গাড়িচারটো যা-ও বা এতক্ষণ দেখা যেছিল, চোখের পানিতে অ্যাকন আর কিছুই দেখতে পেচি না। কি ঢল যি নামল পানির আর কিছুই দেখতে পেচি না। ঘরদুয়োর বিশ্বসোংসার উঠছে নামছে। বুকের ভেতর কতো বাতাস, কতো আগুন, কত আলো, কতো ছোঁয়া ফুলে ফুলে গলার কাছে আসছে আবার নেমে যেচে। অ্যাকন যদি এমনি করে মরণ হয়, বেশ হয়।
তাই কি কুনোদিন হয়? কখন গাড়িচারটো মিলিয়ে গেয়েছে। আলো কমছে, হেঁয়া বাড়ছে। দেখতে দেখতে সব আলো নামতে নামতে সরতে সরতে কোথা চলে গেল আর হেঁয়া পড়তে লাগল। সারা বাড়িতে অ্যাকন হেঁয়া, ঘরে ঘরে হেঁয়া, ঘরের বাইরে এনেয় হেঁয়া, ডুমুর গাছে ছেয়া, পেয়ারা গাছে ঘেঁয়া। বাড়িতে আমি একদম একা, অ্যানেক আওয়াজ হতে লাগল সারা বাড়িতে। পশ্চিম দিকের আসমানটো দেখতে পেচি, একটি তারা দেখতে পেচি, কতোদিন বাদে মায়ের মুখটো দেখতে পেচি, কুন এক জগতের গাছপালা মাঠঘাট দেখতে পেচি আর কানে আসছে কতো রকমের আওয়াজ। পেয়ারা গাছে বাদুড় এসে বসল ডালপালা নাড়িয়ে, কি কিচ্ শব্দ করে একটো ইঁদুর ছুটে গেল, মাথার ওপর দিয়ে দু-একটো চামচিকে উড়ছে তো তার কুনো শব্দ নাই, ঝমঝম করে একবার ঝি ঝি পোকা ডাকছে। আবার সব চুপ।
আমি কি ঠিক করলম? আমি কি ঠিক বোঝলম? সোয়ামির কথা শোনলম না, ছেলের কথা শোনলম না, মেয়ের কথা শোনলম না। ই সবই কি বিত্তি-বাইরে হয়ে গেল না? মানুষ কিছুর লেগে কিছু ছাড়ে, কিছু একটা পাবার লেগে কিছু একটা ছেড়ে দেয়। আমি কিসের লেগে কি ছাড়লম? অনেক ভাবলম। শ্যাষে একটি কথা মনে হলো, আমি আমাকে পাবার লেগেই এত কিছু ছেড়েছি। আমি জেদ করি নাই, কারুর কথার অবাধ্য হই নাই। আমি সবকিছু শুদু নিজে বুঝে নিতে চেয়েছি। আমাকে কেউ বোঝাইতে পারলে না ক্যানে আলেদা একটো দ্যাশ হয়েছে গোঁজামিল দিয়ে যিখানে শুদু মোসলমানরা থাকবে কিন্তু হিঁদু কেরেস্তানও আবার থাকতে পারবে। তাইলে আলেদা কিসের? আমাকে কেউ বোঝাইতে পারলে না যি সেই দ্যাশটো আমি মোসলমান বলেই আমার দ্যাশ আর এই দ্যাশটি আমার লয়। আমাকে আরও বোঝাইতে পারলে না যি ছেলেমেয়ে আর জায়গায় গেয়েছে বলে আমাকেও সিখানে যেতে হবে। আমার সোয়ামি গেলে আমি আর কি করব? আমি আর আমার সোয়ামি তো একটি মানুষ লয়, আলেদা মানুষ। খুবই আপন মানুষ, জানের মানুষ, কিন্তুক আলেদা মানুষ।
সকাল হোক, আলো ফুটুক, তখন পুবদিকে মুখ করে বসব। সুরুজের আলোর দিকে চেয়ে আবার উঠে দাঁড়াব আমি।
আমি একা। তা হোক, সবাইকে বুকে টানতেও পারব আমি।
একা।