রাগে জ্বলে ওঠার আগে কত্তা আর একবার নরম হলো, তোমার একটিমাত্র মেয়ে, সেই মেয়েটির মুখ মনে করো, তার কোলে যে খুকিটি এসেছে, তোমার বড় খোঁকার যে ছেলে হয়েছে–তোমার নিজের নাতিপুতি, তাদের মুখ মনে করো, ছেলেগুলির মুখ ভাবো।
এই পৃথিবীতে আর কি আছে তোমার?
চেরকাল তাদেরই মুখ মনে করেছি, চেরকাল তাদেরই মুখ মনে করব। মন করলে এইবার তারা একবার আমার মুখের দিকে দেখুক। তাদের মুখ মনে করতে আমাকে তাদের কাছে যেতে হবে ক্যানে? আমার বড় খোঁকার মুখ আজ কতকাল দেখি নাই, আর দেখব-ও কুনোদিন। তা সি মুখটি কি কেউ আমার কাছ থেকে কেড়ে নিতে পেরেছে?
কথা শুনে আর একবার কত্তা নরমসুরে বললে, নিজের নাতি-নাতনির কাছে যাবে না এমন আজগুবি কথা কেন বলছ তুমি? সেখানে গেলে আবার তোমার সব হবে। নিশ্চিন্তে বাকি জীবনটা কেটে যাবে।
ঐ লোভ আমাকে তুমি আর দেখিয়ো না। চারাগাছ এক জায়গা থেকে আর জায়গায় লাগাইলে হয়, এক দ্যাশ থেকে আর দ্যাশে লাগাইলেও বোধায় হয়, কিন্তুক গাছ বুড়িয়ে গেলে আর কিছুতেই ভিন্ মাটিতে বাঁচে না।
কত্তা অবাক হয়ে বললে, তুমি আবার এত কথা কবে শিখলে?
রাগ আমারও হলো, বললম, এতকাল যা শিখিয়েছ তাই শিখেছি, যা বলিয়েছ তাই বলেছি, অ্যাকন একটি-দুটি কথা আমি বোধায় নিজে নিজে শিখেছি।
এই কথার পরে পাকা একটি বছর গেল। কেমন করে যি গেল সি একমাত্তর আমি জানি। একটির পর একটি বড় খোঁকার চিঠি আসে–খুঁকির চিঠিও আসে দু-একটি। চিঠি এলে কত্তা কখনো আমার সাথে কথা বলে, কখনো বলে না। কথা বলবে কি, দু-এক কথা হতে না হতে তকরার শুরু হয়ে যায়, কত্তা ত্যাকন মুখে যা আসে, তাই বলে। একবার খুব সোন্দর একটি কথা বললে, শুনে ভারি আমোদ প্যালম। কত্তা বললে, তোমাকে আমি পরিত্যাগ করব। একবার বললে, দেখি, তুমি কি করে এখানে থাকো। সব বেচেকিনে চুকিয়ে তবে যাব।
মুখে মুখে ঐ মানুষের সঙ্গে আমি কথা বলব সি আমার সাধ্যি কি? আমি একবারও মনে করি নাই যি আমার কথা দিয়ে কত্তার কথা কাটব। আমার শুদু মনে হছিল, কত্তা যাই বলুক আর যাই করুক, আমার কথাটি আমাকে বলতেই হবে আর সেই কথার মতুন কাজ আমাকে করতেই হবে।
শ্যাষ পয্যন্ত কত্তা একদিন বললে, আর এই নিয়ে একটি কথা আমি তোমাকে বলব না। তোমার মতের আর কোনো দরকার নাই। জমি-জমা বদলের কথাবার্তা হয়ে গিয়েছে। একটি বাড়ির ব্যবস্থাও হয়েছে। বাকি আছে আমাদের এই বাড়িটির বিলি-ব্যবস্থা। থাকো তুমি তোমার গোঁ নিয়ে। যাবার দিনে ঠিকই যাবে তুমি।
কথা শুনে খুব নজর করে আমি আমার সারা জেবনের মানুষটির মুখের দিকে চেয়ে থাকলম, কেমন ধুলোর আড়ালে আঁদার আঁদার লাগল। মুখটো। বুঝতে পারলম, কত্তা মিছে কথা বলছে না, আমাকে হুমকিও দিছে না। কিছুদিন থেকে খুব শহরে আনাগোনা করছিল। পাকিস্তান থেকে আসা একটি হিঁদু পরিবারের সাথে বদলের কথা হচে। ধুতি-পরা কেমন একধারা একটি লোক আজকাল পেরায়ই বাড়িতে আসছে।
এইবার আমার সাথে কত্তার কথার শ্যাষ দিনটির কথা বলি। সাঁঝের খানিক পরে কিছুই যেন হয় নাই এমনি ভাব করে হেরিকেনের আলোটো এট্টু বাড়িয়ে দিতে দিতে বললে, ব্যবস্থা সব হয়ে গেল। এই রোববারের পরের রোববারে যাওয়া। বড় খোঁকা আসতে পারছে না, ওদিকের সব ব্যবস্থা তাকেই করতে হবে তো। খুকি আসছে তার মেয়েকে নিয়ে। মেজ খোঁকা আসছে তার সঙ্গে। এক্ষুনি সবার আসার দরকারই বা কি। আসা-যাওয়া তো বন্ধ হচ্ছে না। এখন এই বাড়িটা
সেইখানেই বসে পড়ে আলো-আঁধারিতে কত্তার মুখের দিকে চেয়ে দেখতে দেখতে আমি বললম, কেমন করে বললম আমি জানি না, বললম, এই বাড়িটিতে আমি থাকব।
কে যেন থাবড়া মেরে কত্তার মুখ বন্ধ করে দিলে। জেবনে এই পেথম আমি আমার সোয়ামিকে এমনি করে মারলম, আলো-আঁদারির চেয়েও আঁদার হয়ে এল কত্তার মুখ। খুব, খুব কষ্ট সিখানে। তবে সে আর কততক্ষণ? তখুনি পুরুষ গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, যেখানে খুশি চলে যাও, যেখানে খুশি থাকো গা, এই বাড়ির বদলি-দলিল হয়ে গিয়েছে।
ও কথা শুনেও আমি আমার কথা থেকে সরলম না, এই বাড়িতেই আমি থাকব। আমাকে হাতে ধরে বাড়ির বার করে দিলে তবে আমি যাব।
আর কুনো কথা হলো না। আর তো কথার কিছু নাই। আমিও আর কুনো কথা বলব না। কতো লোক এল, কতো কথা চলল, কতো বুদ্ধি-পরামর্শ দিতে লাগল। ভাইরা সব দলবেঁধে এল, ঝগড়াঝাটি, কাদাকাটা কিছুই বাদ থাকল না। ছোট ভাইটি মাটিতে মাথা কুটতে লাগল। জায়েরা এসে সব আমার গলা জড়িয়ে কেঁদে গেল, রাজ্যের জিনিশ বাঁধাছাঁদা হতে লাগল, কিছু জিনিশ ফেলা গেল। কিছু জিনিশ দান-খয়রাত হলো। মোট কথা দশদিন ধরে বাড়িতে ম-হা-জ্ঞ হতে লাগল। মুখ বুজে, ঠোঁট টিপে আমি সব কাজে থাকলম। তাপর খুকি আসার ঠিক আগের দিন সকালে কত্তা এসে আমার সামনে দাঁড়াইলে। জেবনে এই কত্তা কারুর কাছে মাথা নামো করে নাই। আজ দেখলম আমার ছামনে মাথাটো হ্যাট করে দাঁড়াইলে। শরমে আমি মরে গ্যালম।
তুমি যাবে ধরে নিয়ে ব্যবস্থা করা আছে। কি করছ একবার ভেবে দেখবে না? এমন কাজ কি কেউ কুনোদিন করেছে? যে শুনবে সেই ছি ছি করবে, আমাদের সকলের মুখে চুনকালি পড়বে।
বাড়িটো বিক্কিরি হলো, না বদল হলো?
কোনোটাই এখনো হয় নাই।
ক্যানে?
কত্তা আমার মুখের দিকে একদিষ্টে তাকিয়ে থাকলে, তাপর আস্তে আস্তে বললে, বলতে যেয়ে তার চোখমুখ কুঁচকে গেল, যদি কিছুতেই না যাও, বাড়িটি এইরকমই থাকবে আর তোমার দাদির দেওয়া জমিটাও বদল হবে না।