স্বর্ণ বলিলেন, না না, তা নয়; আজই সে মরচে না; কিন্তু বেশিদিন আর নেই, তা বলে দিচ্চি। বড় জোর দশ-পনর দিন। তার পরে ছ’মাস, একবছর ছুঁড়িটার বিয়ে দেবার জো থাকবে না—কিন্তু আমার মাধুরী-মায়ের বিয়ে আমি এই আষাঢ়ের মধ্যেই দেব—তা কারু কথা শুনব না | এমন খুঁজলে পাওয়া যাবে না। তা ছাড়া দেবার-থোবার কামড় নেই। ছেলে নিজে পছন্দ করেচে,—মা মাগী যে বলবেন—এ নেব, তা নেব, সে না হলে চলবে না—তার জো নেই| এমন সুবিধে কি আমি শেষকালে দেরি করতে গিয়ে নষ্ট করে ফেলব?
অনাথ সভয়ে ঘাড় নাড়িয়া কহিল, না না, সে কি হতে পারে! তুমি হলে আমার সংসারের কর্তা-গিন্নী সমস্তই। তোমার মেয়ের বিয়ে বোনপোর সঙ্গে দেবে—যেদিন খুশি দিয়ো, যা ইচ্ছে ক’রো, আমি কখনো ত তাতে না বলব না, বৌঠান।
স্বর্ণ সগর্বে বলিলেন, তা ত বলবে না, জানি। কখনো বলোওনি—আমার সে দেওর তুমি নও। তাতেই ত বলচি, এখন যা বলি কর। আর গড়িমসি ক’রো না, যাকে হোক ধরে-বেঁধে ওকে বিদায় কর। সে না করলে মাধুরীর বিয়ে কোনমতেই হতে পারবে না। এমনিই ত পাড়ার ব্যাটা-বেটীরা নানা কথা কইচে, তখন কি আবার একটা গোলমালে পড়ে যাব? মনে বেশ করে বুঝে দেখ, ও তোমারই ঘরের মড়া, ফেলবে ফ্যালো, না হয় পচা গন্ধে মরো।
কথাটা অনাথ ভাবিতে ভাবিতে অফিসে গেল এবং পরদিন হইতেই ঘরের মড়া ফেলিবার জন্য ছুটাছুটি করিয়া এমন দুই-চারিজন পাত্র ধরিয়া আনিতে লাগিল, যাহাদের পরিচয় নিজের মুখে দিতে গেলে বোধ করি স্বর্ণমঞ্জরীকেও দু’বার ঢোক গিলিতে হইত।
সেদিন দুপুরবেলা অনেক দিনের পর স্বর্ণ আসিয়া দুর্গার ঘরে ঢুকলেন—বলি, আজ কেমন আছ মেজবৌ?
দুর্গা কষ্টে পাশ ফিরিয়া হাতটা একটু উলটাইয়া কহিলেন, আর থাকা-থাকি দিদি! আশীর্বাদ কর, আর যেন বেশী দিন ভুগতে না হয়।
স্বর্ণ সহানুভূতির স্বরে বলিলেন, না না, ভয় কি? ভাল হয়ে যাবে বৈ কি।
দুর্গা চুপ করিয়া রহিলেন, প্রতিবাদ করিলেন না। স্বর্ণ তখন কাজের কথা পাড়িলেন। কহিলেন, তা মেয়ে বড় কিনা, পাত্তরটি নেহাত ছোঁড়া হলেও ত আর মানাবে না মেজবৌ। বাপ-মা নেই, তাই নিজেই ওবেলা মগরা থেকে দেখতে আসবেন, বলে পাঠিয়েচেন—বলা বাহুল্য, বাপ-মা অমর না হইলে আর পাত্রটির ও-বয়সে তাঁহাদের বাঁচিয়া থাকা চলে না। স্বর্ণ বলিতে লাগিলেন, এখন মা-কালী করেন, মেয়ে দেখে তার পছন্দ হয়, তবেই ত ছোটঠাকুরপোর ছুটাছুটি হাঁটাহাঁটি সার্থক হয়। তার পর আবার দেনা-পাওনার কথা—তা আমি বলি কি—
কথাটা শেষ না হইতেই দুর্গা আগ্রহে উঠিয়া বসিয়া ছলছল চক্ষে চাহিয়া বলিলেন, আশীর্বাদ কর দিদি, এই সম্বন্ধটি আর যেন ভেঙ্গে না যায়। আমি যেন দেখে যেতে পারি, বলিতে বলিতেই তাহার চোখ দিয়া দু’ফোঁটা জল গড়াইয়া পড়িল।
স্বর্ণ বলিলেন, আশীর্বাদ করচি বৈ কি মেজবৌ, দিনরাত ঠাকুরকে জানাচ্চি,—ঠাকুর, যা হোক মেয়েটার একটা কিনারা করে দাও। তা দেখব বৈ কি মেজবৌ—আমি বলচি, তুমি জামাইয়ের মুখ দেখে তবে—
দুর্গা নীরবে আঁচল দিয়া চোখ মুছিলেন। স্বর্ণ একটা হাই তুলিয়া, তুড়ি দিয়া একটু ইতস্ততঃ করিয়া কহিলেন, কাচ্চাবাচ্চার বাপ—ঐ শুনতে দেড় শ মাইনে—নইলে কিছু নেই, সব জানি ত। নিজের মেয়েটার কি করে যে দু’হাত এক করবে তাই ভেবে কাঠ হয়ে যাচ্চে। তার ওপর আবার এটি! বুঝতে সবই ত পার মেজবৌ,—তাই ঠাকুরপো বলছিল কি—লজ্জায় নিজে ত তোমাকে বলতে পারে না—বলছিল যে, তোমার অংশের বাড়িটা বাঁধা না দিলে ত আর খরচপত্রের যোগাড় হয়ে উঠবে না—তোমাকে নিজে কিছুই করতে হবে না, শুধু একটা ঢেরা-সই করে দেওয়া। শুধু হাতে কেউ ত আর ধার দিতে চায় না—পোড়া কলিকাল এমনি যে, তুমি মর আর বাঁচ, কেউ কারুকে বিশ্বাস করবে না—
দুর্গা তৎক্ষণাৎ বলিলেন, আমি আর ক’দিন দিদি, তোমরা আমাকে যা করতে বলবে, আমি তাই করব। শুধু এইটুকু দেখো দিদি, ও আমার না একবারে অকূলে ভেসে যায়।
না না, ভেসে যাবে কেন মেজবৌ? বাপ-খুড়ো, মা-জ্যাঠাই কি ভিন্ন? তা যদি হবে আমরাই বা কেন ওর জন্যে ভেবে ভেবে আহার-নিদ্রা ত্যাগ করব বল? আমার জ্ঞানদাও যা, মাধুরীও সেই পদার্থ। দে না মা জ্ঞানদা, তোর মায়ের চোখ দুটো মুছিয়ে। মাথায় একটু পাখা কর্ মা বসে। বলিয়া একাধারে আশা ও ভরসা দিয়া তিনি বাহির হইয়া গেলেন।
আজ বহুদিনের পর দুর্গার মৃত্যুমলিন মুখের উপর একটা আনন্দের দীপ্তি দেখা দিল। মেয়ের হাত হইতে পাখাটা টানিয়া লইয়া, নিজে শীর্ণ হাতখানি তাহার মাথায় মুখে বুলাইয়া স্নিগ্ধকণ্ঠে কহিলেন, এইখানে শুয়ে একটু ঘুমো দিকি মা! বলিয়া জোর করিয়া নিজের বুকের কাছে টানিয়া লইয়া বলিতে লাগিলেন, এমন পোড়াকপালীর পেটে তুই জন্মেছিলি মা, যে এই বয়সেই খেটে খেটে, আর ভেবে ভেবে শরীর পাত করলি। যদি জন্মই নিয়েছিলি, ছেলে হয়ে কেন জন্মাস নি মা!
অনেকদিন পর জননীর আদর পাইয়া মেয়ের দুই চোখ দিয়া নীরবে অশ্রু ঝরিয়া পড়িতে লাগিল। কিছুক্ষণের জন্য উভয়েই বোধ করি একটুখানি ঘুমাইয়া পড়িয়াছিলেন, হঠাৎ মায়ের ঠেলা খাইয়া জ্ঞানদা শশব্যস্তে উঠিয়া বসিল।
ও মা, ওঠ ওঠ; বেলা যে আর নেই। আমার টিনের বাক্সটার মধ্যে বোধ করি একটুখানি সাবান আছে—যা দিকি মা, চট করে পুকুর থেকে মুখ হাত পা ধুয়ে আয়। না বাছা, ঐ তোর বড় দোষ—তুই কথা শুনতে চাসনে। বলচি, যা শিগগির।