বিষ কেরমে কেরমে কি আমার ভেতরেও ঢুকতে লাগল? এতদিন যা জেনেছেলম, যেমন করে চলেছেলম, সব কি বদলে যেছে? আস্তে আস্তে আমারও মনে হচে দিন আর রেতের মতুন হিঁদু-মোসলমানও দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেয়েছে। কে দিন আর কে রাত অ্যাকনো জানি না। সব গোলমাল হয়ে যেছে। কত্তার যি এত জ্ঞান, সেই কত্তাও অ্যাকন চুপ! একার সোংসারে সারাদিন খেটে মরি, কুনো কুনো দিন সকালে, কুনোদিন সাঁঝবেলায় গুমুড়ে গুমুড়ে কাঁদন আসে, চুপে চুপে কঁদি, শব্দ করে কাদি। কেউ কি শুনতে পায়? শুতে এলে কত্তার সাথে দেখা হয়, সে-ও চুপ, মরিয়া হয়ে একদিন শুদুই, ইসব কি হচে? তুমি এমন চুপ ক্যানে?
আমার কিছু করার নাই, এখন আর আমার কিছু করার নাই।
বাঃ, তোমার কিছু করার নাই, তাইলে কে করবে? এতকাল ই সোংসারের লেগে, ই এলেকার লেগে তুমিই তো সব করে এয়েছ?
আমার সময় চলে গিয়েছে। আমাকে ছেড়ে সময় চলে যাচ্ছে, আমি দেখতে পাচ্ছি। এ এমন আগুন লেগেছে, আমি তো আমি, হিঁদু-মুসলমানের কোনো নেতাই এখন আর এই আগুন সামলাতে পারবে না। খেলা করতে গিয়েছিল আগুন নিয়ে। এখন সেই আগুনে দেশ পুড়ে ছারখার হচ্ছে এ তাদের দেখতেই হবে। যতসব জোচ্চোর বদমাশ!
কত্তা কাকে গাল দিচে, ক্যানে এত হেঁয়ালি করছে তা আমার মাথায় কিছুতেই ঢুকল না।
হেঁয়ালি না করে আমাকে বলে দিকিনি দ্যাশ ভাগ হবে কি হবে?
আগে সব পুড়ে ছাই হোক, তারপরে পোড়া দ্যাশ ভাগও হবে, স্বাধীনও হবে।
বোঝলম কত্তা এর চেয়ে পোঞ্চর করে আর কিছু বলবে না। তারপর বেশিদিন যায় নাই, একদিন সাঁঝরেতে আমাদের গাঁয়েই হ্যাঙ্গামা লাগল হিঁদু-মোসলমানদের মদ্যে। কারণ সামান্য। শ্যাভেদের একগাদা আউশ ধান পিটনোর লেগে খামারে রাখা ছিল, বোধায় জায়গা হয় নাই, খানিক আঁটি রাস্তায় গাদিয়ে রেখেছিল। হাজরাদের মোষের গাড়ি রাস্তার সেই ধানের গাদা মাড়িয়ে চলে গেয়েছে। সাঁঝরেতে দেখতে পায় নাই হতে পারে আবার ইচ্ছে করেও হতে পারে। শ্যাভেদের কত্তা দলিজে বসে লোকজন নিয়ে তামুক খেছিল। সে গজ্জন করে উঠল, ধানের গাদা মাড়িয়ে গেলি যি?
অন্ধকারের মধ্যে দেখতে পাই নাই।
জোসনা রেতে আবার আঁদার কি? দেখতে পাস্ নাই মানে?
দেখতে পাই নাই, পাই নাই, কি করবে কি তুমি? যা করেছি, বেশ করেছি।
বাস, আর যায় কোথা। শ্যাখের বড় ছেলে তাগড়া জোয়ান, সে কুদি মেরে ছুটে যেয়ে হাজরার ঘাড়ে লাফিয়ে পড়ল। এক ঝটকায় তাকে ছাড়িয়ে নিয়ে হাজরা বললে, থাকল এই আমার গাড়ি। সবাইকে খবর দিয়ে আসছি আবার। বাপের ব্যাটা হলে গাড়ি তখন আটকে রাখিস।
আসলে ইসব কিছুই লয়। হিঁদু-মোসলমান দু-পক্ষই ভেতরে ভেতরে তৈরি হছিল। আগুন এতদিন ধোঁয়াইছিল, আজ এট্টু ফুই পেতেই দপ করে জ্বলে উঠল। খানিকক্ষণের মদ্যেই সারা গায়ের হিঁদু-মোসলমান মুখোমুখি এসে দাঁড়াইলে। আমার দ্যাওর-রা সব ছুটে বেরিয়ে গেল। লাঠি কাটারি গাঁইতি শাবল যে যেমন পেলে হাতে নিয়ে ছুটলে। ছি ছি ছি! সবাই কি সব ভুললে? এক মাঠ, এক ঘাট, এক রাস্তা, এক খরানি, এক বর্ষা, এক ধান–হায়, হায়, দু-দলের মাত্তর কটো লোকের লেগে সব বরবাদ হয়ে গেল! সি যি কি চেল্লানি, কি হাঁকাড়ি কানে আসতে লাগল কি বলব! জোস্না রাত খান খান হয়ে যেতে লাগল। নোংরা কথায় বাতাস ভরে উঠল। সি-সব কথা শুনে আমার গা পাক দিতে লাগল। কত্তা ঠায় পরচালিতে বসে। মানুষের সামান্য বেপদে যে কুনোদিন ঘরে বসে থাকে নাই, আজ এই মাহা বেপদেও সে থির বসে থাকছে কি করে? সি কথাটি তাকে বলতে গ্যালম।
আমি খবর পেয়েছি, শুধু আমাকে মারার জন্যেই আজকের এই ব্যাপার। আমাকে পেলেই মেরে ফেলবে, তারপর সব মিটিয়ে ওরা চলে যাবে। হিঁদুদের বিশেষ কাউকে মারার কোনো কথা আমাদের মুসলমানদের মধ্যে আছে কিনা জানি না।
কথা শুনে গা শিউরে উঠল। তাড়াতাড়ি সেখান থেকে চলে অ্যালম। এই কি সব হিঁদুদের মনের কথা? লয়, তা কিছুতেই নয়, ই শুদু দু-চারজনা মাথা মাথা মানুষ আর কটো বজ্জাত হিংসুক ছেলেছোকরাদের মতলব। আমার এই কথাই ঠিক। দু-পক্ষেরই কজনা মানুষের গলা কানে আসতে লাগল। তারা শুদু শুদুইতে লাগল, কাকে মারবে আর ক্যানে মারবে। আর মানুষ মারলে কার কি লাভ হবে। * শ্যাষ পয্যন্ত হলো না কিছু। সারারাত চেঁচাইতে চেঁচাইতে ঘ্রান্ত হয়ে ভোরবেলায় সবাই নিজের নিজের বাড়ি চলে গেল।
ই গাঁয়ে কিছু হলো না বটে, তাই বলে সারা এলেকায় কি কিছুই ঘটে নাই? দাঙ্গা লাগানোর এমন সুযোগ কি কেউ ছাড়ে? চেরকাল দেখে আসছি দুনিয়ায় একটো-দুটো মানুষই সব লষ্টের মূল। রাখাল যেমন করে গরু ডাকিয়ে নিয়ে যায় তেমনি করে এই একটো-দুটো মানুষই ঘরো ভালোমানুষদের ডাকিয়ে নিয়ে যেয়ে গাড়ায় ফেলে। শহরগঞ্জেই এমন খারাপ মানুষ বেশি বোধায়। দাঙ্গাহাঙ্গামা সব সোমায় শহরেই শুরু হয় এই লেগে। গাঁয়ের মানুষ শহরে গেলে সব ভুলে যায়, তার পাড়াপড়শি থাকে না, ভাইবন্ধু থাকে না। সে কাউকে চেনে না। পাশের বাড়িতে যে থাকে তাকেও লয়। ছোট দ্যাওরের শহরের বাসায় দু-একবার গেয়েছি বটে কিন্তু কিছুতেই জান টেকে নাই।
হিঁদু-মোসলমানের হিড়ি যেদি পাড়াগাঁয়েই চলে এল, তাইলে টাউন শহর কি বাদ থাকবে? ঠিক, একদিন খবর এল, মউকুমা টাউনের ইসুফ মিয়েকে তার নিজের বাড়ির ভিতরে যেয়ে মেরে এয়েছে হিঁদুরা। খুব নাম করা মোকাদিম এই ইসুফ মিয়ে। তার চামড়ার ব্যাবসা। মোসলমানদের মদ্যে তো বটেই, হিঁদুদের মদ্যেও এমন আবস্তাপন্ন মানুষ বেশি নাই। নিজেদের গাঁয়ের বাড়িতে সে থাকে না। ব্যাবসার লেগে শহরে একটো বেরাট রাজবাড়ির মতুন বাড়ি বানিয়েছিল। সিদিন সে বসে ছিল বাইরের ঘরে। একাই ছিল। এই সোমায় পাঁচ-সাতজনার একটি দল সিং-দরজা পেরিয়ে বাড়িতে ঢুকল। তাদের হাতে টাঙি, খাঁড়া, রামদা–এই সব। অ্যাই, অ্যাই, কে, কে, কি চাই, বাড়ির চাকরবাকররা এইসব বলতে বলতেই তারা বাইরের ঘরের পাকা বারেন্দা পেরিয়ে ঘরে ঢুকে পড়ল। শোনলম, ইসুফ মিয়ে চোখ তুলে তাকিয়েই দলটোকে দেখতে পেয়েছিল। সাবধান হবার কুনো সোমায় পায় নাই। সে উঠে দাঁড়িয়ে তোমরা কারা, কি চাই–শুদু এই কথাটি বলতে পেরেছিল, তখুনি তার ঘাড়ে পড়ল পেথম খাঁড়ার কোপ।