দিন যায়, দিনের পর দিন যায়, দিন গড়িয়ে মাস যায়, মাস গড়িয়ে বছর যায়। সোংসার কেরূমে কেরূমে বড় হতে লাগল। সেজ দ্যাওরের বিয়ে হয়ে গেল। বাড়িতে লতুন বউ এল। তাপর একদিন শ্যাষ ননদটিরও বিয়ে হলো মাহা ধুমধাম করে। বিয়ে হলো দশ কোশ দূরের এক গাঁয়ে। সি ঘরও খুব আবস্তাপন্ন।
দু-একটো কষ্টের কথা সব মানুষেরই থাকে। আমারও কি ছিল? ছিল বৈকি? পিতিকার হোক আর না হোক বলতে পারলে তো মনটা এট্টু খোলসা হয়। তা কাকে বলব? ইসব কথা তো শাশুড়ি-ননদকে বলার লয়। হয়তো তাদের নিয়েই কথা, তাদের বলব কি করে? এক কত্তাকে বলা যায়। তা সে এমন লোক যি ছামনে দাঁড়ালেই মনে হয় ই লোককে ইসব কথা বলা যায় না। মনে হয়, আমার আবার আলাদা কথা কি, নিজের লেগে ইয়াকে আবার কি বলব? সারা দিনে তাকে দেখতেই প্যাতম না। দেখা হতো শুদু অ্যানেক রেতে। শাশুড়ি য্যাতোকাল ছিল আমি ছেলম ঠিক যেন লতুন বউ। এতগুলিন ছেলের মা হয়েও লতুন বউ।
তা আমি আমার কথা বলব কি, একদিন রেতে কত্তা হঠাৎ বললে, একটা কথা বলি শোনো। ছোটবেলায় পাঠশালায় যাও নাই যাও নাই। তা বলে কি চিরকাল মূখ হয়ে থাকবে? একটু লেখাপড়া শেখা কি খারাপ?
কথা শুনে আমি তো সাত হাত পানিতে, ই আবার কি কথা! অ্যাকন আবার আমি কি ল্যাখাপড়া শিখব?
লেখাপড়া শেখার কোনো বয়েস নাই। একটু পড়তে লিখতে শিখলেই বুঝতে পারবে দুনিয়া কেমন করে চলছে।
তা জেনে আমার কি হবে? সোংসারে খাটতে খাটতে জান গেল। জানি, এই করেই জেবন যাবে। এই বয়েসে আমি কি আবার বি.এ. এম.এ. পাশ দোব?
লেখাপড়া শিখতে গেলে বি.এ. এম.এ. পাশ দিতে হয় না। যাই হোক, আমি বই কিনে আনব, দেখবে কদিনের মধ্যেই অক্ষর শিখে যাবে।
উ অ্যাকন আর আমি পারব না।
পারতে তোমাকে হবেই।
কত্তার মুখ দেখে বুঝতে পারলম, উ মানুষ যা করবে ঠিক করে, তা নিয়ে স্ট্যাচামেচি করে না, ভেতরে ভেতরেই ঠিক করে। আমি চুপ করে থাকলম। একটু বাদে কত্তা আস্তে আস্তে শ্যাষ কথাটো বললে, আলো আর আঁধারের যে তফাত–অক্ষর জানা আর না-জানা মানুষের মধ্যে ঠিক সেই তফাত।
কি আতান্তরে যি পড়লম! কত্তা আমাকে কি বেপদের মদ্যে ফেললে! কিন্তুক সি মানুষকে যে চেনে নাই, সে চেনে নাই। একদিন ঠিকই আনলে বিদ্যেসাগরের বন্নপরিচয়ের পেথম ভাগ, একটো সেলেট আর পেনসিল। কত্তা এটুন শৌখিন ছিল, সারা বাড়িতে রেতে জ্বলত পিদিম আর লণ্ঠন, কত্তার ঘরে জ্বলত একটো হেরিকেন। হেরিকেনের ত্যাকন অ্যানেক দাম। কত্তার ঘরে ছিল একটো বিদ্যাশি দামি হেরিকেন। কেউ জানতে পারলে না, অ্যানেক রেতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে ঘরের দরজা বন্ধ করে সেই হেরিকেনের আলোয় ল্যাখাপড়া শেখাতে লাগলে আমাকে। সারাদিনের খাটা-খাটনির পরে চোখ জড়িয়ে আসত ঘুমে, কিছুতেই জেগে থাকতে পারতাম না। কিন্তুক কত্তার কুনো মায়া নাই, সি কি তার তর্জন-গর্জন। শোয়া-ছেলে তিকুরে তিকুরে উঠত।
খোঁকা যি জেগে উঠবে?
তা উঠুক। মাথায় কি আছে কি তোমার! অক্ষরটা কি চোখে দেখতেও পাচ্ছ না? পেনসিল হাতে বসে আছ, হাত কি ঘুরছে না স্লেটের ওপর?
কি জানি মাথা কেমন গোলমাল লাগছে।
বুঝতে পারছি, ঘুম আসছে। যাও, ওঠো, চোখে পানি দিয়ে এসো, নাহলে চোখে দু-ফোটা রেড়ির তেল দাও, ঘুম চলে যাবে।
বললে কেউ পেত্যয় যাবে না, ইকটু ইদিক-উদিক হলে মায়া-দয়া তো করতই না, বোকা গাধা মাথায়-গোবর ইসব বলে গাল তত দিতই, চুলের গোছ ধরে টান, কানের লতিতে.একটা মোচড়, ইসবও ছিল। একদিন তো গালে ঠোনা মেরে হাত ধরে টেনে তুললে। সি কি রাগ বাপরে বাপ, যাও বেরিয়ে যাও ঘর থেকে, কখনো আসবে না এদিকে। একটা সামান্য কথা মাথায় ঢুকছে না তখন থেকে? যাও, বেরিয়ে যাও, দরকার নাই লেখাপড়ার।
কি আর করি, ঘর থেকে বেরিয়ে যেয়ে দুয়োরের পাশে দাঁড়িয়ে থাকলম। খানিক বাদে নিজেই আবার এসে ঘরে নিয়ে যেয়ে বললে, যাও, শুয়ে পড়ো, আজ আর পড়তে হবে না।
হুঁ, এমনি করে আমি পড়তে শিখেছেলম। বিদ্যেসাগরের অ আ ক খ বইয়ের পিতিটি অক্ষর আমার চোখের পানিতে ভেজা বলে চোখ বুজলেই সেইসব অক্ষর দেখতে পাই। কালো কালো যত ছবি ছিল বইয়ে সব মনে পড়ে। আকননা সেইসব দিনের কথা মনে পড়লে বুকের ভেতরটা হু হু করে। দু-মাসের মাথায় পড়তে লিখতে শেখা হয়ে গেল। পেথম পেথম বানান করে করে, পরে এমনিতে সব পড়তে পারতম। বাড়িতে ‘বঙ্গবাসী’ বলে একটো কাগজ আসত পোেস্টাপিস থেকে। ভালো বুঝতে না পারলেও সেটা কখনো-সখনো পড়তম। কিন্তুক সবই লুকিয়ে লুকিয়ে। বাড়ির কেউ কিছু জানত না। কত্তা কিন্তুক কিছু বারণ করে নাই। তবে ননদ-শাশুড়িকে ইসব বলতে আমারই কেমন শরম লাগত।
আমাদের সোংসারের লেগে সেই সোমায়টো ছিল উঠতির সোমায়। সব সসাংসারে এমন হয়। একটো উঠতির সোমায় আর একটো পড়তির সোমায়। শ্বশুরের মিত্যুর পর সোংসারে খারাপ দিন এয়েছিল। শ্বশুর গত হবার সাথে সাথে ভাই ভায়াদেরা সব সোংসার আলো করে নিলে। সবাই ভিনো হয়ে গেল। ঐ যি শ্বশুর অনেক বিষয়সম্পত্তি লষ্ট করে ফেলেছিল, সেই লেগে সম্পত্তি ভাগ হবার সোমায়ে ভাইয়েরা নিজের নিজের সম্পত্তি পুষিয়ে নিলে। আমার বেধবা শাশুড়ির ভাগে পড়ল খুবই কম জমি। কিন্তুক তার ভাগে পড়েছিল সব ধনের সেরা ধন–এক পুতুর। সিরকম ধন থাকতে আবার ভাবনা! শুদু একটো ভয়, ইরকম ধন কারুর একার নয়, এমনকি শুদু একটো সসাংসারেরও লয়। মায়ের তেমন পুত্রুর গোটা চাকলার। আমার শাশুড়ি সি কথাটো বুঝেই তবে দুনিয়া থেকে গেয়েছে।