সত্য তো সামনা-সামনি দাঙ্গাতে মরে নাই।
না দিদি, হিঁদুপাড়ায় একজন মোসলমানকে বাগে পেলে মারছে আবার মোসলমানপাড়ায় একজন হিঁদুকে বাগে পেলে মারছে, চিনুক আর নাই চিনুক। হিঁদু না মোসলমান বুঝতে পারলেই হলো। সেদিন রাস্তা ছিল ফাঁকা, কিরীটী—
কিরীটী তোমার ভাই?
হ্যাগো দিদি, ঐ একটিই ভাই আমার। তা কিরীটী বললে, হঠাৎ চারজন তোমাদের জেতের লোক পোশাক দেখেই বোঝা যাচ্ছিল তাদের ঘিরে ধরল। চারজনের হাতেই ছুরি ছিল। এসেই কোনো কথা নয়, সত্য-র তো খালি গা, পৈতে দেখেই বোঝা যাচ্ছিল বামুন–সত্য-র পেটে বুকে চারজনেই ছুরি ঢুকিয়ে দিল। কিরীটী-ও বাঁচত না–সত্য-র দিকেই ওদের সবার নজর ছিল বলে সে লাফ দিয়ে ছুটে বেরিয়ে এসে একটা বড় নিমগাছের আড়ালে লুকিয়েছিল। সেখান থেকেই সে সব দেখলে। সত্য দুবার মা মা বলে ডেকেছিল, আর কোনো কথা বলতে পারে নাই। পেটে বুকে পিঠে ছুরি মারতে মারতে ছেলেটিকে আমার আঁঝরা করে দিয়ে আর একটুও দাঁড়ায় নাই। তারা। কিরীটী বললে, আমাকে তুমি জুতো মারো দিদি, আমি কাছে গিয়ে সত্যকে আর একবার দেখে আসতে পারি নাই গো, পেরান নিয়ে সেই যে দৌড়েছি, মেসে এসে ঘরে ঢুকে দরজায় খিল দিয়ে তবে থেমেছি।
আমি রায়গিন্নির মুখের দিকে চেয়ে থাকলম। তার চোখে অ্যাকন আর পানি নাই, চোখদুটি যেন ধকধক করে জ্বলছে। আমার মনে হতে লাগল, আমার বোধায় আসা ঠিক হয় নাই, আমার বোধায় অ্যাকন চলে যাওয়াই ঠিক। রায়গিন্নি কাকে ঘিন্ করবে বুঝতে পারছে না, বোধায় আমাকেই তার ঘিন্ লাগছে। কি দোষ দেব রায়গিন্নির? ঐ। মা তার ছেলের লাশটো-ও দেখতে পায় নাই। রাস্তায় সেইখানেই লাশ পড়েছিল না, মুদ্দোফরাস টানতে টানতে নিয়ে যেয়ে মড়া-ফেলার গাড়িতে তুলেছিল কিছুই জানে না সে। কিন্তুক কারা তাকে মেরেছে তা জানতে পেরেছে সে। আমি য্যাতোই আসি একজন মা-কে সান্ত্বনা দিতে, সে আমাকে ভালো চোখে দেখতে পারবে ক্যানে? আমি আর বসে থাকতে পারলম না, বাড়ি যাবার লেগে উসারা থেকে এনেয় এসে নামলম। সাথে সাথে রায়গিন্নির মেয়েদুটি–একটির নাম লক্ষ্মী, আর একটির নাম সরস্বতী রায়গিন্নির হারামজাদি দুটি উঠে দাঁড়াইলে। ত্যাকন রায়গিন্নি সব ভুলে চেঁচিয়ে উঠল, দিদি তুমি যাচ্ছ? আমি আর কি বলব দিদি! আর যেন কারু কোল এমনি করে খালি না হয়। ভগবানকে বোলো আমি যেন কাউকে শাপ-শাপান্ত না করি, ও মা, মাগো–
ঘোট গিন্নি আবার মাটিতে পড়ে কাতরাইতে লাগল। আমি গা-মাথা ঢেকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে অ্যালম।
এই শুরু হলো। কতো কথা যি চারদিক থেকে আসতে লাগল–কতো কাইনি, কতো ঘটনা। সারা গাঁ, সারা এলেকা সরগরম। আকালেও এইরকম হয়েছিল বটে, তবে সি যেন উল্টো। জাড়কালের রেতে মাঠ যেমন ঠান্ডা, শক্ত কঠিন আর শব্দ নাই–যেন কতোদিনের বাসি মড়া পড়ে আছে মড়া যেন গলতে পচতে গন্ধ বার করতেও ভয় পেছে, আকাল ছিল তেমনি। সারা সারা এলেকা একদম মরে গেয়েছিল। কিন্তুক অ্যাকন যেন গাঁয়ের পর গাঁ উঠে বসেছে, মোসলমানরা মাথায় ফ্যাটা বেঁধেছে, হিঁদুরা কপালে সিঁদুর লেপেছে, রাগে সবারই চোখ টকটকে লাল। বাঁশের ঝাড়ে ঢুকে বাঁশ। কেটে লাঠি বানাইছে, কামারশালে যেয়ে টাঙি সড়কি এই সব বানিয়ে নিছে।
আমার ল-দ্যাওরের খুব ফুত্তি। কার কাছ থেকে কি শুনে লাফাইতে লাফাইতে বাড়ি ঢুকে বলছে, আর হবে না, হিঁদুদের সাথে আর কিছুতেই থাকা হবে না, পাকিস্তান হাশিল করতেই হবে। তার কথা শুনে মনে হছে, তাই বোধায় হয় ঠিক, পাকিস্তান হাশিল না করলে আর উপয় নেই। ই গাঁয়ের হিঁদুরা তো বটেই, আশেপাশের গাঁয়ের সব হিঁদুরা লিকিন তৈরি হচে, একটি মোসলমানও তারা আর রাখবে না। তা ঠিক, এত হিঁদু ই দিগরে আছে একবার যেদি ঢেউয়ের মতুন আসে, একজন মোসলমানও জানে বাঁচতে পারবে না। তোড়ে ভেসে যাবে। তা এই আবস্তায় সে এত লাফইছে ক্যানে? দ্যাওরকে জিগ্গাসা করতেই সে এমন নোম্বা নোম্বা বাত দিলে যি বুঝতে পারলম সে ঘোরে আছে, তার মাথা কাজ করছে না।
তৌহিদের খ্যামতা জানো? তৌহিদি শক্তির সামনে হিঁদু মালাউন দাঁড়াইতে পারবে না। এক মোসলমান, সত্তরজনা কাফের!
আবার কিসব বলতে বলতে সে ছুটে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। হিঁদুদের তো অত দেখতে পাই না, তারা অত চেঁচায়ও না। কতো কথা যি কানে আসে! কুকুর-বেড়াল কান বন্ধ করতেও পারে, খুলতেও পারে। তাদের কান নড়েচড়ে। মানুষের কান বন্ধ করার উপয় নেই, তার কান খোলাই থাকে। তাই শুনতে না চাইলেও শুনতে পাই, গাঁয়ের হিঁদুদের লিকিন গতি-মতি ভালো লয়, তারা ভিন্ ভিন্ গাঁয়ের, হিঁদুদের সাথে ষড় করছে।
তাইলে কি সব মিছে হয়ে গেল। নতুন বউ হয়ে আসার পরে কত্তামা যি আমার লেগে এক-গা গয়না গড়িয়ে রেখেছিল, সামনে বসিয়ে একটি একটি করে গয়না দিয়ে আমাকে সাজিয়েছিল, সি কি মিছে? কত্তা লিকিন তার বড় ছেলে, তার ছোট ছোট ছেলেদের যি ভাইয়ের অধিক যত্ন দিয়ে মানুষ করলে, সি-ও কি মিছে? ভচ্চায্যি বড় খোঁকা মরলে কত্তার গলা জড়িয়ে ধরে তাকে বুকে টেনে ঠায় কতোক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে, সি-ও কি হিঁদু-মোসলমানের লোক-দেখানো আদিখ্যেতা? আর ইদিকে যি আপন ভাইরা এক কথায় পেথগন্ন হয়ে গেল, সি বুঝি কিছু লয়? দাইবউ নাপিতবউ কতোদিন আর ইদিগপানে আসে না সি কি শুদু হিঁদু-মোসলমানে দাঙ্গা হচে বলে? আমার বড় খোঁকাটির লেগে এই কমাস আগেও যি সি আমার কাছে কেঁদে গেল, তা-ও কি তোক দেখানো ছিল? সে ছোট জেতের হিঁদু, বড় জেতের হিঁদুদের কাছে লোক-দেখানোর কাঁদন কাঁদার লেগে তার কি দায় ঠেকেছে? হা, থাকে বটে হিঁদুদের মদ্যে দু-চার জনা হিঁদু যারা মোসলমানদের জান থেকে ঘিন্ করে, পারলে দুনিয়ার সব মোসলমানকে কেটে ফেলে। তেমনি মোসলমানদের ভেতরেও তো আছে তেমন মোসলমান যারা হিঁদুদের ঘিন্ করে, তাদের কাফের মালাউন বলে গাল দেয়, পারলে সব হিঁদুকে মাটিলাগ করে দেয়। এমন দু-চারজনা হিঁদু মাথাসরো যোবক ই গাঁয়ে আছে, সি কথা কত্তাও জানে, আমিও জানি। তেমনি মোসলমান পাড়ায় আছে কটো মাথাড্যাকরা ছোঁড়া, রাতদিন হিঁদু মারবে বলে লাফাইছে। এমন তো সব জায়গায় সব সোমায়েই আছে। তাই বলে দাঙ্গা করতে হবে ক্যানে? রায়গিন্নির হাতের নড়ি ছেলেটিকে রাগ নাই ঝাল নাই শুদু পৈতে দেখে বামুন বলে চেনা গেল বলে মেরে ফেলতে হবে। ক্যানে?