হায় রে মানুষের আশা! শত কোটি সম্ভব-অসম্ভব জল্পনা-কল্পনার মধ্যে এ কথাটা একবারও দুর্গার মনে উদয় হইল না যে, ইতিমধ্যে অতুলের মনের গতি বদলাইয়া যাইতেও পারে। একবারও ভাবিলেন না—অতুলের যে কামনা একদিন একান্ত সঙ্গোপনে সম্পূর্ণ আবরণের অন্তরে, শুধু নির্বিবাদেই বাড়িয়া উঠিতে পাইয়াছিল, তাহাকে এমন অসময়ে এতবড় অনাবৃত প্রকাশ্যতার মাঝখানে টানিয়া আনিলে, সে চক্ষের পলকে শুকাইয়া যাইতে পারে! এখন শত বিরুদ্ধ-শক্তি সজাগ হইয়া তাহাকে মুহূর্তের মধ্যে চাপিয়া মারিতে পারে! মানুষ এমনিই অন্ধ!
দুর্গা একটু সকাল সকাল বাড়ি ফিরিয়া মেয়ের ঘরে ঢুকিয়া প্রথমেই প্রশ্ন করিলেন, হাঁ রে জ্ঞানদা, দাশু কোন চিঠিপত্র দিয়ে গেছে কি?
মেয়ে কুণ্ঠিতস্বরে কহিল, না মা।
আজ দুই মাস হইতে উপর্যুপরি তিনখানি পত্রের জবাব আসিতেছে না। দুর্গা সংশয়ক্ষুব্ধ কণ্ঠে কহিলেন, তুই হয়ত ঘুমিয়ে পড়েছিলি। তোর সাড়া না পেয়ে দাশু হয়ত ফিরে গেছে। আমি বাড়িতে নেই—একদিন একটুখানি কি জেগে থাকতে পারিস নে বাছা? বলিয়া দুর্গা মুখ ভার করিয়া চলিয়া গেলেন। জ্ঞানদা চুপ করিয়া রহিল। সে ঘুমায় নাই, জাগিয়াছিল বলিয়া তর্ক করিল না। মায়ের কাছে প্রত্যহ একই প্রশ্নের একই উত্তর দিতে দিতে সে নিজের লজ্জায় নিজেই মাটির সঙ্গে মিশিয়া যাইতেছিল।
দুর্গা তৎক্ষণাৎ ফিরিয়া আসিয়া দ্বারের বাহির হইতে কহিলেন, কেন দাশু যে আমাকে বললে, সে খুঁজে এনে দিয়ে যাবে? আজ কেমন করিয়া যেন তাঁহার নিশ্চয় বিশ্বাস হইয়াছিল, অতুলের চিঠিপত্র আসিয়াছেই।
মেয়ে কথা কহিল না—একটা মলিন কাঁথার মধ্যে মুখ লুকাইয়া পড়িয়া রহিল। কিন্তু দুর্গা এইখানেই থামিতে পারিলেন না। তিনি ভ্রাতুষ্পুত্রকে পোস্টাফিসে পাঠাইয়া খবর লইয়া জানিলেন, দাশু আসে নাই।
পরের তিন-চারি দিন তিনি পত্রের প্রত্যাশায় অহোরাত্র যেন কণ্টকশয্যায় বসিয়া কাটাইলেন—তথাপি কিছু আসিল না। অবশেষে হতাশ হইয়া অতুলের জননীকে চিঠি লিখিলেন। তিনি প্রত্যুত্তরে সংক্ষেপে জানাইলেন, অতুল ভাল আছে এবং কলিকাতার বাসায় থাকিয়া পূর্ববৎ লেখাপড়া করিতেছে। তাঁহার চিঠির মধ্যে একটা তাচ্ছিল্যের সুরই যেন দুর্গার কানে বাজিল। এমনি করিয়া অঘ্রান গেল, পৌষ গেল, কিন্তু অতুলের চিঠি আসিল না। মাঘের মাঝামাঝি মেয়ে যদিবা একটু সারিয়া উঠিল, মা অসুখে পড়িলেন। এতবড় নিরাশার আঘাত তিনি সহ্য করিতে পারিলেন না। তা ছাড়া, বৌয়ের প্রতি তাঁহার বিদ্বেষের আর যেন অন্ত ছিল না। তাহার উল্লেখ করিতে হইলেই, ঘৃণাভরে কখনো বা ‘পোড়া কাঠ’ কখনো বা ‘তাড়কা’ বলিতেন এবং যত দিন যাইতে লাগিল, ঘৃণা যেন অপরিসীম হইয়া উঠিতে লাগিল। তাহার আরও একটা কারণ এই ছিল,—‘পোড়া কাঠ’ নিজের ধরনে জ্ঞানদাকে তাহার স্বাভাবিক মাধুর্যের জন্যই বোধ করি ভালবাসিয়াছিল, যত্নও করিত। কিন্তু এই যত্নের মধ্যে একটা উৎকট স্বার্থের গন্ধ পাইয়া দুর্গা বিষের জ্বালায় জ্বলিতে লাগিলেন। বড় দুঃখের দেহ, তাই অনেক সহিয়াছিল; কিন্তু আর সহিল না। মাঘের শেষে তিনি শয্যা আশ্রয় করিলেন। মেয়ে কাঁদিয়া বলিল, আর না মা, এইবার বাড়ি চল। যা হবার সেইখানেই হোক।
দুর্গা রাজি হইলেন। তাঁহার সম্মতির এখন আর কোন বিশেষ কোন কারণ ছিল না; শুধু এই ‘পোড়া কাঠে’র যত্ন ও আত্মীয়তা হইতে বাহির হইবার জন্যই মন যেন তাঁহার অহরহ পালাই পালাই করিতে লাগিল।
যাত্রার উদ্যোগ হইতেছে শুনিয়া শম্ভু বাঁকিয়া বসিলেন। তখন সকাল সাতটা-আটটা, শম্ভু সন্ধ্যা-আহ্নিক সারিয়া খটখট শব্দে বাহিরে আসিয়া ডাকিলেন, দুর্গা!
দুর্গা দাওয়ার একপ্রান্তে খুঁটি ঠেস দিয়া মুখ ধুইতেছিলেন। জ্ঞানদা কাছে বসিয়া সাহায্য করিতেছিল। দাদার আহ্বানে দুর্গা সাড়া দিলেন।
শম্ভু কহিলেন, এখন ত তোমার যাওয়া হতে পারে না।
কেন দাদা?
কেন দাদা! আমি কি তোমার জন্যে কথা দিয়ে মিথ্যাবাদী হব নাকি? সে জন্ম আমার নয়। কথাটা না জানিয়াও দুর্গার বুকের ভিতরে তোলপাড় করিতে লাগিল। মৃদুকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিলেন, কিসের কথা, দাদা?
শম্ভু কহিলেন, গেনির বিয়ের। আর ত আমি রাখতে পারিনে—কাজেই আমাদের নবীনের সঙ্গেই সামনের পাঁচুই ফাগুনে কথাবার্তা পাকা করে ফেলতে হ’ল। এদিকে গয়নাগাটিও মন্দ দেবে না বলচে। দেখতে শুনতে সবদিকেই ভাল হবে, দেখলাম কিনা।
খবর শুনিয়া দুর্গার মাথায় বাজ ভাঙ্গিয়া পড়িল। কাঁদ-কাঁদ হইয়া কহিলেন, আমাকে না বলে কেন কথা দিলে, দাদা? এ বিয়ে ত আমি প্রাণ থাকতে দিতে পারব না।
শম্ভু ক্রুদ্ধ হইয়া কহিলেন, পারব না বললেই হবে? আমি মামা—আমি যা বলব, তাই হবে। তোর জন্যে কথার নড়চড় করব, তেমন বাপে আমাকে জন্ম দেয়নি—তা জানিস?
এইবার দুর্গা সত্যি সত্যিই কাঁদিয়া ফেলিলেন; কহিলেন, না দাদা, মেয়ের বিয়ে এখানে আমি মরে গেলেও দেব না—আমার জন্যে তুমি এতটুকু ভেব না দাদা—কণ্ঠ রুদ্ধ হইয়া কথাটা তিনি শেষ করিতেই পারিলেন না ৷
শম্ভু এই কান্না দেখিয়া মহাবিরক্ত হইয়া দাঁত খিঁচাইয়া কহিলেন, শুভকর্মে মিছে কাঁদিস নে ভ্যানভ্যান করে। যা হবার নয়, যা পারব না—
রঙ্গস্থলে ‘পোড়া কাঠ’ দেখা দিলেন। দুই হাত গোবর-মাখা—বোধ করি, তখনো গোয়ালঘরের ব্যবস্থাই করিতেছিলেন। উঠানের উপর আসিয়া স্বামীকে উদ্দেশ করিয়া অকস্মাৎ ভাঙ্গা-কাঁসির মত খ্যানখ্যান করিয়া বাজিয়া উঠিলেন—বলি সুপাত্তরটি কে গা ঠাকুর? একবার শুনতে পাইনে?