মাতার নির্দেশমত জ্ঞানদা টিনের বাক্স খুলিয়া বহুদিন পূর্বের একটুকরা সাবান বাহির করিয়া গামছা লইয়া ম্লানমুখে পুকুরে চলিয়া গেল। মা বলিতে লাগিলেন, বেশ করে একটু রোগড়ে রোগড়ে ধুস মা, তাচ্ছিল্য করিস নে, চট্ করে আসিস মা—বলা যায় না ত, কখন তাঁরা সব এসে পড়বেন।
পুকুর হইতে ফিরিয়া আসিয়া জ্ঞানদা অবাক হইয়া গেল। মরণাপন্ন মা ইতিমধ্যে কখন বিছানা হইতে উঠিয়া কেমন করিয়া কি জানি তোরঙ্গের কাছে গিয়া, সেটা খুলিয়াছেন এবং নিজের একখানি ছোপান কাপড় এবং জামা বাহির করিয়া বসিয়া আছেন। মেয়ে আসিতেই বলিলেন, ভুল হয়ে গেল রে, মাথাটা বেঁধে দিলাম না, গা ধুয়ে এলি—তা হোক, ব’স। চট করে বেঁধে দিই।
মেয়ে কাতর হইয়া বলিল, না মা, তোমার পায়ে পড়ি, তুমি পারবে না মা, শোও, আমি আপনি বেঁধে নিচ্চি। দোহাই মা তোমার।
মেয়ের কথা শুনিয়া আজ মা একটুখানি হাসিলেন; ঘাড় নাড়িয়া বলিলেন, হুঃ! পারব না! জানিস গেনি, এই মেজবৌয়ের হাতে চুল বাঁধবার জন্যে পাড়ার মেয়ে ঝেঁটিয়ে আসত। আমি পারব না চুল বাঁধতে? নে, আয় দেরি করিস নে। বলিয়া জোর করিয়া কাছে বসাইয়া সযত্নে সস্নেহে স্বহস্তে পরিপাটি করিয়া, বোধ করি এই তাঁহার শেষ সাজ সাজাইয়া দিলেন।
পায়ে আলতা, কপালে খয়েরের টিপ, ঠোঁটে রঙটুকু পর্যন্ত দিতে ভুলিলেন না, মুখখানি নাড়িয়া-চাড়িয়া একটি চুমা খাইয়া তাঁহার হঠাৎ মনে হইল,—কে বলে, মেয়ে আমার দেখতে ভাল নয়! একটু কালো কিন্তু কার মেয়ের এমন মুখ, এমন চোখ দুটি!
এটা তিনি ধরিতে পারিলেন না যে, কার মেয়ে মাকে এমন ভালবাসে? কার এমন মা-অন্ত প্রাণ? কোন্ মেয়ের হৃদয়ের এতবড় ভক্তি ও ভালবাসার দীপ্তি এমন করিয়া তাহার সমস্ত কুরূপ আবৃত করিয়া বাহিরে ফুটিয়া উঠে? এ-সকল তিনি টের পাইলেন না বটে, কিন্তু মেয়ের গায়ে একখানি অলঙ্কারও পরাইতে পারেন নাই বলিয়া ইতিপূর্বে যে ক্ষোভ জন্মিয়াছিল, কেমন করিয়া কখন যেন তাহা মুছিয়া গেল। গহনার অভাব একটা ভারী অভাব বলিয়া আজ আর তাঁহার চোখে পড়িল না।
তখনও অনেক বেলা ছিল, কিন্তু কোনমতেই আর তিনি শুইতে চাহিলেন না। সমস্ত দুঃখ ভুলিয়া মেয়েকে সম্মুখে লইয়া বসিয়া রহিলেন।
গেনিকে দেখিতে আসিবে শুনিয়া পাশের বাড়ির নীলকণ্ঠের পরিবার আসিলেন, তরঙ্গিণী ঠাকুরঝি আসিলেন। যথাসময়ে মেয়ের ডাক পড়িল, তাঁহারা গিয়া পাশের ঘর হইতে উঁকিঝুঁকি মারিতে লাগিলেন।
দৃষ্টির অন্তরালে একমাত্র উপযুক্ত সন্তানের অত্যন্ত কঠিন অস্ত্র-চিকিৎসা সম্পন্ন হইতে থাকিলে, তাহার মা যেমন করিয়া সময় কাটান, তেমনি করিয়া দুর্গা একাকী তাঁহার মলিন শয্যার উপর বসিয়া ছিলেন।
পাত্র এবং ঘটকঠাকুর জলযোগাদি সমাধা করিয়া বাহির হইলেন—তিনি টের পাইলেন। তাঁহাদের ঠিকাগাড়ি ছড়ছড় ঘড়ঘড় করিয়া চলিয়া গেল—তাহাও শুনিতে পাইলেন। তার পরে তরঙ্গিণী ঠাকুরঝি ঘরে ঢুকিয়া একটা মস্ত দীর্ঘশ্বাস ছাড়িয়া জানাইলেন, নাঃ—মেয়ে পছন্দ হ’লো না।
দুর্গা চোখ বুজিয়া শুইয়া পড়িলেন, একটি প্রশ্নও করিলেন না।
ঠাকুরঝি করুণস্বরে কহিতে লাগিলেন, ঐ হাড়গোড়-বার-করা মেয়ে কি কারো পছন্দ হয়? বলি মেজবৌ, গেনিকে দু’দিন খাওয়াও-মাখাও, একটু তাউত কর। আমরা ছেলেবেলা থেকে দেখচি ত, এই মেয়ে কি এমনই ছিল? জ্বরে জ্বরে বাছার হাড়-পাঁজরা বার করে ফেলেচে—একটা বছর সবুর করে যত্ন-আত্তি করে দেখ দিকি, ঐ মেয়ে আবার কেমন হয়! তখন পড়তে পাবে না।
সে ত ঠিক কথা। কিন্তু কৈ সে সুযোগ? টাকা কৈ? একটা বৎসর অপেক্ষা করিয়া তাহার অস্থিপঞ্জর ঢাকা দিবার সময় কোথায়? মেয়ে যে পনরোয় পড়িল। পিতৃপুরুষেরা প্রতিদিন যে নরকে গভীরতর কূপে নিমগ্ন হইতেছেন! বড় কুলীনের মেয়ে নয়, তাই গ্রামের লোক ‘জাতি মারিব’ বলিয়া যে অহর্নিশি চোখ রাঙ্গাইয়া শাসাইতেছে। প্রতীক্ষা করিবার আর তিলার্ধ অবসর নাই, বিদায় কর, বিদায় কর। যেমন করিয়া হোক, যাহার হাতে হোক—কাল তাহার বৈধব্য অনিবার্য জানিয়া হোক, অসহ্য দুঃখ ও চিরদারিদ্র্য চোখের উপর জাজ্বল্যমান দেখিয়া হোক, তাহাকে সঁপিয়া দিয়া জাতি-ধর্ম এবং পিতৃপুরুষের পারলৌকিক প্রাণ রক্ষা কর।
তখনো ঘরে সন্ধ্যার আলো জ্বালা হয় নাই। সেই অন্ধকারে লুকাইয়া জ্ঞানদা তাহার লাঞ্ছিত সাজসজ্জা খুলিয়া ফেলিবার জন্য নিঃশব্দে প্রবেশ করিল। দুর্গা মড়ার মত পড়িয়া রহিলেন। খানিক পরে সে হতভাগ্য কঠিন অপরাধীর মতো নীরবে মায়ের পদপ্রান্তে আসিয়া যখন বসিল, জননী জানিতে পারিয়াও সাড়া দিলেন না। তার পরে তেমনি নিঃশব্দে বহুক্ষণ অপেক্ষা করিয়া অভুক্ত পীড়িত কন্যা শ্রান্তির ভারে সেইখানেই ঢলিয়া ঘুমাইয়া পড়িল। সমস্ত অনুভব করিয়াও মায়ের প্রাণে আজ লেশমাত্র দয়ার সঞ্চার হইল না।
অরক্ষণীয়া – ১০
দশ
দুর্গার এমন অবস্থা যে, কখন কি ঘটে বলা যায় না। তাহার উপর যখন তিনি পাড়ার সর্বশাস্ত্রদর্শী প্রবীণাদের মুখে শুনিলেন, তাঁহার প্রাপ্তবয়স্কা অনূঢ়া কন্যা শুধু যে পিতৃপুরুষদিগেরই দিন দিন অধোগতি করিতেছে তাহা নহে,—তাহার নিজেরও মরণকালে সে কোন কাজেই আসিবে না—তাহার হাতের জল এবং আগুন উভয়ই অস্পৃশ্য—তখন শাস্ত্র শুনিয়া এই আসন্ন পরলোকযাত্রীর পাংশু মুখ কিছুক্ষণের জন্য একেবারে কাগজের মত সাদা হইয়া রহিল।
বহুদিন ধরিয়া অবিশ্রান্ত ঘা খাইয়া খাইয়া তাঁহার স্নেহের স্থানটা কি একপ্রকার যেন অসাড় হইয়া আসিতেছিল। যে মেয়ের প্রতি তাঁহার ভালবাসার অবধি ছিল না, সেই মেয়েকেই দেখিলে জ্বলিয়া উঠিতেছিলেন। আজ এই সংবাদ শোনার পর, তাঁহার পরলোকের কাঁটা এই মেয়েটার বিরুদ্ধে তাঁহার সমস্ত চিত্ত একেবারে পাষাণের মত কঠিন হইয়া গেল। মায়া-মমতার আর লেশমাত্র তথায় অবশিষ্ট রহিল না।