চৈত্রের শেষের কয়টা দিন বলিয়া ছোটবৌয়ের বাপের বাড়ি যাওয়া হয় নাই। মাসটা শেষ হইতেই তাহার ছোটভাই তাহাকে এবং মাধুরীকে লইয়া যাইবার জন্য আসিয়া উপস্থিত হইল।
আজ ভাল দিন—খাওয়া-দাওয়ার পরেই যাত্রার সময়। অতুল বাড়ি আসিয়াছিল বলিয়া স্বর্ণ তাহাকেও নিমন্ত্রণ করিয়াছিলেন।
দুপুরবেলা এই দুটি যুবক আহারে বসিল, স্বর্ণ কাছে আসিয়া বসিলেন। শখ করিয়া তিনি মাধুরীর উপর পরিবেশনের ভার দিয়াছিলেন। সকালবেলা আঁশ-রান্নাটা জ্ঞানদাকে দিয়াই রাঁধাইয়া লওয়া হইত, কিন্তু তাহা গোপনে। বাহিরের কেহ জিজ্ঞাসা করিলেই স্বর্ণ অসঙ্কোচে কহিতেন, মা গো! সে কি কথা! ওকে যে আমরা রান্নাঘরেই ঢুকতে দিইনে; সুতরাং পরিবেশন করা তাহার পক্ষে একেবারে নিষিদ্ধ ছিল। তাছাড়া নিজের লজ্জাতেই সে কাহারও সাক্ষাতে বাহির হইত না—যতদূর সাধ্য ঘরের বাহিরের সকলের দৃষ্টি এড়াইয়াই সে চলিত।
অতুলের সহিত মাধুরীর বিবাহ হইবে। তাই, এই সুন্দরী মেয়েটি সর্বাঙ্গে সাজসজ্জা এবং ব্রহ্মাণ্ডের লজ্জা জড়াইয়া লইয়া অপটু হস্তে যখন পরিবেশন করিতে গিয়া কেবলি ভুল করিতে লাগিল—এবং জ্যাঠাইমা সস্নেহ-অনুযোগের স্বরে, কখনো বা ‘পোড়ামুখী’ বলিয়া, কখনো বা ‘হতভাগী’ বলিয়া, হাসিয়া তামাশা করিয়া কাজ শিখাইতে লাগিলেন—তখন বিশ্বের পায়ে-ঠেলা আর একটি মেয়ে ইহারই জন্য রন্ধনশালায় নিভৃতে একান্তে বসিয়া মাথা হেঁট করিয়া সর্বপ্রকার আহার্য গুছাইয়া দিতে লাগিল।
স্বর্ণ মাধুরীর বিবাহের কথা তুলিতেই সে ছুটিয়া রান্নাঘরে আসিয়া উপস্থিত হইল। জ্ঞানদা জিজ্ঞাসা করিল, কি চাই ভাই?
কিছু না দিদি; আমি আর পারিনে। বলিয়া হাতের খালি থালাটা দুম করিয়া মাটিতে নিক্ষেপ করিয়া ছুটিয়া পলাইয়া গেল।
পরক্ষণেই স্বর্ণ চেঁচাইয়া ডাকিলেন, একটু নুন দিয়ে যা দেখি মা। কিন্তু নুন লইবার জন্য মাধুরী ফিরিয়া আসিল না। তিনি আবার ডাকিলেন, কৈ রে—তোর ছোটমামা যে বসে আছে। তথাপি কেহ ফিরিল না। এবার তিনি রাগ করিয়া উচ্চকণ্ঠে বলিলেন,—কথা কি কারু কানে যায় না? এরা কি উঠে যাবে নাকি?
তবুও যখন মাধুরী ফিরিয়া আসিল না, তখন জ্ঞানদা আর চুপ করিয়া বসিয়া থাকিতে পারিল না। ভাবিল, নুন জিনিসটা ত আর ছোঁয়া যায় না—তাই বোধ করি, এ আদেশটা তাহারই উপরে হইয়াছে।
তখন মলিন শতচ্ছিন্ন পরিধেয়খানিতে সর্বাঙ্গ সতর্কে আচ্ছাদিত করিয়া লইয়া, সে নুন হাতে করিয়া ধীরে ধীরে দোরগোড়ায় আসিয়া দাঁড়াইল। ছেলে দুটি তাহাকে দেখিতে পাইল না। জ্যাঠাইমা তাহার আপাদমস্তক বার-দুই নিরীক্ষণ করিয়া মৃদু কঠোর স্বরে প্রশ্ন করিলেন, তোমাকে আনতে কে বললে? মাধুরী কৈ?
জ্ঞানদা ঘরের বাহির হইতেই চুপি চুপি বলিল, কি জানি কোথায় গেল।
তাই তুমি এলে? এক কথা তোমাকে কতবার মনে করিয়া দিতে হবে যে, তোমার মুখ দেখলে সাত পুরুষ নরকস্থ হয়? আমার সুমুখে তুমি এস না। ঐ যে অতুল খেতে এসেচে কিনা, তাই তোমার সামনে আসাই চাই? না? নুনের পাত্রটা ঐখানে রেখে দিয়ে যাও।
পাত্রটা রাখিয়া দিয়া জ্ঞানদা চলিয়া গেল। সে শুদ্ধ এইজন্যই যাইতে পারিল যে, মা বসুন্ধরা দ্বিধা হইয়া তাহাকে গ্রহণ করিলেন না।
স্বর্ণ স্বয়ং উঠিয়া নুন পরিবেশন করিলেন এবং স্বস্থানে বসিয়া অতুলের পানে চাহিয়া কহিলেন, তুই ব্যাটাছেলে, পুরুষমানুষ—তোর আবার লজ্জা কি যে ঘাড় হেঁট করে বসে আছিস! খা।
মাধুরীর মামা প্রশ্ন করিল, ও কে দিদি?
স্বর্ণ একটুখানি হাসিয়া কহিলেন, ও কিছু না—তোমরা খাও|
কিন্তু অতুলের সমস্ত খাবার বিস্বাদ হইয়া গেল। লুচির টুকরা কিছুতেই যেন সে গিলিতে পারিল না। গিলিবে কি করিয়া? আজ সে মাধুরীকে দেখিয়া ভুলিয়াছে, তাহাতে ভুল নাই; কিন্তু জ্ঞানদাকেও ত সে চিনিত। এখনও জ্ঞানদা তাহাকে ভালবাসে কি ঘৃণা করে, যদিচ ঠিক জানিত না, কিন্তু একদিন সে যে তাহাকেই প্রাণাপেক্ষা ভালবাসিত তাহা ত জানে। কিন্তু তেমন দিনেও যে কখনো গায়ে পড়িয়া তাহার সুমুখে আসিবার চেষ্টা করে নাই, আজ সে যে তাহাই করিতে আসিয়াছে—এতবড় নির্লজ্জ অপবাদ সে এত সত্বর বিশ্বাস করিবে কি করিয়া?
অপরাহ্নবেলায় ছোটবৌ মেয়ে লইয়া বাপের বাড়ি চলিয়া গেল। কিন্তু যাইবার সময় মেজজায়ের সহিত দেখা করিয়া গেল না। শুধু একমুহূর্তের জন্য রান্নাঘরে ঢুকিয়া জ্ঞানদার হাতে একখানি দশটাকার নোট গুঁজিয়া দিয়া, অনেকটা যেন চোরের মত পলাইয়া গেল। দাঁড়াইয়া তাহার প্রণামটা পর্যন্ত গ্রহণ করিল না।
বাটীর মধ্যে শুধু এই একটা লোক,—যে এই দুর্ভাগা মেয়েটার ভিতরটা দেখিতে পাইয়াছিল—সেও আজ কি জানি, কতদিনের জন্য স্থানান্তরে চলিয়া গেল। থাকিয়াও সে যে বিশেষ কিছু করিয়াছিল তাহা নয়—ব্যথা পাওয়া এবং ব্যথা দূর করিবার জন্য সচেষ্ট হইয়া কাজ করা, এক জিনিস নয়—সকলে তাহা পারে না, তবুও ছোটখুড়ীমাকে চলিয়া যাইতে দেখিয়া নিবিড় অন্ধকারে এই মেয়েটার সমস্ত অন্তর পরিপূর্ণ হইয়া গেল।
বৈশাখের মাঝামাঝি একটা দিনে অনাথের অফিস যাইবার সময় বড়বৌ মুখের উপর সংসারের সমস্ত দুশ্চিন্তা লইয়া আসিয়া দাঁড়াইলেন।
অনাথ ভীত হইয়া কহিল, কি হয়েছে বৌঠান?
স্বর্ণ কহিলেন, তুমি করচ কি ঠাকুরপো; মেজবৌয়ের যে হয়ে এলো!
অনাথ হাতের হুঁকাটা ঠিক করিয়া রাখিয়া দিয়া পাংশু-মুখে কহিল, বল কি? কৈ আমি ত কিছু জানিনে!