয়া উঠিল। তিনি অত্যন্ত ধূর্ত লোক, বোধ হয় সমস্ত কথাই তাঁহার স্মরণ হইল। নীরবে তামাক টানিতে টানিতে বলিলেন, বেরুবার সময়ে দিনটা দেখিয়ে এসেছিলাম, বেশ ভালো দিন, আমার ইচ্ছে আশীর্বাদের কাজটা অমনি সেরে রেখে যাই। নতুনবাজারে সমস্ত কিনতে পাওয়া যায়, চাকরটাকে একবার পাঠিয়ে দিলে হয় না? কি বলো ?
কিছুতেই কথা খুঁজিয়া না পাইয়া কোনমতে শুধু বলিয়া ফেলিলাম, না।
না? না কেন? বেলা বারটা পর্যন্ত দিনটা ত বেশ ভালো। পাঁজি আছে?
বলিলাম, পাঁজির দরকার নেই। বিবাহ আমি করতে পারব না।
ঠাকুর্দা হুঁকাটা দেওয়ালে ঠেস দিয়া রাখিলেন। মুখ দেখিয়া বুঝিলাম যুদ্ধের জন্য তিনি প্রস্তুত হইতেছেন। গালাটা বেশ শান্ত ও গম্ভীর করিয়া কহিলেন, উয্যুগ-আয়োজন একরকম সম্পূর্ণ বললেই হয়। মেয়ের বিয়ে বলে কথা, ঠাট্টা-তামাশার ব্যাপার ত নয়—কথা দিয়ে এসে এখন না বললে চলবে কেন ?
পুঁটু পিছন ফিরিয়া জানালার বাহিরে চাহিয়া আছে এবং দ্বারের আড়ালে রতন কান পাতিয়া রাখিয়াছে বেশ জানি।
বলিলাম, কথা দিয়ে যে আসিনি তা আমিও জানি, আপনিও জানেন। বলেছিলাম একজনের অনুমতি পেলে রাজী হতে পারি।
অনুমতি পাওনি ?
না।
ঠাকুর্দা একমুহূর্ত থামিয়া বলিলেন, পুঁটির বাপ বলে, সর্বরকমে সে হাজার টাকা দেবে। ধরাধরি করলে আর দু-এক শ’ উঠতে পারে। কি বল হে ?
রতন ঘরে ঢুকিয়া বলিল, তামাকটা আর একবার পালটে দেব কি ?
দাও। তোমার নামটি কি বাপু ?
রতন।
রতন ? বেশ নামটি—থাক কোথায় ?
কাশীতে।
কাশী ? ঠাকুরুনটি বুঝি আজকাল কাশীতেই থাকেন? কি করচেন সেখানে ?
রতন মুখ তুলিয়া বলিল, সে খবরে আপনার দরকার?
ঠাকুর্দা ঈষৎ হাস্য করিয়া বলিলেন, রাগ করো কেন বাপু, রাগের ত কিছু নেই। গাঁয়ের মেয়ে কিনা, তাই খবরটা জানতে ইচ্ছে করে। হয়ত তাঁর কাছে গিয়ে পড়তেই বা হয়। তা ভাল আছে ত?
রতন উত্তর না দিয়া চলিয়া গেল এবং মিনিট-দুই পরেই কলিকায় ফুঁ দিতে দিতে ফিরিয়া আসিয়া হুঁকাটা তাঁহার হাতে দিয়া চলিয়া যাইতেছিল, ঠাকুর্দা সবলে কয়েকটা টান দিয়াই উঠিয়া দাঁড়াইলেন,—দাঁড়াও ত বাপু, পায়খানাটা একবার দেখিয়ে দেবে। ভোরেই বেরিয়ে পড়তে হয়েছিল কিনা! বলিতে বলিতে তিনি রতনের আগেই ব্যস্ত-দ্রুতপদে ঘর হইতে বাহির হইয়া গেলেন।
পুঁটু মুখ ফিরিয়া চাহিল, কহিল, দাদামশায়ের কথা আপনি বিশ্বাস করবেন না। বাবা হাজার টাকা কোথায় পাবেন যে দেবেন? অমনি করে পরের গয়না চেয়ে দিদির বিয়ে,— এখন তারা দিদিকে আর নেয় না। তারা বলে, ছেলের আবার বিয়ে দেবে।
এই মেয়েটি এত কথা আমার সঙ্গে পূর্বে কহে নাই; কিছু আশ্চর্য হইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, তোমার বাবা সত্যিই কি হাজার টাকা দিতে পারেন না?
পুঁটু ঘাড় নাড়িয়া বলিল, কখ্খনো না। বাবা রেলে চল্লিশ টাকা মোটে মাইনে পান, আমার ছোটভাইয়ের ইস্কুলের মাইনের জন্যে আর পড়াই হ’ল না। সে কত কাঁদে।বলিতে বলিতে তাহার চোখ-দুটি ছলছল করিয়া আসিল।
প্রশ্ন করিলাম, তোমার কি শুধু টাকার জন্যেই বিয়ে হচ্ছে না?
পুঁটু কহিল, হাঁ, তাই ত। আমাদের গাঁয়ের অমূল্যবাবুর সঙ্গে বাবা সম্বন্ধ করেছিলেন। তার মেয়েরাই আমার চেয়ে অনেক বড়। মা জলে ডুবে মরতে গিয়েছিলেন বলেই ত সে বিয়ে বন্ধ হ’ল। এবারে বাবা বোধ হয় আর কারু কথা শুনবেন না, সেইখানেই আমার বিয়ে দেবেন।