এই যেদি হবে, পাকিস্তান হওয়া-না-হওয়াতে যেদি কুনো তফাত-ই না হবে তাইলে এমন রক্তগঙ্গা ক্যানে করলে সবাই? এত মানুষ মরল, এত মায়ের কোল খালি হলো, এত সোংসার জ্বলে-পুড়ে ছারেখারে গেল, ইসব কি এমনি এমনি! আর অ্যাকন যি হিঁদু-মোসলমানে চোখে চোখে তাকাইতে পারছে না? একই গাঁয়ে বাস করছে, মাঠে-ঘাটে সব জায়গায় একসাথে হচে, তবু সব সোমায়ে মনে মনে সন্দ হচে এই বুঝিন গলা কাটবে, এই বুঝিন বাড়িতে আগুন দেবে। ছি ছি, চেরকালের লেগে এমন ক্ষেতি করে সারা দ্যাশের মানুষের? আর কি করে তারা একে আরেকের পড়শি হয়ে বাস করবে?
এইসব কথা নিয়ে আমি মনে মনে তোলপাড় করতম বটে, কিন্তুক বাইরে থেকে কিছুই বোঝবার বাগ ছিল না। সবই আগের মতুন। নাপিতবউ আগের মতুনই বাড়িতে আসছে, হাড়িবউকে আজকাল আর আসতে হচে না বটে, বাড়িতে নতুন মানুষ অনেকদিন থেকেই আর নাই। আসবে কিসের লেগে? তবু শুদু কথা বলার লেগেই কখনোসখনো আসে। মজাক করে কথা বলে, ছেলেমেয়েরা থাকলে তারা দাইমা বলে ডাকে। সবই আগের মতুন। একদিন ল-দ্যাওরকে ডেকে বললম, খুব তো লড়কে লেঙ্গে করে পাকিস্তান করলে। সি দ্যাশটি কিরকম, কোথা সি দ্যাশ তা কি জানো? তা এত কষ্ট করে, মারামারি করে যি দ্যাশটি করলে, অ্যাকন সি দ্যাশে যাবে না?
খেপেছ?
ক্যানে, খেপেছ ক্যানে? এত লাফাইছিলে, অ্যাকন কি হলো?
আরে কি মুশকিল? পাকিস্তান যাব কেন? নিজের দেশ ছেড়ে?
তাইলে কার লেগে দ্যাশটি করতে গেয়েছিলে? কার লেগে অত দরদ ছিল গো তোমাদের?
ঠাট্টা করতে করতেই ইসব কথা বলছেলম বটে, কিন্তুক বলতে বলতেই কেমন চড় চড় করে রাগ চড়তে লাগল আমার। দ্যাওর বোধায় বুঝতে পারলে সি কথাটি, সে আর রা-কথা না করে সিখান থেকে চলে গেল। সে চলে গেলেও আমার বুকের ভেতরটা রি রি করতে লাগল। আসলে বড় খোঁকার ঢাকার চাকরি আমার ভালো লাগে নাই। কিন্তুক কাকেই বা কি বলব? সে তার বাপকেও চাকরির কথা কিছু শুদোয় নাই। চাকরি পেয়ে পেথম বার য্যাকন বাড়ি এল, আমিই তাকে জিগগাসা করলম, সবাই ইখানে, তুমি পাকিস্তানে চাকরি নিলে ক্যানে?
চাকরি একটা দরকার ছিল মা, পেলামই যখন, নোব না কেন?
তাই বলে ভিন্ দ্যাশে চাকরি করবে?
ভিন্ দেশ আবার কি?
ভিন্ দ্যাশ লয়? ভিন্ দ্যাশই যেদি না হবে, তাইলে উ দ্যাশের লেগে অত লড়াই করতে হবে ক্যানে? সহজে তো হয় নাই।
ও তুমি কিছু বোঝে না। সে অনেক ব্যাপার।
তা ঠিক, আমি সত্যিই বাবা কিছু বুঝি না! কিন্তুক ইটুকু তো দেখতেই প্যালম, কতো মায়ের বুক খালি হলো, কতো সোংসারে আগুন লাগল। অ্যাকন সব থেমে গেয়েছে, অ্যাকন বলছ উ কিছু লয়। তাইলে কি বাবা সারা দ্যাশের মানুষকে নিয়ে তামাশা করেছে সবাই?
এমন হয় মা, নতুন একটা দেশ করতে গেলে অমন হয়।
তাইলে ইসব কিছুই লয় বলছ ক্যানে? আমরা সবাই য্যাখন ই দ্যাশেই আছি, তুমি সেই ভিন্ দ্যাশে চাকরি নিলে ক্যানে?
তুমি কিছু ভেবো না তো মা। নামেই দুটো দেশ, কাজে এখনো একই আছে। তুমি ধরে নাও আমি এট্টু দূরে চাকরি করছি। কলকাতা থেকে বাড়ি আসতে যতো সময় লাগত, তার চেয়ে না হয় একটু বেশিই লাগবে।
খোঁকার সাথে এইসব কথা হয়েছিল সেই কতোদিন আগে! সাত-আট বছর আগে। খোঁকা ত্যাকন কিছুই বোঝে নাই, আমিও কিছু বুঝি নাই। মনে হয়েছিল, হোকগো পাকিস্তান, এই তো বেশ চলছে দুই দ্যাশ। তেমন কিছু তো এই গাঁয়ে-ঘরে বুঝতে পারছি না। হলে হোকগো পাকিস্তান। কিন্তু বেশিদিন গেল না, দু-তিন বছরের ভেতরেই শুনতে প্যালম, আবার ভায়ানক মারামারি কাটাকাটি শুরু হয়েছে। বাড়ি বাড়ি লুট হচে, সোনা-দানা ধনসম্পত্তি কেড়ে নিয়ে মানুষকে ভিটে-মাটি ছাড়া করছে। শহরেগঞ্জে, টেরেনে, ইস্টিমারে মানুষ মেরে মেরে গাদা করছে আর হাজারে হাজারে মানুষ ই দ্যাশ থেকে উ দ্যাশে যেছে, উ দ্যাশ থেকে ই দ্যাশে আসছে। ই দ্যাশ থেকে কজনা যেছে জানি না, উ দ্যাশ থেকে লিকিন বেসুমার মানুষ সব্বস্ব হারিয়ে ইখানে এসে হাজির হচে। কলকেতায় ইস্টিশানে ইস্টিশানে লিকিনি মানুষের ভিড়ে পা ফেলার জায়গা নাই। আকালের সোমায় য্যাতত লোক গেয়েছিল কলকাতায়, আকন তার চেয়ে অ্যানেক বেশি মানুষ সিখানে গিজগিজ করছে। এইসব শুনে এতদিনে মালুম হতে লাগল যি দুটি আলেদা দ্যাশ হয়েছে বটে! আরও ভালো করে চালুম হলো, যিদিন শোনলম খোঁকা ইবারের ঈদে বাড়ি আসতে পারছে না। বকরিদে আসতে না পারলেও এতদিন ফি ঈদে সে বাড়ি আসছিল, বিয়ে হয়ে বউ নিয়ে যাবার পরেও সবাইকে নিয়ে আসছিল। ইবার আর আসতে পারবে না। পাপোট না কি চালু হয়েছে, সেই বই সরকার না দিলে কেউ উ দ্যাশ থেকে ই দ্যাশে কিম্বা ই দ্যাশ থেকে উ দ্যাশে যেতে আসতে পারবে না।
কপাল এমনি বটে! একমাত্তর মেয়ের বিয়ে হলো ইখানে। কিন্তুক বিয়ের কদিন বাদেই শোনা গেল, জামাই বড় চাকরি পেয়েছে পাকিস্তানে। বিয়ে য্যাকন হয়েছিল, ত্যাকননা ঐ পাস্পোট না কি বলে হয় নাই। তারাও যেছিল আসছিল, ইবার আর তারাও আসতে পারছে না।
এইসব ঘটার পরে আর কোথা কি হয়েছে জানি না, আমার সংসার বড্ড ফাঁকা হয়ে পড়ল। খালি ছেলেদুটি। একজনার স্কুলের পড়া শ্যাষ হলো-হলো, আর একজনা খালি স্কুলে ঢুকেছে। দ্যাশ আলেদা হোক আমি চাই নাই অথচ আমারই ছেলেমেয়ে বিদ্যাশে চলে গেল আর আলেদা দ্যাশের লেগে যারা লাফাইছিল তারা যেমনকার। তেমনিই রইল। বিনা কারণে শুদু হিঁদু-মোসলমানের মাঝখানে একটা ছোঁয়া পড়ে গেল। সেই ছেয়া আর কুনোদিন গেল না। কুনোদিন যাবে কিনা তা জানি না।