এই চিরদিন শান্ত পরমসহিষ্ণু মেয়েটি উৎকট কিছু যে করিয়া বসিতে পারে, সে ভয় কাহারও ছিল না। অতুলেরও না। তথাপি তাহাকে খরস্রোতের একান্ত সন্নিকটে গিয়া বসিতে দেখিয়া, তাহার বুকের ভিতরটা কেমন একরকম করিয়া উঠিল। একবার ভাবিল নিষেধ করে; একবার ভাবিল কাছে গিয়া দাঁড়ায়; কিন্তু লজ্জায়, কুণ্ঠায় কোনটাই পারিল না।
অগ্ন্যুত্তাপ বাঁচাইয়া সবাই গিয়া যেখানে বাসিয়াছিল, অতুলও গিয়া সেখানে বসিল। সম্মুখে প্রজ্জ্বলিত চিতার পানে চাহিয়া সহসা তাহার মনের মধ্যে সেই চিরদিনের পুরানো প্রশ্ন আবার নূতন করিয়া জাগিয়া উঠিল—কাল যে ছিল, আজ সে নাই; আজও যে ছিল, তাহারও ঐ নশ্বর দেহটা ধীরে ধীরে ভস্মসাৎ হইতেছে, আর তাহাকে চেনাই যায় না; অথচ, এই দেহটাকেই আশ্রয় করিয়া কত আশা, কত আকাঙ্ক্ষা, কত ভয়, কত ভাবনাই না ছিল! কোথায় গেল? এক নিমিষে কোথায় অন্তর্হিত হইল? তবে কি তার দাম? মরিতেই বা কতক্ষণ লাগে?
সহসা তাহার নিজেরই বিগত জীবন চোখের উপর ভাসিয়া উঠিল। বছর-তিনেক পূর্বে সেও ত মরিতে বসিয়াছিল, কিন্তু মরে নাই। অজ্ঞাতসারে তাহার চোখের দৃষ্টি চিতার পিঙ্গল ধূসর ধূমের তরঙ্গিত যবনিকা ভেদ করিয়া চলিয়া গেল। মনে পড়িল, সেদিন যে মরিতে দেয় নাই—সে ওই, ওই যে জাহ্নবীর ঘোলা জলে অস্পষ্ট ছায়া ফেলিয়া মূর্তিমতী শোকের মত বসিয়া আছে,––শুধু রুক্ষ কেশ ও মলিন অঞ্চল যাহার বাতাসে দুলিতেছে!
তাহার দুই চক্ষু অশ্রুপূর্ণ হইয়া উঠিল। মনে মনে বলিল, ছাই রূপ! রূপেরই যদি এত দাম, তবে তিন বৎসর পূর্বে রূপের হাটে সে নিজেই ত দেউলিয়া হইয়া গিয়াছিল। সেদিন পরমাত্মীয়েরাও ত ঘৃণায় তাহার পানে চাহিতে পারে নাই!
কেমন করিয়া যে সময় কাটিতেছিল, তাহার জ্ঞান ছিল না। কখন যে চিতা নিভিতেছিল, তাহাও সে দেখে নাই। সর্বক্ষণ তাহার সমস্ত দৃষ্টি শুধু ওই নিশ্চল মূর্তিটার প্রতি নিবদ্ধ হইয়া ছিল।
অনাথ কহিলেন, আর বসে কেন বাবা? এসো, শেষ কাজটা শেষ করে দিই।
চলুন, বলিয়া অতুল অপরাহ্নবেলায় স্বপ্ন ভাঙ্গিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল।
তখন সূর্য ঢলিয়া পড়িতেছিল। সেই ম্লান আলোকে দীপ্যমান ঘাটের উপরে নিপতিত দু’গাছি ভাঙ্গা চুড়ির উপর দৃষ্টি পড়ায় সে স্তব্ধ হইয়া দাঁড়াইল। এ সেই তাহারই দেওয়া অতি তুচ্ছ মহামূল্য অলঙ্কার।
শত লাঞ্ছনা, সহস্র ধিক্কারেও যে দু’গাছির মায়া জ্ঞানদা কাটাইতে পারে নাই, আজ নিজের হাতে ভাঙ্গিয়া ফেলিয়া তাহার কৈফিয়ত দিয়াছে। অতুল দ্রুতপদে অগ্রসর হইয়া আসিয়া সেই দু’গাছি সস্নেহে, সযত্নে কুড়াইয়া লইল। অখণ্ড অবস্থায় যাহার কোন মর্যাদাই সে দেয় নাই, আজ তাহা ভগ্ন তুচ্ছ কাঁচখণ্ড হইয়াও তাহার কাছে একেবারে অমূল্য হইয়া উঠিল।
পিছনে পদধ্বনি শুনিয়া জ্ঞানদা মুখ ফিরিয়া চাহিল। সে চাহনি অতুল সহ্য করিতে পারিল না। বোধ করি বা একবার সে যেন তাহার হাত ধরিতেও গেল, কিন্তু আত্মসংবরণ করিয়া বলিল,—ভুল সকলেরই হয়, জ্ঞানদা, কিন্তু—, বলিয়া সে হাতের মুঠাটা মেলিয়া ধরিতেই সায়াহ্নের আরক্ত আভায় আর একবার সেই কাঁচখণ্ডগুলি ঝকঝক করিয়া জ্বলিয়া উঠিল। কহিল, আজ যাকে তুমি ভেঙ্গে ফেলে দিয়ে এলে, আমি তাকেই আবার শ্মশান থেকে কুড়িয়ে নিয়ে এলুম।
কথাটা জ্ঞানদা বুঝিতে পারিল না, তাই সে তাহার নিবিড় শোকাচ্ছন্ন উদাস দৃষ্টি অতুলের মুখের প্রতি তুলিয়া আজ অনেক দিনের পরে আবার কথা কহিল, মৃদুকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিল, কেন?
জবাব দিতে গিয়া অতুলের দু’চক্ষু সহসা অশ্রুপূর্ণ হইয়া উঠিল। কিন্তু সামলাইয়া লইয়া বলিল, জ্ঞানো, আজ মেজমাসিমার চিতার আগুনের মধ্যে একটা জিনিস আমি স্পষ্ট দেখতে পেয়েচি, যা ভাঙ্গবার নয়, তাকে কিছুতেই জোর করে ভাঙ্গা যায় না। জোর করে কাঁচের চুড়িই ভাঙ্গা যায়, কিন্তু, আমাদের সেই দেওয়া-নেওয়াটা আজও তেমনি অটুট হয়ে আছে—তাকে ভেঙ্গে ফেলি, এত জোর তোমার আমার কারও নেই। আমি যা পারিনি, তুমিও তা পারবে না নিশ্চয় জানতে পেরেচি বলেই এই ভাঙ্গা চুড়ি বুকে করে তুলে নিয়ে বাড়ি যাচ্ছি। জ্ঞানদা হতচেতনের মত নির্নিমেষ চক্ষে চাহিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। অতুল অকস্মাৎ দুই হাত বাড়াইয়া তাহার শীর্ণ ডান হাতখানি নিজের হাতের মধ্যে টানিয়া লইল, কিন্তু জ্ঞানদা তেমনি পাথরের মূর্তির মত স্থির হইয়াই রহিল। অতুল ক্ষণকাল নিঃশব্দে থাকিয়া অশ্রুরুদ্ধ-কণ্ঠে বলিয়া উঠিল, আমার সমস্ত পাপের গুরুদণ্ড আর যেই দিক জ্ঞানো, তুমি দেবার চেষ্টা ক’রো না। আমি যত অপরাধই করে থাকি না কেন, আমাকে তোমার ফিরে নিতেই হবে। আমাকে ত্যাগ করে শাস্তি দেবে এ সাধ্য তোমার কিছুতেই নেই।
এতক্ষণে জ্ঞানদা মাথা হেঁট করিল, কিন্তু মুখ দিয়া তাহার ফুটিল না—শুধু দুর্বল শীর্ণ হাতটি অতুলের হাতের মধ্যে একবার শিহরিয়া কাঁপিয়া উঠিল। কয়েক মুহূর্ত উভয়েই স্তব্ধ হইয়া থাকিয়া অতুল হাতখানি ধীরে ধীরে ছাড়িয়া দিয়া বলিল, বাড়ি চল, তাঁরা সবাই এগিয়ে গেছেন।