দাঙ্গা আস্তে আস্তে কমে আসতে লাগল। ঠিক যেন যুদ্ধ আকাল মাহামারীর মতুন। এই আমাদের জেবনেই ওগুনো সব এল, আবার চলেও গেল। উসব তত মানুষের সোংসারে সব সোমায়ে ঘটে না, আসে আবার চলে যায়। ই দাঙ্গাও বোধায় তাই। দাঙ্গা তো জেবনের লিয়ম নয়, শান্তিই জেবনের লিয়ম। মনে হলো, সারা দ্যাশের মানুষের ভারি জ্বর হয়েছিল, জ্বরে গা পুড়ে যেছিল, চোখ হয়েছিল করমচার মতুন লাল, পিয়াসে বুকের ছাতি ফেটে যেছিল আর মাথা গোলমাল হয়ে শুদু ভুল বকছিল। সেই জ্বর এইবার ছাড়ছে।
এইরকম সোমায়ে, কে আর খবর দেবে, কত্তাই একদিন খবর দিলে, যাও, দেশ তোমার স্বাধীন হয়েছে।
তাই? আমাকে এট্টু বুঝিয়ে বলল–আমি ব্যাগোতা করে ফেলল।
হ্যাঁ, ইন্ডিয়া স্বাধীন হলো, দুশো বছর বাদে ব্রিটিশ দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে। কিন্তু যাবার সময় দেশটাকে কেটে দুভাগ করে দিয়ে গেল। দুভাগ কেন, তিন ভাগ! যেখানে যেখানে হিঁদু বেশি সেইসব জায়গা নিয়ে হিঁদুস্থান, আর যেখানে যেখানে মোসলমান বেশি সেসব জায়গা নিয়ে পাকিস্তান। বাঙালি মুসলমানদের জন্যে পুব-পাকিস্তান। আর একটি ভাগ।
সব হিঁদু সব মোসলমান এই দুই দ্যাশে চলে যাবে?
তাই কি হয় নাকি? যেখানে হিঁদু বেশি সেখানে কিছু কিছু মুসলমান থাকবে আবার যেখানে মুসলমান বেশি, সেখানে হিঁদুও কিছু থাকবে।
আলেদা করবে বলে এমন করলে ক্যানে?
দাঁড়াও দাঁড়াও, আরও একরকম ভাগ হয়েছে বললাম না? আমাদের এই বাংলা ভাগ হয়েছে আর পাঞ্জাব বলে আর একটি দেশও ভাগ হয়েছে। বাংলায় মুসলমান বেশি, হিঁদু কম। তুমি বোধহয় জানো না, বাংলা-বলা লোক ধরলে মুসলমানই বেশি। সেই হিশেবে গোটা বাংলাকেই পাকিস্তানে ঢোকাতে হয়। হিঁদু নেতারা কি তাই হতে দেবে? বাংলাও এখন দুভাগ হয়েছে–যেদিকে হিঁদু বেশি সেই বাংলা হিঁদুস্থানে আর যেদিকে মুসলমান বেশি সেই বাংলা পাকিস্তানে ঢুকেছে।
বাঃ, ই আবার কিরকম কথা? ইখানকার সব মোসলমান পাকিস্তানে চলে যাবে, আর পাকিস্তানের সব হিঁদু হিঁদুস্থানে চলে আসবে?
না, আসবে না। গোঁজামিলই চলতে থাকবে। তুমি যদি মুসলমানের হিশেব করো, তাহলে তোমাকে এই দেশ ছেড়ে দিতে হবে—এ দেশ আর তোমার নয়, তোমাকে যেতে পুব-পাকিস্তান। পুব-পাকিস্তানের হিঁদুদেরও চলে আসতে হবে এখানে। হয়তো তোমার এই বাড়িতে আসবে কোনো হিঁদু গেরস্থ।
কথা শুনে আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল।
নাক তো চাও নাই–কাজেই নাক পাও নাই তবে নরুন একটা পেয়েছ–ঐ নিয়ে সন্তুষ্ট থাকো।
এই বলে কত্তা বেরিয়ে গেল।
২৮. আর কেউ নাই, এইবার আমি একা
বাড়িতে আমি একা রয়েছি। আর কেউ নাই, আর কেউ থাকবে না। আজ দোপরের খানিক বাদে চেরকালের লেগে কাটান-ছিটেন করে। সব চলে গেল! ত্যাখন বাড়িভরা মানুষ ছিল। মনে হয় কেউ কেউ মজা দেখতে ই বাড়িতে ঢুকেছিল, অ্যানেকের দাড়ি-গোঁফের তলায় এট্টু এট্টু হাসি আমি দেখতে পেয়েছি।
কদিন ধরে জ্বর আসছে। ঘুষঘুষে জ্বর আর খুসখুসে কাশি। দোপরের পর থেকে মাথা টিপটিপ করে, সাঁঝবেলার মদ্যেই জ্বরটো চলে আসে। গা টিসটিস করে, জাড়-জাড় লাগে, রেতে অ্যানেকদিন খাই না। কাউকে কিছুই বলি নাই। আজ জ্বর এয়েছিল সকাল থেকে। মেয়ে এসে বলেছিল, মা, তোমার মুখটা এত শুকনো লাগছে কেন? বললম, কই না তো। শুনে মেয়ে কাছে এল। ছেলেমেয়েরা কুনোদিন আমার গা-লাগোটা লয়। ওরা কেউ-ই তো শিশুকালে আমার হাতে খায় নাই, ঘুমোয় নাই। সেই লেগে ওরাও তেমন গায়ে-লাগা লয়, আমারও ছেলেমেয়েদের গায়ে মাথায় হাত দিতে কেমন লাগে। আজই দেখছি, মেয়ে একদম কাছে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললে, মা, এখনো একবার ভেবে দ্যাখো। কাগজ-পত্র সব তৈরি হয়ে আছে, তুমি হ্যাঁ বলো। মা, তুমি যা করছ, তা কি কেউ কোনোদিন করে, না করতে পারে। কে কবে শুনেছে স্বামী ছেলেমেয়ে সবাই দেশান্তরী হচ্ছে আর শুধু মা তাদের সাথে যাচ্ছে না, সব ছেড়ে একা পড়ে থাকছে? আমাকে বলতে পারো কেন এমন করছ?
মেয়ে জড়িয়ে আছে, তবু ভেতরে ভেতরে আমি শক্ত হয়ে গ্যালম। একে তো ত্যাকন এট্টু জ্বর এয়েছে, আমি কথা বলতে পারছি না, চোয়াল আটকে আটকে যেছে। আমি বললম, ই নিয়ে আর কথা বোলো না, মা!
মা, তোমার গায়ে কি জ্বর?
না না, উ কিছু লয়।
আজ দশ বছর ধরে এই লতুন বাড়িতে আছি। সোংসার পেথক। হবার পর থেকেই ইখানে। এক সোংসারে থাকার সোমায় কত্তা যি একটো ভিটে কিনেছিল মাটির একটি ঘরসুন্ধু, সেই ঘরটি ভেঙে এই ভিটের ওপর একটি দোতলা কোঠাবাড়ি করা হয়েছিল। ভাইদের সোংসার আলো হয়ে যাবার কিছুদিন পরে লতুন বাড়ি তৈরি হয়ে গেলে আমরা এখানে চলে এয়েছেলম। ত্যাকন থেকেই ফাঁকা বাড়িতে থাকার ওব্যেশ হয়ে গেল। ছত্রিশ জনার হৈ চৈ, চাঁ ঊ্যা-তে রাতদিন সরগরম সোংসার ছেড়ে এই বাড়িতে এসে পেথম পেথম আমার দম বন্ধ হয়ে আসত। করার কিছু ছিল না। সসাংসার অ্যাকন ছোট, বলতে গেলে কত্ত আর আমি আর ছোট দুটি ছেলে। একটি গাঁয়ের স্কুলে পড়ে আর একটি খুব ছোট। বড় খোঁকা বাড়িতেই ত্যাকন থাকত। পাকিস্তান হবার পরে সে কলেজের পড়া ছেড়ে দিয়ে একটি চাকরি খুঁজতে লাগল। তাকে দেখতেই প্যাতম না, ন-মাস ছ-মাসে একবার বাড়িতে আসত। শোনলম, এখানে চাকরির বাজার খারাপ, সে চাকরি খুঁজতে পাকিস্তানে যাবে। তাপর সত্যি সত্যিই শোনলম সে পাকিস্তানে চলে গেয়েছে আর ঢাকায় একটি চাকরিও পেয়েছে। খুশির খবরই বটে, আমার পেথম পেথম তেমন কিছু মনে হয় নাই। কলকাতায় যাওয়া আর ঢাকায় যাওয়া ত্যাকন একইরকম লাগত। খোঁকা ঘন ঘন বাড়ি না এলেও বছরে একবার তো আসত। শোনলম, শুদু দূর এটু। বেশি, কলকাতা আর ঢাকায় তফাত কিছু নাই, যাতায়াতে সোমায় এট্টু বেশি লাগে এই যা।