কে, ও দুর্গা এলি নাকি? তা আয় আয়।
দুর্গা কাঁদিতে কাঁদিতে অগ্রসর হইয়া দাদার পদমূলে প্রণাম করিলেন।
জ্ঞানদা প্রণাম করিলে, কহিলেন, এটি বুঝি মেয়ে? তা বিয়ে দিলি কোথায়?
দুর্গা কুণ্ঠিত-স্বরে কহিলেন, বিয়ে এখনও দিতে পারিনি দাদা—যেখানে হোক শিগগিরই—
অ্যাঁ—বিয়ে দিসনি? এ যে একটা সোমত্ত মাগী রে দুর্গা? বহুকাল অদর্শনের পর ভগিনীর প্রতি তাঁহার ঈষৎ করুণ কণ্ঠস্বর এক মুহূর্তেই জমিয়া একেবারে কাঠ হইয়া গেল; বলিলেন, তাই ত, এখানকার আবার যে-সব বজ্জাত লোক—তা জানতে পেলে—তা আমি বলি কি, ওকে হেঁসেল-টেসেল ঠাকুরঘরদোরে ঢুকতে দিয়ে কাজ নেই—জানিস ত এদেশের সমাজ! বিশেষ হরিপাল—এমন পাজী জায়গা কি ভূ-ভারতে আছে? তা আয়, বাড়ির ভিতরে আয়। এতবড় মেয়ে—ওর কাকার কাছে রেখে এলে স্বচ্ছন্দে তুই দু’দিন জুড়িয়ে যেতে পারতিস। এখানে থাকলে ত আর—বুঝলি নে দুর্গা—তা যা, এখন হাত-পা ধু গে—ওগো, কৈ গো,—বলিতে বলিতে শম্ভু চাটুয্যে পুনরায় খটখট করিয়া অন্দরে প্রবেশ করিলেন। দুর্গা এবং তাঁহার কন্যা যেমন করিয়া তাঁহার অনুসরণ করিয়া বাড়ি ঢুকিল সে শুধু ভগবানই দেখিলেন।
শম্ভুর এটি দ্বিতীয় পক্ষ। প্রথম পক্ষের বৌকে দুর্গা দেখিয়াছিলেন, কিন্তু ইহাকে দেখেন নাই। উপস্থিত ইনি যেমনই কাল, তেমনই রোগা এবং লম্বা। ম্যালেরিয়া জ্বরে রঙটা যেন পোড়াকাঠের মত। তিনদিনের গোবর উঠানের মাঝখানে জমা করা ছিল, তাহা এইমাত্র নিঃশেষ করিয়া ঘুঁটে দিয়া, হাত-পা ধুইয়া প্রদীপের জো করিতেছিলেন; স্বামীর আহ্বানে সম্মুখে আসিয়া ব্যাপার দেখিয়া থমকিয়া দাঁড়াইলেন। শম্ভুর জ্বর আসিতেছিল, আগন্তুকদিগের অভ্যর্থনার জন্য স্ত্রীর কাছে সংক্ষেপে ইহাদের পরিচয় দিয়া ঘরে গিয়া ঢুকিলেন। বৌয়ের নাম ভামিনী। মেদিনীপুর জেলার মেয়ে। কথাগুলো একটু বাঁকা-বাঁকা। সে হাসিয়া উপরের এবং নীচের সমস্ত মাড়ীটা অনাবৃত করিয়া ননদের হাত ধরিয়া রান্নাঘরের দাওয়ায় লইয়া গিয়া পিঁড়ি পাতিয়া বসাইলেন। তাঁহার হাসি এবং কথার শ্রী দেখিয়া দুর্গার বুকের ভিতর পর্যন্ত শুকাইয়া উঠিল। আসিবার সময় দুর্গা একহাঁড়ি রসগোল্লা আনাইয়াছিলেন, সেটা নামাইতে না নামাইতে এক পাল ছেলে-মেয়ে কোথা হইতে যেন পঙ্গপালের মত ছুটিয়া আসিয়া ছেঁকিয়া ধরিল। চেঁচাচেচি ঠ্যালাঠেলি—সে যেন একটা হাট বসিয়া গেল। তাহাদের মা ইহাকে আধখানি, উহাকে সিকিখানি, আর দু’জনকে দু’টুকরা বাঁটিয়া দিয়া হাঁড়িটা ছোঁ মারিয়া তুলিয়া লইয়া গিয়া শোবার ঘরের শিকায় টাঙ্গাইয়া রাখিলেন। ছেলেগুলো যে যাহা পাইয়াছিল, অমৃতবৎ গিলিয়া ফেলিয়া, হাতের রস চাটিতে চাটিতে প্রস্থান করিল।
দুর্গা এখানকার রীতিনীতি কতক জানিতেন, কারণ তিনি এই গ্রামের মেয়ে। কিন্তু জ্ঞানদা আট-দশ বছরের ছেলেগুলাকে পর্যন্ত সম্পূর্ণ দিগম্বর দেখিয়া লজ্জায় মাথা হেঁট করিয়া রহিল। মেয়েগুলারও প্রায় ঐ দশা। ইতরবিশেষ যাহা আছে, তাহা নিতান্তই অকিঞ্চিৎকর। তাহাদের নিজেদের গ্রামটাও শহর নয় বটে কিন্তু সেখানে রাস্তাঘাট আছে; এমন আম, কাঁঠাল ও বাঁশঝাড়ে মাথার উপর অন্ধকার করিয়া নাই। এরূপ গোবর ও পাট-পচা গন্ধ চতুর্দিক হইতে আসিয়া শ্বাস-প্রশ্বাসের ক্রিয়াকে ভারাক্রান্ত, ব্যাকুল করিয়া দেয় না। তখনও অন্ধকার হয় নাই, একটা শৃগাল উঠানের উপর আসিয়া দাঁড়াইতেই বড়ছেলেটা তাড়া করিয়া গেল। চারিদিকে অসংখ্য ঝিঁঝিঁ পোকা বিকট শব্দ শুরু করিয়া দিল। দেয়ালের গায়ে একটা শুকনা ডালে হঠাৎ অশ্রুতপূর্ব একপ্রকার বিশ্রী শব্দ শুনিয়া জ্ঞানদা সভয়ে চুপি চুপি কহিল, ও কি ডাকে মা? মামী শুনিতে পাইয়া কহিলেন, ও যে তোক্ষোপ।
জ্ঞানদা শিহরিয়া জিজ্ঞাসা করিল, তোক্ষোপ কি? তক্ষক সাপ?
মামী বলিলেন, হাঁ মা, তাই। ঐ যে কোন্ রাজাকে কামড়েছিল বলে। —গাছে গাছে একেবারে ভরা!
জবাব শুনিয়া জ্ঞানদা মায়ের মুখের প্রতি একবার চাহিল। ইতিপূর্বে কান্নায় তাহার সমস্ত বক্ষ পরিপূর্ণ হইয়া গিয়াছিল। এইবার সে জননীর কোলের উপর লুটাইয়া পড়িয়া একেবারে ফুঁপাইয়া কাঁদিয়া উঠিল, কহিল, এখান থেকে চল মা—এখানে আমি একদণ্ডও বাঁচব না।
মামী আশ্চর্য হইলেন। বলিলেন, ভয় কি গো, ওরা যে দেবতা। কখ্খনো কারুর অপকার করে না। আর সাপখোপের কামড়ে কটা লোক মরে বাছা? বরঞ্চ, ভয় যা তা ঐ ম্যালোয়ারীর। একবার ধরলে, আর তাতে বস্তু রেখে ছাড়ে না। এ-বছর দিন-কুড়ি হ’ল তোমার মামাকে ধরেচে—এরই মধ্যে যেন শতজীর্ণ করে ফেলেচে, আর দিনকতক পরে কে কার মুখে জল দেবে মা, এ-গাঁয়ে তার ঠিক থাকবে না।
জ্ঞানদা মনে মনে অতুলের শেষ কথাগুলো মিলাইয়া লইয়া নীরবে পড়িয়া রহিল। সে-রাত্রে সে একবারও ঘুমাইতে পারিল না। মায়ের বুকের কাছে মুখ রাখিয়া বারংবার চমকাইয়া উঠিতে লাগিল। এমনি করিয়া প্রভাত হইল; নূতন স্থানে নূতন আলো চোখে পড়ায় বিন্দুমাত্রও তাহার আনন্দোদয় হইল না—বরঞ্চ সমস্ত আবহাওয়া, আলো, বাতাস যেন কালকের চেয়েও বেশি করিয়া তাহাকে চাপিয়া ধরিল।
এতবড় আইবুড়ো মেয়ে দেখিয়া পাড়ার লোক ভয়ানক আশ্চর্য হইয়া গেল। আমাদের বাঙ্গালাদেশে মেয়ের বয়স ঠিক করিয়া বলার রীতি নাই। সবাই জানে, বাপ-মাকে দু-এক বছর হাতে রাখিয়া বলিতে হয়। সুতরাং দুর্গা যখন বলিলেন, তের, তখন সবাই বুঝিল পনর। তা ছাড়া একমাত্র সন্তান বলিয়া, নিজেরা না খাইয়া মেয়েকে খাওয়াইয়াছিলেন, পরাইয়াছিলেন—সেই নিটোল স্বাস্থ্যই এখন আরও কাল হইল—জ্ঞানদার যথার্থ বয়সের বিরুদ্ধে ইহাই বেশি করিয়া সাক্ষ্য দিতে লাগিল।