আমি বোধায় সাত-আটদিন খবর নিতে পারি নাই। সিদিন সকালবেলায় শোনলম, ল-বউ দেখেছিল ননদের ঘরের দরজা ঠেসানো রয়েছে যেমন পেত্যেকদিন থাকে। বউদের মদ্যে ল-বউ এট্টু খোঁজ-খবর করত, দিনে দু-একবার যেত ননদের ঘরে। ইদিকে সকাল গড়িয়ে দোপর হয়ে যেছে। গিন্নি ঘরের বার হচে না। ত্যাকন উকি মেরে দেখে, কাত হয়ে গিন্নি পড়ে আছে, মরে একেবারে কাঠ। বোধায় মরার আগে পানি খেতে গেয়েছিল, কাঁসার গেলাসের পানি সারা ঘরে গড়িয়ে পড়েছে, খালি গেলাসটো বালিশের কাছে পড়ে আছে। কখন জান। গেয়েছে কে জানে? আধশোয়া মড়া ঐ আবস্তাতেই শুকিয়ে শক্ত হয়ে গেয়েছে, মুখের ওপর দিয়ে কালো পিঁপড়ে চলে বেড়াইছে। ল-বউ বললে ঠিক শোবার সোমায়ে সে গিন্নির ডাক শুনতে পেয়েছিল, তার নাম ধরেই ডাকছিল, তা উ রকম করে সব সোমায়ই ডাকত, সে আর গা করে নাই–হায় হায় গো, মরার আগে মুখে এট্টু পানি পয্যন্ত পড়ল না–এই কথা বলে ল-বউ ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।
আর কতো বলব! কথার তো শ্যাষ নাই, তার চেয়ে বরঞ্চ অ্যাকন যি কথাটি বলতে বসেছি সেই কথা বলি। এই কথাটির পরে আমার আর কুনো কথা নাই। এই শ্যাষ কথাটি বলার লেগেই তো এত কথা বললম। সব মানুষেরই একটি করে শ্যাষ কথা থাকে, সেই কথাটির লেগেই তো সারাজেন।
ছেলেমেয়েদের পাকিস্তান যাওয়া ত্যাকন সাত-আট বছর হয়ে গেয়েছে। মেজ খোঁকার ল্যাখাপড়া পেরায় শ্যাষ, সে লিকিন কুনো অ্যাকটো চাকরিতে ঢুকবে ঢুকবে করছে। ছোট খোঁকাও স্কুলে ভালোই ল্যাখাপড়া করছে। আমি ত্যাততদিনে বুঝে গেয়েছি ওরা কেউ-ই আর ই দ্যাশে ফিরবে না। এই সোমায় একদিন সাঁঝবেলায় কত্তা আমাকে বেশ তোয়াজ করে তার পাশে বসাইলে।
বড় খোঁকার একটি চিঠি এসেছে–কত্তা বললে। চিঠি তো মাঝে মাঝেই আসে, দরকার মনে করলে কত্তা পড়তে দেয়, নাহলে দেয় না, শুধু বলে চিঠি এয়েছে, সবাই ভালো আছে। আজ দেখছি, কত্তার। হাতেই চিঠিটো ধরা। বললম, তা সবাই ভালো আছে?
আছে। বড় খোঁকা একটি কথা লিখেছে।
কি কথা? খারাপ কুনো-কথা?
না, না, তা নয়।
কুনো কিছু নিয়েই তো কত্তা কুনোদিন এমন করে না। আজ এমন লুকোচুরি ক্যানে করছে? আবার আমি বললম, তবে?
বড় খোঁকা লিখেছে, সবাই এখন পুব-পাকিস্তানে। হিঁদুদের দেশ, মুসলমানদের দেশ এসব কথা এখন আর নাই। হিঁদুস্থান পাকিস্তান সবাই মেনে নিয়েছে। কথা তা নয়, ছেলেমেয়ে নাতিনাতিন সবাই যখন আর এক দেশে থিতু হয়েই গিয়েছে, তখন আমরা বাপ-মা এখানে একা পড়ে আছি কেন। জমি-সম্পত্তি ঘর-বাড়ির ব্যবস্থা করে আমরাও তাহলে ওদের কাছে চলে যাই।
মাথায় আমার বাজ পড়ল। এমন কথা কুনোদিন শুনব বলে মনে করি নাই। ই কথার মানে কি একবার ভাবতে গ্যালম। পিথিমি ঘুরে উঠল আমার চারপাশে, তাড়াতাড়ি মেঝে আঁকড়ে ধরলম। কোথা যাব, আমি কোথা যাব? মরে গেলে কোথা যাব তা জানি, কবরে যাব, আমাদের এই নতুন বাড়ি থেকে দিঘির উঁচু পাড়ের কবরস্থান দেখতে পাওয়া যায়, মরে গেলে ঐখানে যাব কিন্তুক ই দ্যাশ ছেড়ে কোথা যা আমি কিছুতেই ভাবতে পারলম না। আমার খালি মনে হতে লাগল, ক্যানে যাব কেউ আমাকে বুঝিয়ে দিক। বুঝিয়ে দিলেই আমি যাব, যেখানে যেতে বলবে সেখানে যাব। ওটো মোসলমানদের দ্যাশ আর এটো হিঁদুদের দ্যাশ ই কথা বলে আর কেউ আমার কাছে পার পাবে না। উ যি মিছে কথা, উ যি শয়তানদের কাজ তা অ্যাকন মনে মনে সবাই জানছে। যাদের জান গেয়েছে তারা আল্লার কাছে ফরিয়াদ করে জানতে চাইবে, যারা ভিটেমাটি দ্যাশছাড়া হয়েছে তারাও আল্লার কাছে এই ফরিয়াদ করার লেগে রপিক্ষে করছে। আমি এই কথাটিই কত্তাকে বললম, বড় খোঁকা যা ভালো বুঝেছে বলেছে, তুমি চেরকাল আমাকে সবকথা বুঝিয়ে বলেছ, তুমি অ্যাকন আমাকে বুঝিয়ে দাও, ক্যানে যাবে?
বোঝার কি আছে? ছেলেমেয়ে নাতিপুতি সব যেখানে আছে, সুখে-স্বচ্ছন্দে আছে, ঘরবাড়ি করেছে, সেখানে তাদের কাছে আমরা যাব না?
না, যাব না। ছেলেমেয়েরা করেছে তাদের নিজেদের জেবনের লেগে, তাদের ছেলেমেয়েদের লেগে। আমরা সিখানে যেয়ে কিছুতেই জোড় মিলব না। সি ফাটল তুমি ভরাইতে পারবে?
আহা, আমাদের জীবন তো শেষ। আর আমাদের করার কিছুই নাই।
শ্যাষ তো ভালো কথা। শ্যাষ ইখানেই হবে। শ্যাষ হবার লেগে বিদ্যাশে যেতে হবে ক্যানে?
এমন করে মুখে মুখে তক্ক আমি কুনোদিন কত্তার সাথে করি নাই। কিন্তু আল্লা জানে আমি তক্ক করি নাই, কত্তার মুখে মুখ করি নাই। আমার বিশ্ব-বোম্ভান্ডাে ভেঙে যেচে যি। আমি যি শতেক চেষ্টাতেও কত্তার কথা মেনে নিতে পারছি না? জানের ভেতর থেকে যি কথাগুলিন আসতে লাগল, আমি সেই কথাগুলিন বলতে লাগলাম আর এককথা দুকথা হতে হতে আসল কত্তা বেরিয়ে এল। রাগে কাঁপতে কাঁপতে সে বললে, চিরকাল আমি যা করব বলে ঠিক করি, তাই করি। কারুর কথা আমি শুনব না, আমি সব বেচেকিনে পাকিস্তান চলে যাব।
সি তুমি যেতে পারো তবে চেরকাল তুমি যা ঠিক কর তাই হয় না। তুমি অ্যানেক কিছু ঠিক কর নাই, কিন্তুক তাই হয়েছে। তুমি পাকিস্তান হওয়াও ঠিক কর নাই, তোমার সোংসার ভাঙাও ঠিক কর নাই। কিন্তুক উসবই হয়েছে। পিথিমিতে যত জোর তোমার নিজের পরিবারের ওপর। আর একটি মানুষও তুমি পাও নাই জোর খাটাবার লেগে। তা ইবার আমি বলছি, বড় খোঁকা য্যাতেই বলুক, আর তুমি য্যাতো জোরই খাটাও, আমি যাব না।