কবে বলেছিল কত্তা এই কথা। তাপর কাগজেও পড়েছেলম, কত্তা-ও বললে ঐ সভা ভেঙে গেয়েছে। উদের ক্ষমতা শ্যাষ। অ্যাকন খাঁটি মোসলমানদের শাসন চলবে। সে-ও ক-বছর হয়ে গেল। তার পর থেকেই শুনছি মোসলমানদের আলেদা একটো দ্যাশের লেগে খুব আন্দোলন চলছে, সি লিকিনি না করে ছাড়বে না। আর পড়তে লাগলম, শুনতেও লাগলম কটি নাম–জিন্না, নেহেরু, গান্ধি, প্যাটেল। এমন নাম তো জেবনে শুনি নাই, কিছুতেই মনে থাকত না যেদি হাটে মাঠে ঘরে বাইরে সব সোমায় এই নামগুলিন না শুনতে পাওয়া যেত। আরও পড়লম নাজিমুদ্দীন, লেয়াকত আলী, সোরাবর্দী, আবুল হাশিমের নাম। আবুল হাশিমের নাম খুব দেখতে প্যাতম। ঐ নামটি ভুলি নাই। একে তো মোসলমানদের নেতা, তাপর তার দ্যাশের বাড়ি আমার বাপের বাড়ির খুব কাছে, দু-তিনকোশের মদ্যেই।
সি যাকগো, কথা তা লয়। দাঙ্গার কথাটো বলতে যেয়েই এত কথা। মোসলমানদের আলেদা দ্যাশ পাকিস্তানের কথা হতে হতে এমনি শোরগোল হতে লাগল সি আর কান পাতা যায় না। শ্যাষের দিকে খালি বলে, লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান। লড়কে তো লেঙ্গে, কিন্তুক নিয়ে করেঙ্গেটা কি? কোথা পাকিস্তান হবে জানিস? তু যাবি সেখানে?
কত্তাও দেখি মাঝে মাঝে খুব রাগ করছে। মোসলমানদের আলেদা দ্যাশের কথা তো সেই আকালের সোমায় থেকেই শুনে আসছি। ত্যাকন এক কান দিয়ে ঢুকত আর এক কান দিয়ে বেরুইত। বলে, মানুষের প্যাটে-পিঠে সেঁটে গেয়েছে, পরনে ত্যানা নাই, লতাপাতা, শামুক, গুগুলি খেয়েও লোকে বাঁচতে পারছে না, শেয়াল-কুকুরের জেবন হয়েছে মানুষের আর তারই মধ্যে আবার মোসলমানদের আলেদা অ্যাকটো দ্যাশের কথা! কে তাতে কান দেবে? কিন্তুক কান দেবার লোক আছে বইকি! যাদের নিজেদের ভাবনা-চিন্তা নাই, খাওয়া-পরার চিন্তা নাই, তারা তো গরিব মানুষের লেগে ঘরে বসে মাহা মাহা চিন্তা করতেই পারে।
যাই হোক সিসব কথায় ত্যাকন লোক কান দেয় নাই। কিন্তুক কথাটো গেল না, জিটিবিটি করে ধরে থাকল। আকাল গেল, যুদ্ধ গেল, পাকিস্তানের কথা আবার ফিরে এল। আগে আগে কত্তা বলত, পাকিস্তানের বাতিকটা বোধ হয় গেল। লোক দেখানো হোক, যাই হোক, ব্রিটিশ চেষ্টা করছে হিঁদুদের গান্ধি, নেহেরু, প্যাটেল আর মুসলমানদের নেতা জিন্নার সাথে বসে একটা পথ বার করতে, যাতে দেশটাকে আর ভাগ করতে না হয়। আবার কদিন বাদে হয়তো এসে বললে, নাঃ হলো না, একটা দক্ষযজ্ঞ মনে হচ্ছে হবেই, এবার জিন্না রাজি না। কদিন পরে ফের বললে, এবার নেহেরু রাজি হলো না। এই করতে করতে একদিন মাহা বিরক্ত হয়ে এসে বললে, এই জিন্না লোকটা একটা দিন জেল খাটলে না, একটা দিন উপোস করলে না গান্ধির মতো, মুসলমানের কিছুই নাই তার, জামাকাপড় আগে পরত সাহেবদের মতে, এখন মুসলমানদের নেতা হয়েছে, শেরওয়ানি পরে, মাথায় পরে তার নিজের কায়দার টুপি।
অত রাগ করছ ক্যানে? আমি এট্টু অবাক হয়ে শুদুই।
রাগ হবে না? সারা দেশের মানুষ কি চায়, না চায়, তার খবর তে হবে না? কাগজ-কলম নিয়ে শুধু ঘরে বসে আঁক কষলেই হবে।
আমাকে এট্টু বুঝিয়ে বলো দিকিনি। আঁক ক্যা আবার কি?
কোথা ভারতের স্বাধীনতা তার কোনো খবর নাই। আঙুলটা পর্যন্ত কোনোদিন ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে তোলে নাই আর যখুনি এই দেশের স্বাধীনতা দিয়ে দেশ ছেড়ে চলে যাবার অবস্থা ব্রিটিশের, দিশেহারা অবস্থা, তখুনি সে বলছে মুসলমানদের আলাদা দেশ দিতে হবে। আবার প্যাটেল-ম্যাটেল কটা হিঁদু নেতা আছে যারা হিঁদু-মুসলমান। দুই দুই না করে কোনো কথা ভাবতেও পারে না।
কত্তা কথাগুলো এমন করে বলছিল যেন নিজের সাথে নিজে কথা বলছে। সেই লেগে আমি একটু চেঁচিয়ে বললম, আহা, ঘরে বসে কাগজ-কলমের কথা কি বলছিলে সেই কথাটি পোঞ্চার করে বলো।
ও, কাগজ কলম–কত্তা হাসলে, যাদের জন্যে এইসব কথা, তাদের কাছে না এসে ঘরে বসে চিঠি চালাচালি করা, খবরের কাগজে একগাদা কথা ছাপানো, এইসব করেই বাজিমাত করার কথা বলছিলাম রাগ করে। স্বাধীনতার জন্যে একটা আন্দোলন হচ্ছে, আবার সেই আন্দোলনের পেটের ভেতর মুসলমানদের জন্যে একটা আলাদা দেশের আন্দোলনও হচ্ছে। ডালে-চালে মিশে যাচ্ছে না?
আমি আজ শুনব। মোসলমানদের আলেদা দ্যাশ ঠিক কি কথা?
আচ্ছা, ঠিক আছে শোনো। আমি নিজেও যে খুব বুঝি তা নয়। কোনো কিছুর সঙ্গে এখন আর আমি নাই। খবরের কাগজ-টাগজ পড়ে যা বুঝি তাই বলছি।
আগে বলল, মোসলমানদের দ্যাশ যি বলছ, সেই দ্যাশ হলে সব মোসলমান সিখানে বাস করবে? কেউ তার বাইরে থাকবে না?
আর দূর, তাই কখনো হয় নাকি? সারা দুনিয়ায় মুসলমানদের কত দেশ আছে জানো? কতো পোশাক, কতো ভাষা, কতো জাত–তার কোনো অন্ত আছে নাকি! একটিমাত্র দেশে তাদের সবারই থাকার কোনো জায়গা নাই। আমাদের এই ভারতেই কতো দেশ! কতো কিসিমের মুসলমান এই বিরাট দেশে আছে কেউ জানে? ওভাবে এক দেশে সব মুসলমানকে রাখার কথা হয় নাই। এই বাঙালি হিঁদু-মোসলমানের মধ্যেই কতো মুসলমান আছে, সবাইকে একটা আলাদা দেশে রাখতে পারবে কেউ?
তবে? আলেদা দ্যাশের কথা ক্যানে? আমাদের এই দ্যাশের মোসলমানকেই যেদি একটা দ্যাশের মদ্যে রাখতে না পারে তাইলে উকথা হচে ক্যানে?
আমার এই কথায় কত্তা যেন একটু থমকে গেল। কিন্তুক উ কি থামবার মানুষ? বললে, প্রথমে কথা হয়েছিল, সারা দেশে যেখানে যেখানে মুসলমান অন্য জাতের চেয়ে বেশি বাস করে, সেই সব জায়গা নিয়ে বেশ কটা আলাদা দেশ হবে। তারপর সেকথা উড়ে গেল, ব্রিটিশরা বললে দেশ ভাগ কোরো না, বরঞ্চ তিনটে খণ্ড করে এক দেশের মধ্যেই সবাই থাকো। সে কথাটিও আবার নেহেরু প্যাটেল হিঁদু নেতাদের পছন্দ হলো না। এখন জিন্না খেপেছে, কোনো কথা নয়, পাকিস্তান বলে একটি আলাদা মুসলমানদের দেশ চাই।