খামারে একটার পর একটা মরাই বাঁধা হতে লাগল। একদিন দু-দিন পরে পরে মুখে গামছা জড়িয়ে মুনিষরা সব মরাইয়ে ধান তোলে। কেমন রাবণের মতুন মুখ ফুলিয়ে গোমড়ামুখে কাজের দেখাশোনা করে ল-দ্যাওর। এক-একটো মরাই যিদিন শ্যাষ হয়, সিদিন যার মরাই সে মুনিষদের চিতুই পিঠে না হয় ধুকি খাওয়ায়। আগের মতুন আট-নটো মরাই দেখে খুশিতে ডগোমগো হয় না কেউ। খামার ভরে মরাই তেমনিই আছে বটে, কিন্তুক কুনো ভাইয়ের একটি, কুনো ভাইয়ের দেড়টি মরাই, তা দেখে একা একা আর কতো খুশি হবে?
২৭. এত খুন, এত লউ, মানুষ মানুষের কাছে আসছে খুন করার লেগে
একদিন দোপরবেলায় চুলো থেকে উজ্জ্বলন্ত ভাতের হাঁড়িটি খালি নামিয়েছি, এমন সোমায় খবর প্যালম রায়েদের বড় ছেলে সত্য কলকেতায় হিঁদু-মোসলমানের হিড়িকে কাটা পড়েছে। পেথম ই কথার কুনো মানে বুঝতে পারলম না। কাটা পড়েছে আবার কি? বাসে চাপা পড়ে, টেরেনে কাটা পড়ে, কলকেতায় মানুষ কাটা পড়েছে মানে কি? মানুষ কি কদু-কুমড়ো যি বঁটির ছামনে ধরলম আর ঘাস করে কেটে ফেললম। সবাইকে আমি শুদুই, হ্যাগো হিঁদু-মোসলমানের দাঙ্গা আবার ক্যানে শুরু হলো। ই কথার জবাব আর কে দেবে? সবাই তো আমারই মতুন, কথা শুনে হাঁ হয়ে আছে। ঐ রায়েরা, এককালে য্যাতো বড়লোকই থাক, আজ তারা ভিখিরি। ছোটরায় দাদঅয়লা পেট বার করে, গলায় কালো-কিটকিটে পৈতে ঝুলিয়ে খালিগায়ে কাপড়ের একটো ঝোলা নিয়ে পেত্যেকদিন ভিক্ষে করতে বের হয়। তা তার মনে খুব দয়া যি সি ই গাঁয়ে ভিস্থ করে না। যেদি করত, তাইলে ই গাঁয়ের ভদ্দরলোকদের মুখে জুতো পড়ত। সে ভিস্থ করে ভিন গাঁয়ে। কঠিন গরমের দিনে, তেতে পুড়ে কিম্বা ঝড়-বাদলে কাক ভেজা হয়ে ভিক্ষার চাল কটা এনে বামুন-গিন্নির হাতে দেয় তবে চুলো ধরে, দুটো ভাত ছেলেমেয়েদের মুখে ওঠে। ধিঙ্গি ধিঙ্গি মেয়েদের বিয়ে হয় নাই, দুটি ছেলে ইস্কুলে যায় আবার যায়ও না। শুদু বড় ছেলেটিই কলকেতায় যেয়ে কার বাড়িতে রাঁদুনি হয়েছে, না মুদির দোকানে মাল ওজন করে–সে দু-চার টাকা সংসারে পাঠায় তবে এতগুলিন মানুষ বেঁচে আছে। সেই সত্য আবার কলকেতায় কি করলে, কার ক্ষেতি করলে যি খচাৎ করে তার মাথাটো কেটে ফেলতে হলো! তার না হয় কল্লা গেল, এইবারে যি তার বাড়ির এতগুলিন মানুষ না খেয়ে মরে যাবে! ছোটরায়ের সাধ্যি নাই যি এতগুলিন পেরানিকে সে পেরানে বাঁচায়। ছেলেটোকে আমি চেনতম, আমার অ্যাকনকার বড় খোঁকার বয়েসি, দু-একবার তাকে দেখেছি বড় খোঁকার সাথে। সে এমনি ভালো মানুষ যি একটো পিপড়ে মারারও ক্ষমতা নাই তার। আমাকে কেটে ফেললেও বিশ্বেস করতে পারব না যি সে কাউকে মারতে গেয়েছে। সত্যর মায়ের, রায়েদের ছোট গিন্নির মুখটো আমার মনে পড়তে লাগল। দু-একবার দেখেছি। ফরশা টুকটুকে বউমানুষটি ময়লা চেকট ছোঁড়া শাড়ি পরে থাকে। মাজা সোনার মতুন তার খোলা গা বেরিয়ে পড়ে। সেই মানুষের কপালে এমন পুত্রশোক লেখা ছিল! হায় হায়!
সবাই বলতে লাগল নেড়ে মোসলমানরা তাকে মেরেছে। তাই হবে, হিঁদু-মোসলমানে হিড়িক মানেই হচে হিঁদুকে মোসলমান মারবে, মোসলমানে হিঁদু মারবে। আর কিছু দেখাদেখি নাই, পাঁচজনা হিঁদু কলকেতার রাস্তায় একটো মোসলমানকে একা বাগে পেলে তো পিটিয়ে কিম্বা ছোরা ঢুকিয়ে মেরে ফেললে আবার পাঁচজনা মোসলমান একটো হিঁদু দেখতে পেলে কি চিনুক না চিনুক, কিছু করুক না করুক, তাকে তরোয়াল নাইলে টাংগি, নাইলে যা দিয়েই তোক মেরে ফেললে।
বাঃ ভালো! এইবার এই গাঁয়ের হিঁদুরা বলছে সত্যকে মেরেছে মোসলমানরা। তাইলে বিশ্বভাবনের মোসলমানরা বিশ্বভভাবনের হিঁদুদের শত্রুর। তাই যেদি হয়, তাইলে ই গাঁয়ের মতুন যেখানে য্যাতো হিঁদু-মোসলমানের গাঁ আছে, সব জায়গাতেই কি দাঙ্গা শুরু হবে? কি অস্থির যি লাগতে লাগল আমার! কত্তা কি এই নিয়ে আমাকে দুটো কথা বলবে না?
আমাদের এই বেরাট গাঁয়ে মাত্তর বিশ ঘর মোসলমান। ছানাপোনা নিয়ে একশোটো লোক হবে কিনা সন্দ। হিঁদু খুব কম করেও পাঁচশো ঘর। আশেপাশের গাঁগুলিনও মোটামুটি হিঁদু-গাঁ। এই কথা কুনোদিন মনে হয় নাই। ক্যানে মনে হবে? মানুষ আপনমনে বাস করছে। নিজের নিজের পেরান, ছেলেমেয়ে সোংসার নিয়ে হাবু-সোঁটা খেতে হচে সবাইকে। হিঁদু-মোসলমান আবার কি? কুনোদিন মনে করি নাই যি ই নিয়ে আবার ভানা করতে হবে। মনে তো অ্যাকনো করতে চাই না। কিন্তু খালি যি মনের ভেতর আগা লিছে, যেদি ই গাঁয়ে দাঙ্গা লাগে তাইলে এই কটি মোসলমান তো এক লাপটেই মারা পড়বে। সাথে সাথে মনে হলো, মনে পাপ ঢুকেছে তাই এই কথা মনে হচে। ভাবো দিকিনি কত্তা কাটতে যাবে কত্তামাকে! নাপিত বউয়ের স্বামী, নাইলে হলা বাগদির বাপ খুন করতে আসবে আমার ছেলেদুটিকে।
গত বছর থেকে খালি শুনছি, মোসলমানদের আলেদা একটো দ্যাশের লেগে আন্দোলন হচে, বিটিশদের সাথে খুব দেন-দরবার চলছে। কত্তা খালি তাড়া দিত আর নতিজা করত বলে গত কবছর ‘বঙ্গবাসী’ কাগজটো এট্টু এট্টু পড়তে চেষ্টা করতম। ত্যাকন থেকেই জেনে আসছি, মোসলমানদের লেগে একটো আলেদা দ্যাশ করার বন্দোবস্ত হচে। কত্তা আর আগের মতুন পেরায় পেত্যেকদিন শহরে যায় না, পেসিডেন্টগিরি যাবার পর থেকে বাড়িতেই থাকে বেশির ভাগ দিন। তাপরে এমন যি আকাল গেল, বুকে হেঁটো ঠেকিয়ে জড়িয়ে-মড়িয়ে কুনো পেরকারে সেই পুলসেরাত পার হতে হয়েছে, শহরগঞ্জে যেতে ভয়ই লাগত মানুষের। তা ত্যাকন কত্ত বাড়িতে বসে বসে আর কি করবে, কাগজ-মাগজ পড়ত আর মন-মর্জি ভালো থাকলে দ্যাশ দুনিয়া নিয়ে আমাকে কখনো কখনো দু-চার কথা বলত। যে করে থোক আকালটো মোটামুটি মানুষ সামলাইলে, দুবার ফসল যাওয়ার পরে, তিতিয় বছর খুব ধান হলো। গবরমেন্টের সাধ্যি হলো না, চোরা-কারবারিদেরও লিকিন খ্যামতা হলো না যি আকালটো আর কিছুদিন চালিয়ে যায়। ইদিকে যুদ্ধর ত্যাজও মরতে মরতে গত বছর বর্ষাাকালের গোড়ায় সারা পিথিমির যুদ্ধ বন্ধ হয়েছে। কিন্তুক সেলমানদের লেগে আলেদা একটো দ্যাশের কথা ক-বছর থেকেই শুনে আসছি। ই নিয়ে কতো কথা থাকে কাগজে, কত্তাও অ্যানেক কথা বলে এই নিয়ে। সব কি আর বুঝতে পারি? কাগজে অ্যানেক মজার মজার নাম পড়ি, আবার সিসব নাম ভুলেও যাই। কিন্তুক কতকগুলিন আর ভুলতে পারি না। এক সময় খালি পড়তম শ্যামা-হক এই নাম। বুঝতে পারতম না ই একটো লোকের নাম, না দুটি লোকের নাম। কত্তাকে শুদুইলে বললে, না, তোমাকে নিয়ে আর পারা গেল না। দুটি মানুষের নাম তাও বুঝতে পারলে না? শ্যামাপ্রসাদ মুখুজ্জে আর শেরে বাংলা ফজলুল হক। মন্ত্রীদের একটি সভা আছে, তাদের পরামর্শে আর ব্রিটিশদের চোখ-রাঙানি সয়ে এই দুজনেই এখন দেশ চালাচ্ছে।