মার গাড়িতে জ্বর এসেছিল,—ঘরে শুইয়ে দিয়েছি।
স্বর্ণ কহিলেন, হবে না? আমি হাজার হই বড়জা ত! অত তেজ করে চলে গেলে কি সয়?
ছোটবৌ জ্ঞানদার হাত ধরিয়া তাহার মাকে দেখিবার জন্য উঠিয়া দাঁড়াইয়াছিল।
বড়জায়ের এই নিতান্ত গায়ে পড়া কটুকথাগুলো আজ তাহার এতই বিশ্রী লাগিল যে, সে সহিতে পারিল না; কহিল, দিদি, বছর-দুই মধু-সংক্রান্তির ব্রত করো—আর-জন্মে মুখখানা যদি একটু ভাল হয়। স্বর্ণ এই অপ্রত্যাশিত মন্তব্যে ক্রোধে বিস্ময়ে হঠাৎ অবাক হইয়া গেলেন। কিন্তু পরক্ষণেই তীব্রস্বরে গর্জিয়া উঠিলেন, তবু ভাল লো ছোটবৌ, তবু ভাল। এতকাল পরেও যা হোক মেজজাকে দেখে শোকটা উৎলে উঠেচে। মাইরি, কত ঢঙই তুই জানিস।
ছোটবৌ জবাব দিল না। জ্ঞানদার হাত ধরিয়া ও-বাড়ি চলিয়া গেল। কিন্তু সে যাওয়া জ্ঞানদার পক্ষে একেবারে মারাত্মক হইয়া উঠিল। কারণ তাহার ও তাহার মাতার বিরুদ্ধে স্বর্ণমঞ্জরীর এমনই ত বিদ্বেষের অবধি ছিল না; কিন্তু ছোটবৌয়ের ব্যবহারে আজিকার বিদ্বেষ তাহাকেও অতিক্রম করিয়া গেল।
হরিপালে থাকিতে দুর্গা জ্বর আসিলে শুইয়া পড়িতেন, ছাড়িলে উঠিয়া নড়াচড়া করিতেন। সাধ্যে কুলাইলে স্নান-আহ্নিক করিয়া একবেলা একমুঠা ভাতও খাইতেন। কিন্তু এখানে আসিয়া আর একপ্রকার ঘটিল। পাড়ার মেয়েরা অহোরাত্র সহানুভূতি করিয়া দু-পাঁচদিনেই তাঁহাকে একেবারে শয্যাশায়িনী করিয়া দিল। নীলকণ্ঠ মুখুয্যেমশায়ের পরিবার মেজবৌকে দেখিতে আসিয়া একেবারে আকাশ হইতে পড়িলেন। চোখ কপালে তুলিয়া বলিলেন, এ কি করেচিস মেজবৌ, মেয়ের বিয়ে দিবি কবে? ওর পানে যে আর চাইতে পারা যায় না।
দুর্গা শ্রান্ত চোখ দুটি নিমীলিত করিয়া ক্ষীণকণ্ঠে কহিলেন, কি জানি পিসিমা, কবে ভগবান মুখ তুলে চাইবেন।
তা ত জানি মা। কিন্তু চেষ্টা করতে হবে ত? ভগবান ত আর বর জুটিয়ে এনে দিয়ে যাবেন না!
দুর্গা আর জবাব দিলেন না।
একমিনিট প্রতীক্ষা করিয়া তিনি পুনরায় কহিলেন, বলি বাপের বাড়ি গেলি, ভাই কিছু যোগাড় করে দিলে না? দেওর কি বলে?
ভগবান জানেন। বলিয়া দুর্গা পাশ ফিরিয়া শুইলেন।
ঘণ্টা-খানেক পরেই আদরিণী বেড়াইতে আসিয়া চৌকাঠের বাহিরে দাঁড়াইয়াই উঁকি মারিয়া কহিল, বলি এ-বেলাটায় কেমন আছ মেজবৌ?
জ্ঞানদা শয্যার একপ্রান্তে বসিয়া মায়ের পায়ে হাত বুলাইয়া দিতেছিল; কহিল, জ্বর এখনো ছাড়েনি পিসিমা। দুর্গা মুখ ফিরাইয়া চাহিয়া দেখিলেন; বলিলেন, ব’সো ঠাকুরঝি।
না বৌ, বেলা গেল, আর বসবো না। তা বলি কি মেজবৌ, যাকে হোক ধরে উচ্ছুগ্যু করে দাও,আর খুঁতখুঁত ক’রো না। বলতে নেই,—তখন তবুও মেয়েটার যা হোক একটু ছিরি ছিল, কিন্তু ম্যালেরিয়া জ্বরে একেবারে যেন পোড়া কাঠটি হয়ে গেছে। হ্যাঁ লা গেনি, সুমুখের চুলগুলো বুঝি উঠে গেল?
জ্ঞানদা ঘাড় নাড়িয়া নীরবে নতমুখে বসিয়া রহিল। আদরিণী কণ্ঠস্বর মৃদু করিয়া কহিল,—শুনচি নাকি ও-পাড়ার গোপাল ভটচায্যি আবার বিয়ে করবে। একবার অনাথদাকে পাঠিয়ে খবরটা কেন নিলে না মেজবৌ?
আচ্ছা, বলব, বলিয়া দুর্গা নিশ্বাস ফেলিয়া পুনরায় দেয়ালের দিকে মুখ ফিরাইয়া শুইলেন।
এমনি করিয়া কত লোক যে কত হিতোপদেশ দিয়া গেল, তাহার সংখ্যা রহিল না। কিন্তু যাহাদের পথ চাহিয়া দুর্গা অনুক্ষণ কান খাড়া করিয়া রহিলেন, তাহারা দেখা দিল না। না আসিল অতুল, না আসিল তাহার মা।
ছোটবৌয়ের দেহে দয়ামায়া ছিল; কিন্তু সে ভারী অলস, তাহাতে অন্তঃসত্ত্বা। সুতরাং স্বর্ণ জ্ঞানদাকে যখন বলিলেন, বাছা, রোগ বলে ত আর চিরকাল চলে না, তোমার মা যেন ধরলুম পারে না, কিন্তু তুমি বাপু সোমত্ত মেয়ে—সকালে কাকার ভাত দুটি কি আর রেঁধে দিতে পার না? ঘরের ভিতর হইতে ছোটবৌ কথাটা অন্যায় বুঝিয়াও চুপ করিয়া রহিল। পরের দুঃখে সে ব্যথা অনুভব করিত; কিন্তু তাই বলিয়া নিজেকে পরিশ্রম দিয়া সে দুঃখ দূর করা তাহার পক্ষে অসাধ্য।
জ্ঞানদা তৎক্ষণাৎ রাজি হইয়া মৃদুকণ্ঠে বলিল, আমিই দেব জ্যাঠাইমা।
যদিচ, এখনও প্রতিরাত্রেই তাহার জ্বর হইত, কিন্তু মায়ের যন্ত্রণা বাড়াইবার ভয়ে এ কথা সে প্রাণপণে গোপন করিয়া রাখিয়াছিল। ফোঁপরা নির্জীব দেহটাকে সে সকালে বিছানা হইতে যেন টানিয়া তুলিতেই পারিত না; তথাপি একবার ইতস্ততঃ করিল না—একটিবার মুখভার করিল না।
দুঃখী পিতা-মাতার কন্যা হইলেও সে একমাত্র সন্তান; তাঁহাদের বড় আদরে যত্নে লালিত-পালিত হইয়াছিল। কিন্তু ছেলেবেলা হইতেই গুরুজনের আজ্ঞা—ন্যায়-অন্যায় যাই হউক—নির্বিচারে মাথা পাতিয়া লইতে, সেবা করিতে, মুখ বুজিয়া সহ্য করিতে, সংসারে বোধ করি আর তাহার জুড়ি ছিল না। কিন্তু আজ সে যে কত বড় গুরুভার মাথায় করিয়া লইল, তাহা আর কেহ না বুঝুক, ছোটবৌ বুঝিল। সুতরাং বড়জায়ের এই অত্যন্ত অন্যায় আদেশে তাহার অন্তর জ্বলিতে লাগিল, তথাপি মুখ ফুটিয়া প্রতিবাদ করিতেও তাহার সাহস হইল না—পাছে, বলিতে গেলেই পালার শর্তমত তাহাকে ভোরে উঠিয়া রাঁধিতে হয়।
পরদিন যথাসময়ে কাকাকে স্নানঘরে যাইতে দেখিয়া, জ্ঞানদা ভাতের থালাটি হাতে করিয়া দিতে যাইতেছিল,—কোথা হইতে জ্যাঠাইমা হাঁ-হাঁ করিয়া ছুটিয়া আসিয়া পড়িলেন—কোথা যাস লা গেনি?
জ্ঞানদা থতমত খাইয়া বলিল, কাকা স্নান করে এলেন যে!
তাতে তোর কি? বলিয়া জ্যাঠাইমা চেঁচাইয়া উঠিলেন—মানা করে দিয়েচি না ভাত বেড়ে নিয়ে যেতে? তোর হাতে পুরুষমানুষ খেতে পারে লা?