দুর্গা সেইমাত্র উঠিয়া ঘরের সুমুখে বসিয়াছিলেন—চেঁচামেচি শুনিয়া সভয়ে চাহিয়া রহিলেন।
ছোটবৌ ঘর হইতে বাহির হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, কি হয়েছে দিদি?
স্বর্ণ কাহারো প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করিয়া, সেই নির্বাক নিস্পন্দ মেয়েটিকে লক্ষ্য করিয়া তিরস্কার করিতে লাগিলেন—হাতে করে থালা নিয়ে গেলে কাকা খুশি হয়ে তোমাকে মাথায় করে নিয়ে নাচবে—রাজপুত্তুর এনে বিয়ে দেবে, না? এই বয়সে কি মন যোগাতেই শিখেছিস মাইরি! বলিয়া থালাটা ছিনাইয়া লইয়া চলিয়া গেলেন।
দুর্গা সহস্র জ্বালায় জ্বলিয়া ক্রমশঃই অসহিষ্ণু হইয়া উঠিতেছিলেন; মেয়েকে উদ্দেশ করিয়া কাঁদিয়া কহিলেন, পোড়ারমুখী, গুরুজনের কথা শুনবি নে যদি, তোর মরণ হয় না কেন!
জ্ঞানদা নীরবে রান্নাঘরে চলিয়া গেল। একবার বলিল না, এ-বিষয়ে তাহাকে কেহই নিষেধ করিয়া দেয় নাই। মুখ তুলিয়া প্রতিবাদ করিতে সে বোধ করি জানিতই না।
প্রতিবাদ যে করিতে পারিত, সে ছোটবৌ। কিন্তু সে বড়জাকে চিনিত বলিয়া কথা কহিল না। বড়জা যেমন মুখরা, তেমনি আত্মমর্যাদাজ্ঞানশূন্যা। মুখের উপর তাহার সহস্র দোষ দেখাইয়া দিলেও লজ্জা পাইবে না; বরঞ্চ অধিকতর নিষ্ঠুর হইয়া যন্ত্রণা দিবে জানিয়াই, ছোটবৌ নীরবে জ্ঞানদার অনুসরণ করিয়া রান্নাঘরে আসিয়া সস্নেহে সযত্নে তাহার হাতখানি ধরিয়া কহিল, দিদির কথাটা কেন শুনিস নি মা?
এতক্ষণের এত কঠোর লাঞ্ছনা সে সহিয়াছিল, কিন্তু সেই স্নেহের অনুযোগ সহিতে পারিল না। একটিবার মাত্র চোখ তুলিয়া ছোটখুড়ীর মুখের পানে চাহিয়াই সে তাহার পদতলে ভাঙ্গিয়া পড়িল—আমাকে কেউ নিষেধ করে দেয়নি খুড়ীমা, বলিয়া উচ্ছ্বসিত হইয়া কাঁদিয়া ফেলিল।
ছোটখুড়ী কাছে বসিয়া তাহার চোখ মুছাইয়া দিল, কিন্তু কি বলিয়া যে এই মেয়েটাকে সান্ত্বনা দিবে তাহা ভাবিয়া পাইল না।
এমনি করিয়া এই শ্রীহীনা হতভাগ্য অনূঢ়া কন্যার দিন কাটিতে লাগিল। ঘরে-বাইরে আত্মীয়-পর সবাই মিলিয়া অনুক্ষণ কেবল লাঞ্ছনা দিতেই লাগিল, কিন্তু পরিত্রাণ করিবার কেহ চেষ্টামাত্রও করিল না।
অরক্ষণীয়া – ০৭
সাত
আজকাল ধরিয়া না তুলিলে দুর্গা প্রায় উঠিতেই পারিতেন না। মেয়ে ছাড়া তাঁহার কোন উপায়ই ছিল না। তাই সহস্র কর্মের মধ্যেও জ্ঞানদা যখন-তখন ঘরে ঢুকিয়া মায়ের কাছে বসিত। আজিকার সকালেও একটুখানি ফাঁক পাইয়া, কাছে বসিয়া আস্তে আস্তে মায়ের পিঠে হাত বুলাইয়া দিতেছিল। সহসা একটা অত্যন্ত সুপরিচিত কণ্ঠস্বরে তাহার বুকের ভিতর ধক করিয়া উঠিল।
দোলের দিন। ছুটির বন্ধে অতুল বাড়ি আসিয়াছিল। দুই-তিনজন পাড়ার সঙ্গী লইয়া রঙ মাখিয়া পকেট ভরিয়া আবীর লইয়া সে ‘মাসিমা’ বলিয়া উচ্চকণ্ঠে ডাক দিয়া বাড়ি ঢুকিল।
দুর্গা তন্দ্রায় জাগরণে সারাদিন একপ্রকার আচ্ছন্নের মত পড়িয়া থাকিতেন। পাছে কণ্ঠস্বর কানে গেলে মা সজাগ হইয়া উঠেন, এই ভয়ে জ্ঞানদা ত্রস্ত হইয়া উঠিল। মনে মনে ইনি যে এই লোকটিরই প্রতীক্ষা করিতেছেন, তাহা সে জানিত। অথচ, তাঁহার সেই স্বাভাবিক ধৈর্য, গাম্ভীর্য, আত্মসম্মান আর যেন ছিল না। বুদ্ধি-বিবেচনাও কেমন যেন দ্রুত বিকৃত হইয়া উঠিতেছিল। তাহার যে জননী কলহের ছায়া দেখিলেও শঙ্কিত হইতেন, তিনি আজকাল ইহাতেও যেন বিমুখ নন—সে লক্ষ্য করিয়া দেখিতেছিল। সুতরাং, উভয়ের দেখা হইলেই একটা অত্যন্ত অশোভন কলহ যে অনিবার্য, এ-কথা তাহার অন্তর্যামী আজ বলিয়া দিলেন। কি করিলে যে এই বিপদ এড়াইতে পারা যায়, ভাবিয়া সে ব্যাকুল হইয়া উঠিল। পা-টিপিয়া উঠিয়া সে কপাট রুদ্ধ করিতেছিল; মা বলিলেন, জ্ঞানদা, ও অতুল কথা কইলে না?
জ্ঞানদা ফিরিয়া আসিয়া বলিল, কি জানি মা তিনি ন’ন বোধ হয়।
হাঁ, সেই বৈ কি! উঠে একবার দেখ দিকি।
তর্ক করিলেই ক্রুদ্ধ হইয়া উঠিবেন—তাহা সে জানিত; তাই ধীরে ধীরে উঠিয়া গিয়া উঁকি মারিয়া দেখিবার চেষ্টা করিল; কিন্তু দেখা গেল না। শুধু বারান্দার ওধারে অনেকের মধ্যে তাঁহারও কণ্ঠস্বর তাহার কানে গেল। এইটুকু খবর লইয়াই সে ফিরিতে পারিত; কিন্তু অন্তরাল হইতে একবার তাঁহার মুখখানি দেখিয়া লইবার লোভ তাহাকে যেন ঠেলিয়া লইয়া গেল।
সে নিঃশব্দে আগাইয়া আসিয়া একটা থামের আড়ালে দাঁড়াইয়া দেখিল, তিনি বড়মাসির পায়ের উপর মুঠা করিয়া আবীর দিয়া হাসিতেছেন। পাড়ার ছেলেরাও দেখাদেখি তাহাই করিতেছে।
ছোটবৌ ছিল না। একটা ব্যথার মত হওয়াতে আজ সে ঘর ছাড়িয়া বাহির হয় নাই। ফিরিবে ফিরিবে করিয়াও নিজের অজ্ঞাতসারে বোধ করি জ্ঞানদার একটু বিলম্ব ঘটিয়াছিল, অকস্মাৎ বজ্রাহতপ্রায় হইয়া দেখিল, সে যে ভয় করিয়াছিল ঠিক তাই,—মা হেলিয়া-দুলিয়া সেইদিকে চলিয়াছেন।
ছুটিয়া গিয়া দুই বাহু দিয়া জড়াইয়া ধরিয়া ব্যাকুলকণ্ঠে কহিল, যেয়ো না মা, ফেরো।
দুর্গা চক্ষু রক্তবর্ণ করিয়া কহিলেন, কেন?
কেন, জানিনে মা, তুমি ফেরো। তার ত কোন আশাই নেই মা—
আমাকে ছাড়্ হতভাগী—ছেড়ে দে! বলিয়া অমানুষিক বলে দুর্গা নিজেকে মুক্ত করিয়া লইয়া অগ্রসর হইয়া গেলেন। জ্ঞানদা কলের পুতুলের মত তাঁহাকে অনুসরণ করিয়া পিছনে গিয়া দাঁড়াইল। সবাই আশ্চর্য হইয়া চাহিয়া দেখিল—মেজবৌ।
তাঁহার সেই কঙ্কালসার মুখমণ্ডলে ক্ষুধিত ব্যাঘ্রের দৃষ্টি ছিল। সে দুটা জ্বলন্ত চক্ষুর পানে চাহিয়া অতুল সভয়ে দৃষ্টি অবনত করিল।