কি করব বুঝতে পারছি না। চলে আসব না কি ভাবছি, এমন সোমায় রায়গিন্নি চোখ মেলে আমাকে দেখলে। চোখের পাতা তার তখুনি আবার বন্ধ হয়ে যেছিল, চেয়ে তাকানোর খ্যামতা নাই। কিন্তুক তবু কি কষ্ট করে যি সি চোখের পাতাদুটি খুলে রাখলে, তা আমি বুঝতে পারলম।
কে?
গলার আওয়াজ শুনে গা শিউরে উঠল। ই কি মানুষেরা গলা? আমি নিজের পরিচয় দেলম। মাথায় পানি ঢালতে যেয়ে ছোট গিন্নির লালপাড় ঘেঁড়া শাদা শাড়িটিও ভিজে গেয়েছে। মুশুরির বিউলির মতুন গায়ের রঙ তার অ্যাকনো আছে, ভেজা শাড়ির ভেতর দিয়ে সেই রঙ যেন ফুটে বেরুইছে। আমি পরিচয় দিলে অতি কষ্টে উঠে বসতে বসতে ছোট গিন্নি উসারার দিকে দেখিয়ে আমাকে বসতে বললে, বোসো দিদি।’
একটু অবাকই হয়ে আমি আস্তে আস্তে ছোট গিন্নির কাছ থেকে একটু দূরে উসারার ওপর মাটিতেই বসতে গ্যালম, গিন্নি ইশারায় আর। এট্টু কাছে যেতে বললে।
আমার এমন সাধ্যি নাই যে আসনটা এনে তোমাকে বসতে দি–হারামজাদি দুটি এখন কোন্ চুলোয় গেছে!
তাড়াতাড়ি করে মাটিতে বসে পড়ে আমি বললম, না না, আমি এই মাটিতেই বসি, তুমি বেস্ত হোয়ো না। আমাকে তুমি চিনতে পারো নাই, আমি–
না, না, চিনতে পেরেছি। দু-তিনবারের বেশি তোমাকে দেখি নাই বটে, তবে একবার তোমাকে দেখলে কেউ ভুলতে পারে? পিতিমে দেখা আর তোমাকে দেখা যে এক কথা। আমার কি সৌভাগ্য যে তুমি এ বাড়িতে এসেছ–
আমি যি মা খপ করে মুখ দিয়ে কথাটো বেরিয়ে গেল আর কি যি হলো জানি না, চোখদুটি আমার পানিতে ভেসে গেল। সেই ঝাপসা চোখেই আবছা দেখতে প্যালম রায়গিন্নি একদিষ্টে আমার দিকে ঠিক যেন শাদা পাথরের চোখে চেয়ে রয়েছে। আমার চাউনি পোঞ্চার ইলে দেখলম রায়গিন্নির চোখের পাতা পড়ছে না, থির তাকিয়ে আছে। আমার দিকে। তাপর, অ্যানেকক্ষণ পর, আস্তে আস্তে তার ডাগর চোখদুটি পানিতে ভরে এল, টইটম্বুর হয়ে এল আর গলা দিয়ে শুকনো বাস বার করতে করতে সে বললে, দিদি বড় কষ্ট, বড় কষ্ট দিদি! সি এমন করে বলা, সি এমন করে বলা! আর বলতে বলতেই রায়গিন্নি মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে বুক ফাটিয়ে কেঁদে উঠল, কোথা রে, কোথা রে, কোথা গেলিরে, কোথা মরে পড়ে থাকলি রে বাবা!
আমার এমন ইচ্ছে হলো যেন সব ভুলে এই মানুষটিকে বুকে জড়িয়ে ধরি। মনে হলো সে-ও যেন হাত বাড়িয়ে আছে। এত ইচ্ছে, তবু যেতে কি পারলম? তখনি মনে হলো, যেতে যি পারছি না, তার কারণ তো আমি মোসলমান আর রায়গিন্নি হিঁদু! আর য্যাত লড়ালড়ি, খুনোখুনি হচে সব তো শুদু হিঁদু-মোসলমান বলে। এক হিঁদু মায়ের পুতকে মারছে একজনা মোসলমান আবার এক মোসলমান মায়ের পুতকে মারছে। একজন হিঁদু। আঃ হায়রে! মানুষ লিকিন বুদ্ধিমান পেরানি।
আমি যেখানকার সিখানেই বসে থাকলম, একফোঁটা নড়তে পারলম না আর রায়গিন্নি মেঝেতে মুখ গুঁজে অমনি করে গুঙিয়ে গুঙিয়ে এমন কাঁদন কাঁদতে লাগল যেন ধরণী ফেটে চৌচির হয়ে যাবে। মনে মনে ভাবছি আমি এখানে কিছুই করতে পারব না, মায়ের। এমন শোকে আল্লাই সান্ত্বনা দিতে পারবে না, আমি তো কুন ছাড়, তাইলে আমি অ্যালম ক্যানে?
এইসময় সিং-দরজার হাঁ-মুখ দিয়ে রায়গিন্নির হারামজাদি দুটি বাড়ি ঢুকল। সি যি কি সোন্দর মেয়েদুটি! পাতলা পাতলা ঠোঁট, টানা টানা চোখ, যেন পটে আঁকা। প্যাট ভরে খেতে পায় না, রুখু চুল উড়ে বেড়াইছে। কতোদিন ত্যাল পড়ে নাই তাতে, তবু কি রূপ, কি রূপ। হাতে পায়ে চুলে ধুলোর পরত পড়েছে, তারই ফাঁকে ফাঁকে ধপধপে গায়ের রঙ যেন ফেটে বেরুইছে। তারা মাথা নামিয়ে মায়ের দু-পাশে হেঁটো মুড়ে বসল। সি মুখদুটিতে যি কি আছে আমি বলতে পারব না। একবার একবার বুনদুটি আমার দিকে তাকাইছে, আবার মুখ নামিয়ে নিছে। আস্তে আস্তে তারা মায়ের ছড়ানো চুলগুলি গুছিয়ে তার উবুড় পিঠে রাখলে, তাপর দুপাশ থেকে রায়গিন্নির মুখটি ধরে খুব নামো গলায় বললে, ওঠো, ওপাড়ার জেঠি বসে আছে, উঠে কথা বলো। এই বলে তারা মাকে উঠে বসাইলে।
চেয়ে দেখলম ছোট রায় ভিক্ষের ঝুলিটি কাঁধে নিয়ে বাড়ি ঢুকছে। ভিক্ষে অ্যানেক পেয়েছে, ঝুলিটি বেঁধে বস্তার মতুন করে কাঁধে বয়ে নিয়ে আসছে। খালি-গা, সারা প্যাটে দাদ, চুলকিয়ে চুলকিয়ে যেন। খড়ি উঠেছে। ময়লা পৈতেটি দেখে মনে হচে বামুন বটে! এনে পেরিয়ে উসারায় উঠে একবার আমার দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে মাটি দেখতে দেখতে সে ঘরে যেয়ে ঢুকল।
কি করব, এইবার আমি আবার উঠব উঠব করছি, রায়গিন্নি ধরা গলায় বললে, কি করে কি হলো দিদি, কিছুই বলতে পারব না। ছেলে মরল মরল, তার দেহটি-ও পেলাম না। শেষ কাজও করতে পারলাম না। আমাদের হিঁদুদের মধ্যে গঙ্গা না পেলে কারু মুক্তি নাই। যতো পুণ্যিই থাকুক, পাপ তো কিছু সব মানুষেরই থাকে। সেই পাপ কিছুতেই ক্ষয় হবে না মা গঙ্গা কোলে না নিলে। তার দাহ হলো না, ছেরাদ্দ-ও এখনো হয় নাই। তোমাদের মতোই তো দিদি, গোর না দিলে তোমাদের কারু কি গতি হয়?
খবরটো কেমন করে পেয়েছিলে ছোট গিন্নি?
সিদগাঁ আমার বাপের বাড়ি। আমার ছোট ভাই কলকাতায় কাজ করে। সেই তো সত্যকে কলকাতায় নিয়ে গিয়ে এক বড়লোকের বাড়িতে রান্নাবাড়ার ঠাকুরের কাজে লাগিয়ে দিয়েছিল। দুজনাই একসাথে এক মেসে থাকে। আলাদা আলাদা জায়গায় কাজ করলেও দুজনে মেসে ফেরে একসাথে। সেদিনও তেমনি ফিরছিল তারা। রাস্তা ফঁকা। দাঙ্গা নাকি কদিন আগে শুরু হয়েছিল, এরা ওদের মারছিল, ওরা এদের মারছিল। এক দিকে হিঁদু-পাড়া আগুনে পুড়ছে, আর একদিকে তোমাদের মোসলমান-পাড়া পুড়ছে। ভাই বলছিল, সামনা-সামনি দাঙ্গাতে-ও মানুষ মরছিল।