কত্তাকে ঐ বয়সে যি অতো দায়িত্ব নিতে হয়েছিল তার কারণ হলো, আমার শ্বশুর আট-লটো ছেলেমেয়ে আর বেধবা স্ত্রী রেখে অল্প বয়সেই মারা যায়। কথাবার্তা শুনে আমার মনে হয়, শ্বশুর বোধায় খানিকটা আমার ভাশুরের মতুনই বিষয়-সম্পত্তি দেখে রাখবার মানুষ ছিল না। তবে সে আলাভোলা ছিল না। এলেকার হিঁদু-মোসলমান বড় বড় মানুষের সাথে তার ওঠাবসা ছিল। শখ-সাধও ছিল বোধায় তেমনি। নিজের পালকি ছিল, ছয় বেহারার পালকি। সেই পালকিটি দলিজঘরের বারেন্দায় ভেঙেচুরে পড়ে ছিল অ্যানেকদিন। তা বাদে নিজের আরবি ঘোড়া ছিল তো বটেই। ঘোড়ায় চড়ে ইগাঁয়ে উগাঁয়ে বড় বড় লোকের বাড়িতে যেমন যেত, তেমনি তারাও সবাই ই বাড়িতে আসত। শাশুড়ির ঠেয়ে শুনেছি মানুষজনের আসা যাওয়ার কামাই ছিল না। কোর্মা পোলাও দই মিষ্টি দেদার খরচ হতো। এমনি করে করেই জমি সম্পত্তি কতক বিক্রি হলো, কতক বেহাত হলো। শ্বশুর য্যাকন মারা যায়, ত্যাকন লিকিনি সোংসারের বেহাল অবস্তা। শাশুড়ি বলত, সোংসার য্যাকন ভেসে যায়-যায় হয়েছে ত্যাকন তার এই মেজ ছেলেই এগিয়ে এসে হাল ধরলে। তা নাইলে সব যেত। কত্তার ত্যাকন কতোই বা বয়েস, বিশ বছর হয়েছে কি হয় নাই। সে সব আমোদ-আল্লাদ বাদ দিয়ে ভাইবুনগুলিন আর মাকে নিয়ে জান-পরান দিয়ে এই সোংসারটোকে রক্ষা করলে। ই সোংসারে এসে তাই দেখলম বটে। সোংসারের ভেতরে যা করবে সব মা। মা ছাড়া কথা নাই। নিজের ইস্ত্রী তো বটেই পরে পরে যিসব ভাইয়ের বিয়ে হলো তাদের পেত্যেকের বউকে চোখকান বুজে শাশুড়ির কথা মেনে চলতে হবে। শাশুড়িকে একটি কথা ঝাঝিয়ে বলেছে কিম্বা কাজ করতে করতে ঘটি-বাসন মাটিতে একটু ঠুকে আওয়াজ করেছে, আর রক্ষা নাই। কত্তা সোজা বাড়ির ভেতর ঢুকে বলবে, যে এরকম করলে সে আর একবার যদি এমন করে, তাকে বাড়ি থেকে চলে যেতে হবে। তা কত্তাকে লাগত না, আমার শাশুড়ির শাসনই য্যাথেষ্ট ছিল।
বউ হয়ে আসার পর থেকে অবশ্যি দেখছি সোংসার অ্যানেকটোই ঠাউরেছে। শ্বশুরের মিত্যুর পরে সাত-আট বছর কত্তাকে কেউ বিয়ের কথা বলতে সাওস পায় নাই। আমার শাশুড়ি-ও লয়। সেই লেগেই এত দেরিতে বিয়ে। সংসারে ঢুকে দেখলম ত্যাকন একমাত্তর সেজ জনার বিয়ের বয়েস হয়েছে, বাকি ভাইবুনরা সব ছোট। বেধবা বুনটোর পরে তার আর দুই ছোট বুনের বিয়ের বয়েস হব-হব। কিন্তুক কি কপাল, এই সোমায় ঠিক ঘোটর বড় যেটি সেই বুনটি মারা গেল। কি অসুখ কে বলবে? মাস দুই-তিন কিছুই পেরায় খেলে না। খাবার দেখলেই বলত অরুচি লাগছে। এই করে শুকিয়ে শুকিয়ে লেয়ালির দড়ি হয়ে গেল। কাটি কাটি হাত পা। তাপর একদিন আমাদের সকলের চোখের ছামনে দুনিয়া থেকে বিদায় নিলে। আহা, কতোই বা বয়েস, সারাটা জেবন তার ছামনে, সোয়ামি সোংসার সন্তান কিছুই জানলে না, অকালে মা ভাই বুন সবাইকে কাঁদিয়ে চলে গেল। ত্যাকনকার দিনে মরে যাওয়াটো যেন কিছুই লয় এমনি ভাব ছিল মানুষের। দু-চার দিন কেঁদেকেটে সব ভুলে যেত। ডাক্তারবদ্যি তো তেমন ছিল না। যা বা ছিল শহরগঞ্জে, পাড়াগাঁয়ে তার কিছুই মিলত না। কঠিন অসুখ হলে যার অসুখ সে যেমন, তেমনি তার সোদররাও সব আশা ছেড়ে দিয়ে মিত্যুর লেগে ঠায় অপেক্ষা করত। কলেরা আর বসন্ত ই দুটো মাহামারীতে বছরে কতো লোক যি মরত তার আর সুমার নাই। অত কাদবে কে? কেঁদে কুনো লাভ নাই। যি কঁদছে সে-ই দুদিন বাদে মরবে কি না কে বলবে? কলেরা-বসন্ত বাদ দিয়ে আর একটো অসুখ ছিল–বুকের ব্যায়রাম, যক্ষ্মা। উ রোগ হলে চিকিচ্ছের চেষ্টাও ছেড়ে দিত মানুষ। এক-একটো বংশ নিব্বংশ হয়ে যেত ই রোগে। যার হয়েছে ই রোগ, সে হয়তো হা হা করে হাসছে, যা মন চায় তাই খেছে, তাপর একদিন টুকুস করে মরে গেল। মানুষ যি জান ভরে কাঁদবে তা কি করতে কাদবে? দুদিন বাদে সে-ও যে টুকুস করে মরবে।
০৬. আমার একটি খোঁকা হলো
বিয়ের এক বছরের মাথায় আমার একটি খোঁকা হলো। সি দিনই লিকিনি দোপরবেলায় এক কড়াই দুধ উথুলে পড়ে গেয়েছিল। গাই দুয়ে এনে জ্বাল দেবার লেগে দুধ চুলোয় বসিয়েছিল। কেউ আর খেয়াল করে নাই, আঁতুড়ঘরে আমাকে আর লতুন খোঁকাকে নিয়েই সবাই বেস্ত ছিল। এই ফাঁকে সেই উজ্জ্বলন্ত দুধ সব উথুলে উঠে কড়াই থেকে পড়ে গেল। তাই দেখে আমাদের বুবু, সেই বেধবা ননদ হায় হায় করে উঠলে শাশুড়ি শুদু বললে, দুধ নষ্ট হয়েছে হয়েছে। কেউ কোনো কথা বোলো না। বাড়িতে নতুন মানুষ এল–এ সোংসারের পেথম খোঁকা–আর দুধ উথুলে পড়ে গেল! এ বড় সুখের কথা। এবার সোংসারে ধন-দৌলত, সুখ আনন্দও উথুলে পড়বে। তোমরা কেউ এই নিয়ে আর কথা বোলো না।
তা কথা সত্যি বটে–বংশের পেথম ছেলে–লতুন ঝাড়ের গোড়াপও। পেথম ছেলে পেথম লাতিন। আনন্দে সবাই ভাসতে লাগল। ই ছেলে যেন একা আমার ছেলে লয়। কত্তা ত মনেই করলে, না যি তার ছেলে হয়েছে। উ ছেলে তো সবারই, ই বংশের ছেলে। মা বলে আমার খাতির বাড়ল, শাশুড়ি আড়লে আবডালে সবার কাছে বলতে লাগল, ঐ মেজবউ সাংসারের লক্ষ্মী, ঐ বউটি আসা থেকে সোংসারের বাড়-বাড়ন্ত শুরু হয়েছে। খুব পয়া আমাদের বউ। তা আমার খাতির আর আদর বাড়ল বটে, তা বলে খোঁকাকে একা আগুলে রাখতে পারলাম না। সে হলো সবার চোখের মণি। ঘুরেফিরে সবাই এসে খালি তাকে দেখতে চায়। খোঁকাটি আমার শামলা, বাপের রঙ পেয়েছিল, ছেয়ালো ছেয়ালো হাত-পা, ডাগর ডাগর চোখ, ফুলের পাপড়ির মতুন ঠোঁট। সি যি কি সোন্দর! এমন ছেলের মুখ একবার দেখতে পেলে মায়ের এক লাখ বছর দুনিয়ায় বাঁচা হয়ে যায়। সবাই বলতে লাগল আসমান থেকে এক ফালি চাদ নেমে এয়েছে আমার কোলে। বড়ও হতে লাগল চাঁদের মতুন। আজ একটু, কাল একটু। আজ এট্টু আলো দেখি মুখে, কাল দেখি চোখে।