এতক্ষণ ধরে কত্তা যেসব কথা বলছিল, মনে হছিল তা অন্য কুনো ভাবের কথা তার একটি বন্ন বুঝতে পারছেলম না। খুব চেষ্টা করলম। বুঝতে কিন্তুক কি বুঝব, দুনিয়ার কি কিছু জানি? কোথা কোথা মোসলমান থাকে, এই দ্যাশেই বা কোথা কোথা তারা থাকে, কি খায়, কি মাখে, কি পরে, কেমন করে কথা বলে, কি ভাষায় কথা বলে, কি তাদের স্বভাব-চরিত্তির ইসব কিছুই জানি না। বোঝলম ই নিয়ে কথা বলা আমার ঠিক হবে না, তবে এই কথাটো খুব মনে হছিল যি ইসব কথার সাথে হিঁদু-মোসলমান সোংসারি মানুষের কুনো সম্পক্ক নাই। আর নাই য্যাকন, ত্যাকন আমি মাথা ঘামাইতে যাই ক্যানে! তবে খালি মনে হতে লাগল মোসলমানের দ্যাশ হবে অথচ সব মোসলমান সিখানে থাকবে না, এমনও হতে পারে যি আমি থাকব কিন্তুক আমার সোয়ামি ছেলেমেয়ে থাকবে না। তাই যেদি হয় তাইলে ই কাজ করতে যেয়ে হিঁদু-মোসলমান সম্পক্ককে বিষ বিষ করতে হবে ক্যানে?
কত্তার সাথে এই নিয়ে আর কুনোদিন কথা বলতে চাই নাই। কিন্তুক মনে হয় তারও বুকের ভেতরে ঝড় বইছিল। অ্যাকন তো আর বুঝতে কিছু বাকি নাই। মাঘ-ফাগুনে কত্তা একদিন বললে, একটো নিৰ্বাচন হবে। কঠিন নিব্বাচন, এমন নিব্বাচন লিকিনি আর কুনোদিন হয় নাই। এই নিব্বাচনে ঠিক হবে মুসলমানরা তাদের আলেদা দ্যাশ পাকিস্তান চায় কি চায় না।
কত্তার সেই কথার পরে, উঃ, এই অজ পাড়াগাঁয়েও যি কি জগঝম্প বাজতে লাগল! বাড়িতে থাকি, তাও কান ঝালাপালা হয়ে যায়। কদিন এগু যুদ্ধ শ্যাষ হয়েছে, অ্যাকন শুরু হলো আর এক মহাযুদ্ধ। লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান, লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান রব করছে মোসলমানরা। পাকিস্তান চাইদের দলে দাঁড়াইলে আবুল হাশিম, আর বোধায় পাকিস্তান চাই-না-র দলে দাঁড়াইলে সে-ও একজনা মোসলমান। তার নামটো মনে ছিল, অ্যাকন ভুলে যেচি–মনে হচে তার নাম ছিল ছাত্তার।
আমরা আর ভোট দিতে যাই নাই। কত্তাকে শুদুইলে সে কিছুতেই রা কাড়লে না। ভাবে মনে হলো আবুল হাশিম পাকিস্তান-অয়লাকেই ভোট দিয়েছে।
এর পরে আর ছটো মাসও কাটল না। হিঁদু-মোসলমানে লেগে গেল হিড়িক। কে যি লাগাইলে, ক্যানে যি লাগাইলে সিকথা বলতে পারব না। কোথা কুন্ পাড়াগাঁয়ে পড়ে আছি দুনিয়ার কুন্ এক কোণে, চাদ-সুরুজ যিখানে চুপে-চুপে ওঠে, চুপে চুপে ডোবে, চুপে-চুপে ধান হয়, গম হয়, ফল-পাকুড় হয়, চুপেচুপেই আমাদের সন্তান হয়, বাড়ে, মরে। আমরা কার কি করেছি যি সেই গাঁয়ের এক মায়ের অন্ধের নড়ি পুতকে কেটে দুখাণ্ডা করে দেবে?
আমার খুব মনে হতে লাগল একবার রায়দের ছোট গিন্নির কাছে যাই। আমার বড় খোঁকা দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছিল রোগে ভুগে। ছোট গিন্নির নাড়িছেড়া ধনটির দুনিয়া থেকে যাবার সোমায় হয় নাই, কে তাকে মারলে, কুন অপরাধে মারলে, সে-ও জানলে না, তার মা-বাপও জানলে না। টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকল ছেলে। পচে গলে লষ্ট হয়ে গেয়েছে সেই লাশ, না কুকুর-শেয়ালে খেয়েছে, নাকি কাক-শকুনে খেয়েছে, তা-ও জানতে পারলে না মা-বাপ। আহা, একবার যাই সত্য-র মায়ের কাছে। তার গায়ে-পিঠে হাত দিতে পারব না জানি, হিঁদুরা আমাদের ছোঁয় না। ছোট গিন্নি তো আবার বামুনের মেয়ে, যিখানে যেয়ে বসব দাঁড়াব সিখানে আবার পানি ঢেলে ধোবে। তা হোক, একবার যাই। কত্তাকে শুদুব কিনা ভাবলম। এই বাড়িতে বউ হয়ে আসার পরে কুনোদিন গাঁয়ের রাস্তায় বেরুই নাই পায়ে হেঁটে। যেখানেই যাই, গেয়েছি গরু-মোষের গাড়িতে, টপ্পরের দু-মুখে শাড়ি বেঁধে। তবে গাঁয়ের মোসলমান পাড়ায়। বড় ননদের বাড়িতে দু-একবার যাই মাঝে মাঝে, হেঁটেই যাই। পাড়ার ভেতর দিয়ে ই বাড়ি উ বাড়ির পাশ কাটিয়ে, এর এনে ওর এগ্নের ওপর দিয়ে চলে যাই। দিনে রাস্তায় কুনোদিন বেরুই নাই। করে বউ হয়ে ঢুকেছি এই বাড়িতে, মাথার চুল পাতলা হয়ে গেছে, পাকছে-ও দু-একটি, ইয়া চ্যাওড়া সিঁথি অ্যাকন–তবু বউমানুষের শরম গেল না আমার। মনে করলম, কত্তাকে আর শুদুব না। ক্যানে বেরিয়েছেলম শুনলে রাগ করবে না আমি জানি।
বৈকাল বেলায় গা-মাথা ঢেকে কুনোরকমে টুক করে রাস্তাটো পেরিয়ে পুকুরের পাড়ের কলাবাগানের আড়াল আড়াল গ্যালম রায়বাড়ি। পুকুরের দখিন কোণেই বাড়ি। বাইরে এসে গায়ে বাতাস লাগলে মনে হলো কুন জগতের বাতাস, চাপাপড়া ঘাস যেন নতুন জান পেলে। রায়বাড়ির সিং-দরজা নাই, কবে বিক্রি হয়ে গেয়েছে, সেখানে দুদিকের মাটির পাঁচির হাঁ হয়ে আছে। সেটো পেরিয়ে এনেয় যেয়ে দাঁড়াইতেই দেখলম সীমেনার পাঁচির কবে ভেঙে পড়ে গেয়েছে। চারিদিক খাঁ খাঁ, এককোণে একটি মাত্র ঘর, আর এগনের এক কোণে রান্নাঘর। ঘরের ছামনে যি একটুকু উসারা আছে, সেইখানে একটি ছেড়া ছপ পেতে শুয়ে আছে রায়গিন্নি। দুদিকে গিট-মারা ময়লা একটো বালিশ মাথার তলা থেকে বেরিয়ে এয়েছে আর উঁচু উসারার বাড়ি থেকে রায়গিন্নির এলোচুল এনে পয্যন্ত ঝুলে আছে। খানিক আগে হয়তো পানি ঢেলেছে মাথায়, ভালো করে মোছা হয় নাই, চুল গড়িয়ে টপ টপ করে ত্যাকনো পানি পড়ছে, দু-চারটি পাকা চুল দেখা যেচে। ছোট গিন্নির চোখ বোজা, জেগে না ঘুমিয়ে ঠিক বুঝতে পারলম না। বাড়িতে কাক-পক্ষী নাই, একদম ফাঁকা। মেয়েদুটি নাই, ছেলেটি-ও নাই আর ছোটরায় লিশ্চয় ভিক্ষেয় বেরিয়েছে। এত বড় পুত্রশোকেও তার উপয় নাই, পোড়া প্যাট তো মানবে না, ভিক্ষার চালেই সেই প্যাটের গত্ত ভরাইতে হবে।