তাপর জান-পরান দিয়ে ইসুফ মিয়ে এক ঘর থেকে আর এক ঘরে ছুটে পালাইছে, গায়ে মাথায় পড়ছে দুদ্দাড় করে লাঠির বাড়ি। ঝুঁঝিয়ে রক্ত ঝরছে সব্বাঙ্গ দিয়ে আর গোটা দলটো আসছে তার পেছু পেছু। ই ঘর উ ঘর, কতো ঘর ই বাড়ির তার হিশেব নাই। ইসুফ মিয়ে একবার পালঙ্কের আড়ালে লুকুইছে, একবার আলমারির পেছনে দাঁড়াইছে, নাই, রক্ষা নাই, টাঙ্গি খাড়া লাঠি সব এক সাথে চলল। শ্যাষে রান্নাঘরে ঢুকে আর কুনোদিকে সে যেতে পারলে না, হুড়মুড়িয়ে পড়ে গেল। দেখতে দেখতে খাঁড়া টাঙি রামদায়ের কোপে ইসুফ মিয়ের শরীল সাত টুকরো হয়ে চারিদিকে ছিটিয়ে পড়ল।
আমি নিজে তো যাই নাই, নিজের চোখে দেখিও নাই, কিন্তুক এই বেবরণ শুনেই আমি যেন সব ঘটনা চোখের ছামনে দেখতে প্যালম। তারপর থেকে খালি ওয়াক দিতে লাগল প্যান্টের ভেতর। কিছু খেতে গেলেই বমি আসছে। কিন্তুক কিছুতেই বমি হচে না। রেতে ঘুমুইতে যেয়ে চোখ বন্ধ করলেই যেন দেখতে পেচি ইসুফ মিয়েকে একদল লোক একসাথে কোপাইছে।
সত্য আর ইসুফ মিয়ের মিত্যুর বেত্তান্ত শোনবার পর ভেবেছেলম আর হয়তো এমন খবর কুনোদিন শুনতে হবে না। তাই কি কখনো হয়? আমি শুনছি না, জানছি না বলে কি দাঙ্গা বন্ধ হবে? শুনতে চাই নাই তবু কদিন বাদেই শুনতে প্যাম পাশের গাঁয়ের মোসলমানদের একটি ছেলে জেলার বড় শহরে স্কুলে পড়ত। আমার খোঁকার বয়েসি। মনে হচে যেন দেখেছি ছেলেটিকে, খোঁকার সাথে একবার দুবার এয়েছে ই বাড়িতে। সে মোকাদিম বাড়ির ছেলে না হোক আবস্তাপন্ন গেরস্থ ঘরের ছেলে বটে। শহরে তাদের নিজেদের ছোট বাড়িতে সেই সোমায়ে সে একাই ছিল, আর কেউ ছিল না বাড়িতে। একদিন দোপর বেলায় আজরাইল এল তার জান কবচ করতে। কোথাও পালাইতে পারলে না। ছুটে যেয়ে বাড়ির খাটা পাইখানায় লুকিয়েছিল। সেইখানেই খাঁড়া বগী ছোরা ছুরি কিরিচ নিয়ে একদল হিঁদু যেয়ে তাকে কেটে কুচি কুচি করলে। আহা, জড়াপুটুলি পাকিয়ে পায়খানা-ভরা পাতনাতেই সে মুখ গুজে মরে পড়ে থাকল।
এই দুটি ভায়ানক খবরের পরে আমার দ্যাওর আর গাঁয়ের সব মোসলমানরা বলতে লাগল, মোসলমান সব মেরে শ্যাষ করবে হিঁদুরা, দ্যাশে একটি মোসলমানকে আর তারা বাঁচিয়ে রাখবে না। বিশেষ করে দ্যাওর-রা এক-একদিন এক-একটি গুজব নিয়ে আসতে লাগল। কুনোদিন এসে বলছে, সাত গাঁয়ের হিঁদু এক হয়েছে, মা কালীর পুজো দিয়ে কপালে সিঁদুর লেপে খাড়া হাতে করে তারা সব সাঁঝরেতে ই গায়ে এসে হামলা করবে মোসলমানদের ওপর। কুনোদিন বলছে, অত সোজা হবে না, মোসলমানকে যারা চেনে নাই, তারা চেনে নাই। পাশের মোসলমান গাঁয়ের সব মোসলমান আজ সেজে আসছে। আগে এই গাঁয়ের হিঁদুকটোকে সাফ করবে, তবে অন্য কথা।
এইবার আমি কি করব? হিঁদু আর মোসলমানকে আলেদা না করে কি করব? কিন্তুক য্যাতত আলেদা করতে যেচি ত্যাতত যেন পাঁকে ডুবে যেচি! খালি মনে হচে দুজনা মোসলমানের এমন মরণের কথা শুনেই কি ভাবছি হিঁদু জাতটোই এমনি? তাইলে কি দুজনা হিঁদুর মোসলমানের হাতে এমুন মরণের কথা শুনলে ভাবতে হবে মোসলমান জাতও ঐ রকম? তাইলে সত্য-র যি মাকে দেখে এয়েছি সে আর ইসুফ মিয়ের মা যদি অ্যাকনো বেঁচে থাকে, সেই থুথুড়ি বুড়ি মা-টো কি আলেদা?
খবর সোমানে আসত লাগল। হাজার হাজার মোসলমান যেমন মরছে হাজার হাজার হিঁদুও লিকিন তেমনি মরছে। কারা কম, কারা বেশি ভেবে লাভ নাই। বাড়ির কাজকর্ম ছেড়ে বাইরের ঘরের জানেলা দিয়ে পাড়ার রাস্তার দিকে চেয়ে থাকি। ছেলেমেয়েরা কাছে আসে না, কোথা কোথা ঘুরে বেড়ায়। মেয়েটি থাকে ননদের কাছে। একা বসে আকাশ-পাতাল ভাবছি। সব ঠিক আছে, পাখি ডাকছে, বাতাস বইছে, আসমান ভেঙে মানুষের মাথার ওপর পড়ছে না, রাস্তা পথ। ঘাট যেখানকার যেমন তেমনি আছে এর মধ্যে খালি মানুষ মানুষকে মারছে! কলকেতার রাস্তায় ডেরেন দিয়ে কলকল করে মানুষের রক্ত বয়ে যেছে। মোসলমানের রক্ত, হিঁদুর রক্ত। আলেদা কিছুই লয়, একই রক্ত। ঐ ডেরেনে হিঁদু-মোসলমান এক। ” কত্তাকে বলতে সে বললে, পড়তে কি ভুলে গিয়েছ? পড়ে দ্যাখো না? কাগজ আসা তো এখনো বন্ধ হয় নাই! পড়লেই বুঝতে পারবে, সব কিছু খালি তোমার এই পাড়াগাঁয়েই হচ্ছে না। সারা দেশে আগুন জ্বলছে। কলকাতায় হিঁদু বেশি, মুসলমান কম, কাজেই সেখানে মুসলমান মারা পড়েছে বেশি। মোটকথা এখন আর স্বাধীনতা টাধিনতার কথা নাই, স্বাধীনতা দাও আর না দাও, দেশ ভাগ করে দাও।
তাপর একদিন কত্তা বললে, গান্ধি নোয়াখালি গিয়েছে। সেখানে মুসলমান বেশি, খুব হিঁদু মারা যাচ্ছে। বিহারে মুসলমান মরছে বেশি। গান্ধি কলকাতাকে একরকম করে থামিয়েছে, নোয়াখালি বিহারকেও হয়তো এখন থামাতে পারবে, কিন্তুক ইংরেজরা যা চেয়েছিল তাই হলো। হিঁদু-মুসলমান দুই জাতকে চিরদিনের মতো একে-অপরের শত্রু করে দিলে। পাকিস্তানের নাম করে জিন্না ইংরেজদের কাজটিকেই করে দিলে আর ক্ষমতার লোভে পড়ে নেহেরু-রাও তাই করলে। প্যাটেল, শ্যামা মুখুজ্জে মুসলমানদের আলাদা করে দিতে চেয়েছিল, তাই হলো। গান্ধি এখন একঘরে। দরজায় দরজায় তাকে কেঁদে মরতে হবে।
কত্তার সব কথা ভালো বুঝতে পারলম না। শুধু এই বোঝলম, বেপদ মুটেই শ্যাষ হয় নাই, মাহা বেপদ নেমে আসছে, সব লন্ডভন্ড হবে। এই দাঙ্গাই হবে অছিলা। মানুষ যি আবার সব ভুলে যাবে, আবার হিঁদু-মোসলমান একসাথে বসবাস করবে, সুখে-দুখে দিন। কাটাবে, এর কাজ উ করবে, ওর কাজ ই করবে, সবই হবে কিন্তুক তার এ সব ওলটপালট হয়ে যাবে।