কত্তামার এই কথার পরে বউটি আবার আমার সব গয়না সেই বাসোয় ভরে বাসোটা বন্ধ করে চাবি আমার ছামনে রেখে দিলে। কি বাহার সেই গয়নার বাক্সোর! তার সারা গায়ে হাতির দাঁতের কাজ, কেমন সব মনোহারী নকশা। আর চন্দনকাঠ দিয়ে তৈরি বলে সেই বাসো হাতে করলেই সুবাস। সেই গন্ধ সেই নকশা আর এই পিথিমিতে নাই। কুথাও কুনোদিন উ আর কেউ পাবে না।
গয়না পরা হয়ে গেলে শাদা পাথরের বড় এক থালায় নানারকম সন্দেশ-মিষ্টি সাজিয়ে আমার ছামনে রেখে দিলে। ইমিষ্টি গাঁ-ঘরে মেলার কুনো কথাই নাই, শহর থেকে আনাতে হয়েছে। তাপর পায়েস, ক্ষীর আরও কতো কি যি এল হিশেব নাই। কামা শুদু বললে, বউমা, খাও।
অত মানুষের ছামনে একা কি কিছু খাওয়া যায়? কুনোমতে এক-আধটু খেয়ে আমি হাত গুটিয়ে বসে থাকলম।
সব শ্যাষে কত্তামা কষ্ট করে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললে, বউমা, মনে রেখো, তুমি আমার বড় ছেলের বউ। তোমার কিন্তু দেওর-ননদ আছে। তারা সব ছোট। তাদের যখন বিয়ে-থা হবে তখন আমি হয়তো থাকব না, তোমাকেই সব দেখেশুনে নিতে হবে।
কত্তামা-ও দেখলম পেঁয়োভাষায় কথা বলে না। আমি পালকিতে ওঠার পরে কত্তাকে নাম ধরে ডেকে বললে, বউমা আমার সোনার পিতিমে, খবরদার তাকে কোনোদিন কষ্ট দিবি না। তাতে তোর ভালো হবে না।
একটো মজার কথা বলি। এত যি কাণ্ড হলো, কত্তামা কিন্তুক একবারও আমার গায়ে হাত দিলে না, ছুঁলে না। জানা কথা, সব মিটে গেলে কত্তামা আর একবার গা ধুয়ে কাপড় বদলে তবে ঘরের কাজ করবে।
০৫. বড় সোংসারে থই মেলে না
লতুন বউ আমি এসে ওঠলম ডোবা থেকে দিঘিতে। বড় সংসার, কিছুতেই থই মিলছে না। আমাদের বংশও বড় ছিল বটে, গাঁ-জোড়া। বংশ। তবে সিসব আলো আলেদা ভাই-ভায়াদের সোংসার। আমাদের নিজেদের সোংসার ছোট, মা য্যাকন বেঁচে ত্যাকনো ছোট। তার মরার পরে কিছুদিন তো আরও ছোট। লতুন মা আসার পরে একে একে ভাইবুনগুলিন হতে হতে য্যাকন আমার বিয়ের সোমায় হলো, ত্যাকন সোংসার কতকটা বড় হয়েছে বটে, তা বলে ই বাড়ির মতুন লয়। কত্তারা পাঁচ ভাই। আমাকে নিয়ে বউ দুটো। মোটে বড় আর মেজ এই দুই ভাইয়ের বিয়ে হয়েছে। আর আর ভাইয়ের ত্যাকননা বিয়ে হয় নাই। ছোট ভাইটি তো খুবই ছোট, আট-ল বছরের হবে। চার বুনের মধ্যে দুজনার বিয়ে হয়েছে। বড় বুনটি স্বামী-সংসার নিয়ে গাঁয়েই থাকে। মেজজনার পোড়া কপাল। মাত্তর ল-বছর বয়েসে বেধবা হয়ে এই সোংসারেই ফিরে এসেছে। বাকি দুজনার অ্যাকনো বিয়ে হয় নাই। এত লোক সোংসারে, তবে সবার ওপরে আছে আমার শাশুড়ি। তার বয়েস হয়েছে বটে কিন্তুক ত্যাকনো খুব শক্তদু-চারটা চুল পেকেছে, দাঁত একটিও পড়ে নাই, গোটা সুপুরি চিবিয়ে খেতে পারে। শাশুড়ি ফিট শাদা, কত্তার মতুন শামলা লয়। বেধবা মানুষ, শাদা ধুতি পরনে, কপাল পয্যন্ত লাজ-কাড়া, ঠিক বউমানুষের মতুন। দেখার সাথে সাথে বুঝতে পারলম এই শাশুড়ি-ই ই বাড়ির গিন্নি। তার পরের গিন্নি ঐ বেধবা ননদ। ল-বছরেই বেধবা হয়ে ভাইদের সোংসারে এয়েছে। ই বাড়ির লিয়ম ঠিক হিঁদুদের মতুন, বেধবার বিয়ে নাই ই বংশে। এই ননদ ত্যাকন ভরা যোবতী। আমার চেয়ে বড় বটে, তবে বেশি বড় লয়। বয়েসে চার-পাঁচ বছর বেশি হতে পারে।
আমি লতুন বউ হয়ে থাকলম আর কদিন? কানে তুলো পিঠে কুলো চোখে ঠুলি লাগিয়ে সোংসারের ঘানিতে জুতে গ্যালম দু-দিন যেতে না যেতেই। তবে, এই এক সুবিদা, ই সোংসারে আমার দেখার কিছু নাই। বাড়ির গিন্নি আছে, সেই দেখবে। যা করবার সেই-ই করবে। বড় বউ আর আমি শুদু ঘুন্নিপাক খেলেই হয়ে যাবে। হ্যাঁ, সেই যি ঘানি টানতে লাগলম, সারা জেবন একবারও আর থামতে পারলাম না। ডাইনে বললে ডাইনে, বাঁয়ে বললে বাঁয়ে। শুদুই হুকুম তামিল করা। অ্যাকন মনে হয়, জেবনের কুনো কাজ নিজে নিজে করি নাই, নিজের ইচ্ছা কেমন করে খাটাতে হয় কুনোদিন জানি নাই। আমি কি মানুষ, না মানুষের ছেয়া? তা-ও কি আমার নিজের ছেয়া?
তবে নিশ্চিন্তি বটে! কুনো কিছু তো নিজেকে ঠিক করতে হবে — যা করবার, যা বলবার গিন্নি করবে, গিন্নি বলবে। আর সি কি যে-সে গিন্নি! ঐটুকুন মানুষ, শাদা শাড়িতে কপাল পয্যন্ত ঢাকা, শরীলের কোথাও এতটুকু ধুলোবালি লেগে নাই। এত পোষ্কার থাকে কেমন করে মানুষ তাই ভাবতম। মুখে একটি-দুটি কথা, ভালোবেসেও লয়, মন্দবেসেও লয়। আর না-পছন্দ কুনো কিছু করলে দু-একটি বাকি যা বলত তা যেন কল্জে ছাদা করে দিত। এইটোতেই ভয় লাগত বেশি। তবে বিচের ছিল বটে। একটি অন্যায় কাজ লয়, অন্যায্য কথা লয়। কুনো কিছু নিয়ে দুই দুই করা লয়। একেবারে সুক্ষ্ম ষােলো আনা ন্যায্য বিচের। এমন না হলে কি অত বড় সোংসার থাকে? সেই লেগে বলি শাশুড়ি যেন ই জগতের লোক ছিল না।
ইদিকে সোংসারের কত্তা কিন্তুক মেজ জনা, আমার সোয়ামি। তার বড় ভাই, আমার ভাশুর, কত্তার চাইতে ক-বছরের বড় হলে কি হয়, সে ছিল খুব আলাভোলা মানুষ, নেতান্তই ভালো মানুষ। বিষয়-সম্পত্তির কুনো কিছুতেই তার আঠা ছিল না। জেবনের শ্যাষ দিন পয্যন্ত সে যেন কত্তার ছোটই থেকে গেল, কুনো দায়-দায়িত্ব নিলে না। ছোট ভাইকে যেন এট্টু ভয়ই করত মনে মনে। তার ছিল খাওয়ার শখ, জামা-কাপড়ের শখ। তবে সি আর কতোটুকুনি! ছেলেপুলে হলো না কুনোদিন, ভাইবুনদের ছেলেমেয়েরাই ছিল তার সব। ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের কি ভালোই যি বাসত! বিশেষ আমার ছেলেমেয়েদের। পর পর দুই খোঁকার পরে আমার একটি খুঁকি হয়েছিল। সেই খুঁকি ছিল তার জান। বাড়িতে সে থাকতই না পেরায়। অ্যানেক দিন পরে পরে য্যাকনই বাড়ি আসত, সঙ্গে থাকত হাঁড়িভরা মিষ্টি। মিষ্টি ছাড়া বাড়ি ঢুকত না। হয়তো ব্যাবসার টাকা লষ্ট করে কিংবা টাকা ধার করে ছেলেমেয়েদের লেগে মিষ্টি, খ্যালনা এইসব আনত আর কত্তার কাছে মুখ শুনত এই লেগে। কত্ত বলত শুদু শুদু টাকা লষ্ট করবে কেন? কঠিন কঠিন কথা শুনে ভয় আর লজ্জা নিয়ে এমন করে দাঁড়িয়ে থাকত ছোট ভাইয়ের ছামনে, যেন চোরের দায়ে ধরা পড়েছে। কিন্তুক ঐ পয্যন্তই। কথা এক কান দিয়ে শুনলে আর এক কান দিয়ে বার করে দিলে। বাড়িতে ঢুকলেই ছেলেপুলেরা কেউ ঘাড়ে, কেউ মাথায়। কেউ তো আর তাকে বড় চাচা বলত না, বলত বড় বাপ। সোংসারের সব দায় ঐ মেজ কত্তার হলেও আবার ইদিকে দ্যাখো তেমন দরকার পড়লে সে খবর দিয়ে বড় কত্তাকে বাড়িতে ডেকে এনে জিজ্ঞেস করত অমুক কাজটা করবে কি না। বড় ভাই-ও তেমনি, তার শুদু একটি কথা, মন হলে করো গা, ভালো মনে হলে করো গা। আমাদের এমন অবাক লাগত! য্যাকন-ত্যাকন বড় ভাইকে এই বকা তো সেই বকা! আবার তেমন তেমন ব্যাপার হলে তার কাছেই হুকুম চাওয়া। কিন্তুক ইকথাও বলতে হবে, ছোটকে যি কতোটা সমীহ করতে হয়, যেদি ছোট তেমন সনমানের যুগ্যি হয়, তা-ও দেখেছি এই সোংসারে।