অন্যদিন জ্বরটা আসে দোপর থেকে, আজ এয়েছে সকাল থেকেই। বাড়িতে সারা গাঁয়ের মানুষ। হাজার বছরেও যি এমন ঘটনা ঘটে নাই। যা হতে লাগল সি আর বলার লয়। বুড়ো বুড়ো মানুষ সব কেউ কত্তার গলা জড়িয়ে ধরে কাঁদে, কেউ গা ছাড়তে বারণ করে, কেউ। শাপ দেয়। যার যেমন মনে হচে করছে। ভেতরে ভেতরে ঘুষঘুষে জ্বর নিয়ে আমি আর নিজের দ্যাহটিকে টানতে পারছি না। একবার দেখলম, কত্তামার ছেলেরাও এয়েছে। কত্তামা কবে গত হয়েছে। তার ছেলেদেরও দেখলম একটি-দুটি চুল পেকেছে। যা হয় তোক আমি একদিকে সরে গ্যালম।
হেঁশেলে যেয়ে বসে আছি, তখুনি মেয়েকে নিয়ে খুঁকি আমার কাছে এয়েছিল। তার সাথে কি কথা হলো তা তো খানিক আগেই বললম। খুব কঁদছে দেখে তাকে আমি আবার বললম, মা, তোমরা যা মনে করছ তা কিন্তু ঠিক নয়। আমি জেদ করে যেচি না মনে কোরো না। তুমি আমার জানের টুকরো, বড় সাদনা করে তোমাকে পেয়েছি মা, তোমার এই কন্যে আমার সাত-রাজার ধন মানিক। বলতে বলতে এইবার আমার চোখ দিয়ে দরদরিয়ে পানি গড়াইতে লাগল। সি পানি মোছলম না, সেই পানির সাগরের ভেতর দিয়ে মেয়ে-নাতিনের আবছেয়া মুখ দেখতে দেখতেই বললম, সব ঠিক আছে মা, তোমাদের সাথে যেচি না বলে মনে কোরো না তোমাদের আমি চেরকালের লেগে জান থেকে বিদায় দেলম। আমি জানব, ছেলেমেয়ে সব-সোমায় কাছে থাকে না, তাদের আলেদা জেবন, আলেদা সোংসার, একসাথে থাকবে ক্যানে? আগেও যেমন যেতে-আসতে, অ্যাকননা তেমনি আসবে-যাবে। এতগুলিন কথা বলে আমি চোখ মুছে তাদের দিকে তাকালম। দেখি, খুঁকির চোখেও অ্যাকন আর পানি নাই। আমি তাদের দুজনাকে ধরে চুমো খেলে খুঁকি মেয়েকে কোলে নিয়ে আস্তে আস্তে ঘরের বাইরে গেল।
দুপুর গড়িয়ে বেলা আর একটু পড়ে এলে রওনা হয়ে যাবার সোমায় হলো। ত্যাখন ভেতরে ভেতরে বোধায় ভাবলম, মেজ খোঁকা কি একবার আসবে না? না এলে সি ভালো! তবে একবার কি সে আসবে না? এই ভেবে চোখ তুলতেই দেখি, সামনে মেজ খোঁকা। সে কিন্তুক হাসছে। সোজা আমার কাছে এসে বললে,, আমি সব জানি। তোমাকে নিয়ে সবাই পিড়াপিড়ি করছে। আমারও করা উচিত ছিল, করি নাই। এখনো আমি তোমাকে একটুও জোর করব না। শুধু ঠিক করে বলো তো মা, তুমি এই কাজটি করলে কেন? অত জোরই বা কিসের তোমার? এই কথাটা জানতে আমার খুব মন হচ্ছে।
সত্যি বলছি বাবা, আমি ক্যানে তোমাদের সাথে দেশান্তরী হব এই কথাটি কেউ আমাকে বুঝাইতে পারে নাই। পেথম কথা হচে, তোমাদের যি একটো আলেদা দ্যাশ হয়েছে তা আমি মানতে পারি না। একই দ্যাশ, একইরকম মানুষ, একইরকম কথা, শুদু ধম্মে আলেদা সেই লেগে একটি দ্যাশ একটানা যেতে যেতে একটো জায়গা থেকে আলেদা আর একটো দ্যাশ হয়ে গেল, ই কি কুনোদিন হয়? এক লাগোয়া মাটি, ইদিকে একটি আমগাছ একটি তালগাছ, উদিকেও তেমনি একটি আমগাছ, একটি তালগাছ! তারা দুটো আলেদা দ্যাশের হয়ে গেল? কই ঐখানটোয় আসমান তো দুরকম লয়। শুদু ধম্মাের কথা বোলো না বাবা, তাইলে পিথিমির কুনো দ্যাশেই মানুষ বাস করতে পারবে না।
মেজ খোঁকা আমার কথাগুলিন যেন গিলছিল। আমার বলা হয়ে গেলে সে শুধু বললে, মা তোমার কথা ঠিক, তবে আরও কথা আছে।
তা থাকুকগো, তা নিয়ে আমার দরকার নাই। আমি এই বুঝি যি ছেলেমেয়ে বড় হয়ে গেলে আজকালকার দিনে আর কাছে থাকতে পারে না। কাছে রাখতে গেলেই তারা আর বড় হতে পারবে না। দিনকাল বদলাইছে, তাদের ছেড়ে দিতেই হবে। তাদের জেবন আলেদা হবে, সোংসার আলো হবে। তার লেগে আমি ক্যানে,আমার বাড়ি, আমার দ্যাশ ছাড়ব? আমি জানব তোমরা সবাই দূরে গেয়েছ। বিদ্যাশ বলে যেদি না মানি, তাইলে তোমরা যতো দূরে গেয়েছ তার চেয়ে অ্যানেক অনেক বেশি দূর তো ই দ্যাশেই যেতে পারতে। বছরে একবার দুবার মা-কে দেখতে এসো, তাইলেই হবে।
ইচ্ছা করেই কত্তার কথা আর তোললম না। মেজ খোঁকা কিন্তুক হাসিমুখেই বিদায় নিলে। আমি তার পেছু পেছু এসে দেখলম, মালবোঝাই তিনটো গরুর গাড়ি রওনা হয়ে গেয়েছে। নাতনিকে নিয়ে খুঁকি আর একটি গাড়িতে উঠতে যেচে। একবার আমার দিকে তাকাইলে। কত্তাও গাড়ির দিকে যেছিল, কি মনে করে হঠাৎ ফিরে এসে আমার কাছে দাঁড়াইলে, লহমার লেগে তাকাইলে আমার মুখের দিকে, তাপর আবার গাড়ির কাছে ফিরে গেল। কত্ত কবে ফিরবে? এক মাস পরে? দু-মাস? একবছর? দু-বছর? তিনবছর? ফিরবে না কুনোদিন?
এই দোতলা মাটির বাড়ি খুব বড়। একতলায় চারটো ঘর, দোতলায় চারটো ঘর। কটো আর ব্যাভার করতে পারি? দু-একটো বাদে বাকি সব ঘরই পড়ে থাকে। দোতলার একটি ঘরে অ্যাকনো জানেলা বসানো হয় নাই। শুদু এই জানেলা ক্যানে, অ্যানেক জানেলাই অ্যাকনো লাগানো হয় নাই। ভেতরের দিকে অ্যানেক দরজাও নাই। সব দেয়াল ল্যাপা হয় নাই, কাদার ওপরে মিস্ত্রির আঙুলের দাগ দেখা যায়। কত্তা বলে, মানুষ বাড়ি তৈরি শুরু করতে পারে, বাড়ি কুনোদিন শ্যাষ করতে পারা যায় না। তাই বটে! যাই হোক, দোতলার ঐ ফাঁকা জানেলাটির কাছে যেয়ে বসলে ইস্টিশানের সয়রানের অ্যানেকটো দেখা যায়। সেইখানে যেয়ে বসে বসে দেখলম, পাড়ার ভেতর দিয়ে যাবার সোমায় গাড়িচারটো চোখের আড়ালে চলে গেয়েছিল, অ্যাকন আবার তাদের দেখতে পাওয়া যেছে, দিঘির উঁচু পাড়ে উঠে আবার গরানে নেমেছে। গাড়ি আর গরুগুলিকে শুদু দেখতে পেছি, আর কাউকে লয়। পেছনের ঐ গাড়িতে আছে আমারই প্যান্টের ভেতরে-বাড়া নাড়িছেড়া আমার দুটি সন্তান আর তাদের বাপ যি তাদের জনমো দিয়েছিল আমারই ভেতরে। ওরা অ্যাকন চলে যেছে। যে যায় নাই সে আছে ঐ দিঘিটোরই ঢালু পাড়ে কবরের ভেতরে ঘুমিয়ে। সে কুনোদিন যাবে না। একদিন আমি তার পাশেই যেয়ে চেরকালের লেগে ঘুমুবো।