আমার যে মেজ খোঁকা গাঁয়ের স্কুলে পড়ছিল, সে একদিন স্কুলপাশ দিলে। কাগজ হাতে করে যিদিন কত্তা বাড়ি ঢুকে আমাকে দেখাইলে খোঁকা ভালো করে পাশ দিয়েছে, সেইদিনই বৈকাল বেলায় শহরে ছোট দ্যাওরের কাছে তারে খবর এল আমাদের একটি লাতিন হয়েছে। একই দিনে দুটি ভালো খবর। ছেলে বড় স্কুলের পাশ দিয়েছে সি খবর ভালো বৈকি, কিন্তুক আমাদের লাতিন হয়েছে, আমাদের একমাত্তর মেয়ের একটি মেয়ে হয়েছে, ই খবরের কি তুলনা আছে? সাত রাজার ধন মানিক হাতে পেলেও ই খবরের কাছে সি কিছুই লয়। সারা দুনিয়ায় ঢোল পিটিয়ে ই খবর জানাইলেও যি আশ মেটে না আর সেই খবর কিনা তারে জানতে পারলে দাওর আর সে খবর নিয়ে নিজে আসতেও পারলে না, একটো লোক জোগাড় করে চিঠি দিয়ে জানিয়ে দিলে। কেউ কোথাও নাই, কেউ এল না ই বাড়ি, নথ নেড়ে নেড়ে, হাসতে হাসতে দাইবউ সোনার মাকড়ি চাইলে না, গাঁয়ের লোক ভেঙে পড়ল না। বাড়ির পেথম লাতিন! হায় রে হায়, বাপের সোংসার, ভাইয়ের সংসার, কত্তার সোংসার সব ভেঙে খান খান। এখন আমি ভালো খবর নিয়ে কি করব?
সাঁঝবেলায় একটি হেরিকেন জ্বালিয়ে দখিন উসারায় বসে আছি। কত্ত-ও আছে। ছেলেদুটিই বাইরে। এখনো ফেরে নাই। মেজ খোঁকার আজ সাত খুন মাপ, কত্তার হিশেবে ছেলে য্যাখন স্কুলপাশ দিয়েছে ত্যাখন বড় হয়ে গেয়েছে, আর তাকে বকাবকি করা যাবে না। সে আজকে পাশ করার খুশিতে গাঁয়ে ঘুরে বেড়াইছে।
হঠাৎ আমি ক্যানে যি কঁদতে শুরু করলম জানি না। দুই দুটো এমন খুশির খবরে কেউ কুনোদিন কাদে? কিন্তুক বুকের তলা থেকে গুমুড়ে গুমুড়ে ক্যানে এমন কাঁদন আসতে লাগল কে বলবে? আমার কেউ নাই, ই দুনিয়ায় কেউ নাই, এত থাকলেও আমার কিছু নাই। পশ্চিম আসমানের দিকে তাকিয়ে মনে হল সি আসমানও ধু ধু করছে, চাঁদ নাই, তারা নাই। কাঁদন শুনে কত্তা চুপ করে বসে থাকলে, একটি কথা বললে না। আমাকে কত্তা আজকাল আর কিছু বলে না! কি জানি, পুরুষমানুষ বলে সে কি আমার মতুন কেঁদে হালকা হতে পারে না?
কদিন বাদে পাকিস্তান থেকে মেয়ের চিঠিতে তার খুঁকি হবার খবরএল। সি চিঠিও কাঁদনের চিঠি, মেয়ের পেথম সন্তান তো বাপের বাড়িতেই খালাস হয়, তা তার ভাগ্যে নাই, তার মেয়ে হয়েছে হাসপাতালে। মেয়ে কালো হয়েছে, কালোর ছটায় ভোবন ভাসছে। অনেক কথা লিখেছে, তার পরে লিখেছে একটি সাংঘাতিক কথা। লিখেছে, মেজ খোঁকা আর তো গাঁয়ে থেকে পড়তে পারবে না, তাকে ছাড়তেই হবে, সে নাইলে খুঁকির কাছেই যেয়ে পড়ুক। জামাই তো কলেজের মাস্টার, খুব সুবিধে হবে, বুনকেও তাইলে আর একা থাকতে হয় না, লতুন খুঁকিও তাইলে মামু পায়।
না, আটকাইতে পারলম না! দুই দ্যাশ আলেদা হবার আমি কিছুই বুঝি নাই, কিছুই বুঝি নাই! ঘর বাড়ি সোমাজ সোংসার সব ভাঙতে ভাঙতে সাত টুকরো হবে; ঘটি-বাটি ভাঙবে, বাসো প্যাটরা ভাঙবে। অ্যাকটো গোটা মানুষও আর গোটা থাকবে না, আমিও থাকব না, কত্তাও থাকবে না। কত্তা এইবার দুটো হবে।
ঠিক তাই হলো। কত্তা আমাকে বেশি কথা বললে না। মেজ খোঁকাও বেশি কিছু বললে না। সে অ্যাকন অ্যাকটো গোটা মানুষ। এই তার স্বাস্থ্য, এই জোয়ান। যেন অন্য মানুষ। আমারই কোলে এতটুকুন ছিল, আমারই বুকের দুধ খেয়ে বড় হয়েছে, কিছুতেই বিশ্বেস হয় না। অচেনা লাগছে, কথা বলতে কেমন লজ্জা লজ্জা লাগছে। বুঝতে পারছি, এখন আর আমার কাছে কিছু থাকার সোমায় লয়, আমার কাছ থেকে সব চলে যাবারই সোমায়।
কথা আর কত বলব? দশদিনের মদ্যে সব বেবস্থা করে মেজ খোঁকা পাকিস্তানে তার বুনের কাছে চলে গেল। পুরনো দিনের সব কথা য্যাকন বলতেই বসেছি, ত্যাকন আর কপাল চাপড়ে কি হবে, এইখানেই বলে রাখি সব শ্যাষের আঘাতটো দিলে বড় খোঁকা। জেনে লয়, ইচ্ছে করে লয়, দিলে দুনিয়ার লিয়মে। দিন চেরকাল কারুর হাতে বাঁধা থাকে না, জেবনের কিছুদিনের লেগে কিছুদিন তাবে থাকে, তাপর হাতছাড়া হয়ে যায়। আমার দিনও এইবার হাতছাড়া হতে লেগেছে, দিন আর অ্যাকন আমার লয়। বড় খোঁকা জানাইলে, সোংসারে সে কুনোদিন কিছু করতে পারে নাই, কুনো কাজেই লাগতে পারে নাই, এখন আর তার কিছু করারও নাই, তাকে পাঁচে-পেরকারে বাস করতে হচে আর এক দ্যাশে। কুনোদিন আর ফিরতে পারবে না। আর কিছু না পারুক, অ্যাকন সে নিজের ছোট ভাইটিকে মানুষ করার দায়িত্ব নিতে চায়। তাকে যেন তার কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়, সে-ই তার ল্যাখাপড়ার দায় নেবে।
পানি কুনোদিন ওপরদিকে গড়ায় না। দাঙ্গাহাঙ্গামায় কই ই দ্যাশের অ্যাকটো মোসলমানকে পাকিস্তানে যেতে দেখলম না। গেয়েছে কিনা আমি কি করে জানব? ই এলেকায় তো দেখলম না। কিন্তুক বড়লোক আবস্তাপন্ন মোসলমানদের লেগে ভালো ঢল নেমেছে পাকিস্তানের দিকে, অ্যানেক মোসলমানই সিদিকে গড়িয়ে যেচে। আমার ছোট খোঁকাটিও একদিন গড়গড়িয়ে চলে গেল। ভালো হলো কি মন্দ হলো, সিকথা আমি বলতে পারব না, শুদু জানলম আমার সব খালি হলো, সাথে আর কাউকে পাব না। এই খালি সসাংসারে একা বসে থাকব। কথাটো কি ভুল হলো আমার? কত্তা তো আছে এখনো! তবে খুব ভুল বোধায় লয়। কত্তা কি আছে আমার? ভেতরে ভেতরে তা মনে হয় না!
পুরনো বাড়ি আমাদের এই নতুন বাড়ি থেকে এট্টু দূরে। সি বাড়ি অ্যাকন আর একটি বাড়ি লয়, ভেঙে ভেঙে অ্যানেক বাড়ি হয়েছে। সবার খুব খোঁজ খবর নিতে পারি না, তেমন কেউ আসে না, ই বাড়িতে, আমিও যেতে পারি না। আছে সবাই আপন আপন ঘর-সংসার নিয়ে। শুদু বেধবা ননদটি থাকে একদম একা। ভাগ্নেদুটির কেউ অ্যাকন আর থাকে না তার কাছে। বড়টি চাকরি করে শহরে, ছোটটি স্কুলপাশ দেবার পরে নিজেদের বাড়িতে চলে গেয়েছে। ননদ তার বরাদ্দ ঘরটিতে একা থাকে। চল্লিশজনার সোংসারে যে ছিল মাহারানী, বারো-চোদ্দটি ছেলেমেয়ে মায়ের চেয়ে বেশি ভালোবাসা পেয়েছে যার কাছে, আকন আর কেউ তার কাছে যায় না। সারাদিনে একটি শিশু তার কাছে খাবার চায় না, তাকে জড়িয়ে ধরে তার শাদা কাপড় ময়লা করে দেয় না, কুনো ভাই তাকে ডেকে একটি কথা জিগাসা করে না। খুব খারাপ একটি রোগে ধরেছিল তাকে। ঘন ঘন পেশাব হতো, খুব খেতে মন হতো, দিন দিন রোগা হয়ে যেছিল।