কত্তা এই ততদিলে নিদেন হেঁকে। সে চুপ করলে দেখলম বাকি সবাই মাথা হাট করে চুপ করে থাকলে। গলা নামোয় নিয়ে যেয়ে ঐ যি কথা কটি সে বললে, কেউ আর তার কুনো উত্তর করতে পারলে না।
ত্যাকন কত্তাই আবার সহজ গলায় বললে, মন খারাপ করার কি দরকার? যা হবার তাই হচ্ছে। ঝগড়া-ফ্যাসাদ আমরা কেউ করছি না। আর এক দিক থেকে বলি, নিজের মতন করে, নিজের হাতে সংসার করতে ইচ্ছে সবারই করে, সব সময় ঘাড়ে একটি কর্তার ভূত থাকা কি ভালো? সংসার বেশি বড় হয়ে গেলে গোলমাল বিশৃঙ্খলা হয়। তাতে ছেলেমেয়েদেরও ওপর অবিচার হয়।
কত্তার এই কথার পরে বাতাস যেন অ্যানেকটো হাল্কা হয়ে এল। সবাই সহজ সুরে কথা বলতে লাগল। সোংসার ভালো করে চালাবার লেগে যেমন করে কথা বলে, সোংসার পেথ করার লেগে অ্যাকন তেমনি করেই সবাই জমি-সোম্পত্তি নিয়ে কথা বলতে লাগল। সবকিছুর ভালোটা কত্তার ভাগে দেবার লেগে ভাইদের সি কি ঝুলোঝুলি! একমাত্তর ভাশুর শুদু চুপ করে থাকলে।
বাড়িতে যে যেমন থাকে, ছেলেমেয়ে নিয়ে যে যে-ঘরে থাকে, আগের সেই বেবস্কাই বাহাল রইল। রাঁধা-বাড়ার লেগে যি চালাটো ছিল সিটি বেশ বড়ই। সি-টি আর অ্যাকন ভাগ হলো না শুদু পেয়োজন মতুন আরও কটো চুলো তৈরি করে নেওয়ার কথা বলা হলো। জমি-সোম্পত্তি ল-দ্যাওরের ঠোঁটস্থ, সে-ই মুখে মুখে কোথা কি আছে বলতে লাগল। গরু মোষ ছাগল কুনো হিশেবই তার জানা বাকি নাই। সে বলতে লাগল আর মুখে মুখেই সব ভাগ হতে লাগল। কতক সরেস জমি কত্তাকে দেবার লেগে কে যেন পেস্তাব দিলে, কত্তা আবার একবার ধমকিয়ে উঠল কিন্তুক আমার দাদির দেওয়া জমিটো যা এতদিন এজমালিতে খাওয়া হছিল, সেই জমিটো য্যাকন আবার আমাদের ভাগে দেবার কথা হলো, ত্যাকন কত্ত বেশি আপত্তি করতে পারলে না। জমি তো তার লয়, সে আপত্তি করবে কি করে? জমি আমার। মনে পড়তে লাগল, একদিন এই জমির ধান আলাদা করে। মরাই বেঁধে রেখে ল-দ্যাওর বলেছিল, এ মরাই তোমারই রইল। আমি তাতে রাজি হই নাই। আজ আমাকে রাজি হতে হচে। একবার মনে করলম, যাই, ঐ পুরুষমানুষদের যেয়ে বলি, ই জমি আমার বটে, তবে ই আমি একা নোব না, সবার ভেতরে ভাগ হোক ই জমি। ভাবলম বটে, তবে সি যি কি অসোম্ভাব তাও সাথে সাথে বুঝতে পারলম। সোয়ামির কথা ছাড়া জমি ক্যানে একটি পয়সাও কাউকে দেবার আমার এক্তিয়ার নাই! ল-দ্যাওরের দিকে চেয়ে দেখলম। তার কিছুই মনে নাই, সে হেসে হেসে ই জমি যি আমার, কেনার পর থেকেই আমার সেই কথাটোই বারে বারে বলছে।
সব বিলি-বেবস্থা য্যাকন হয়ে গেল, কত্তা বললে, দলিল সব আমার কাছে, যার যেমন জমি ভাগে পড়েছে সেইরকম সব দলিল আমি পরে সবাইকে বুঝিয়ে দোব। নিজের নিজের দলিল নিজের কাছেই রাখতে হবে।
কথাবার্তা শ্যাষ করে সবাই উঠতে যেছে, এমন সোমায় আমার ননদ ভাইদের কাছে বসে পা ছড়িয়ে মড়াকান্না কাদতে শুরু করলে। সি এমনি কাঁদন যি তাতে একটি কথা নাই, তা শুদুই কাদা, শুনলে পাষাণও ফেটে যায়। অ্যানেকক্ষণ কেঁদে সে এইবার ফেঁপাইতে ফেঁপাইতে বললে, আমার জমি আমাকে দিয়ে তোমরা আমার সব কেড়ে নিলে। জমি নিয়ে আমি কি করব? আমার কবরের লেগেও তো উ জমি লাগবে না। উসব না করে আমাকে বরঞ্চ তোমরা মেরে ফেলল। এই কথা বলে আবার চুল ছিড়তে লাগল ননদ।
কত্তা শুদু বললে, কঁদিস না, তুই একা মানুষ, তোর আবার ভাবনা কি? এখন তোর একার একটি বাড়ি নয়, সব ভাইয়ের বাড়িই তোর বাড়ি।
এই পেথম মনে হলো কত্তা মন-রাখা কথা বললে।
ভাগ-জোগের কথা শ্যাষ হতে হতে সিদিন রাতদোপর পেরিয়ে গেয়েছিল। মাঝে একবার থেমে রাতদোপরের পরে সবাই রেতের খাবার খেয়ে নিলে। সবকিছু গরম করে আমরা বউ-ঝিরা পুরুষদের খাওয়ালম। সব ভাই মিলে মনে হয় এই পেথম আর শ্যাষবারের মতুন একসাথে বসে খেলে। পেথমবার বলছি এইজন্যে যি আমি অন্তত ই সোংসারে আসার পর থেকে পাঁচ ভাইকে একসাথে খেতে দেখি নাই। কত্তা বরাবর নিজের ঘরে আলেদা একা খায়। ভাশুরের সাথে কুনো কুনো ভাইকে কিম্বা ল আর ছোট দ্যাওরকে একসাথে কখনো কখনো খেতে দেখেছি বলে মনে পড়ে কিন্তুক পাঁচজনাকে একসাথে কখনো দেখি নাই। আর শ্যাষবারের লেগে বলছি, অনুমান যি, আর কি কুনোদিন তাদের একসাথে খেতে দেখতে পাব? সোংসার ভাঙার। লেগে জড়ো হয়েছে বলে বাধ্য হয়ে তারা আজ একসাথে বসে খেচে, সোংসার জোড়া দেবার লেগে নয়।
ঐ রেতেই যেমন যেমন কথা হলো সেইভাবেই সব ভাগ হলো, ঝগড়াঝাটি হলো না, পাড়াপড়শি, গাঁয়ের লোকদের ডাকতে হলো না। তবে সব ঠিকঠাক হতে, আলেদা আলেদা হাঁড়ি হতে দিনকতক সময় গেল। বুকে পাষাণ বেঁধে চুপচাপ নিজের কাজ করতে লাগলম। বাইরে থেকে দেখে কিছু বোঝবার জো নাই, কিছুই বদলাইল না, যে যেমন ছিল তেমনি থাকলে, শুদু ছেলেপুলেগুলি নিজের নিজের মায়ের কাছে খেতে লাগল।
আমি জানি কি সব্বোনাশ ই সোংসারের হয়েছে। মুখে কারুর একটি বাকি নাই। সবাই ঘুরে বেড়াইছে ঠিক যেন মড়া, ধড়ে জান তাই, মুখে হাসি নাই। ছেলেমেয়ের মুখে জ্যোতি নাই, রা-কথা নাই। কি চেল্লাচিল্লি, হাঁকাহাঁকি, মারামারি ছিল ই সোংসারের ছেলেমেয়েদের মদ্যে অ্যাকন–তার কিছু নাই। ননদকে আজ কদিন থেকে দেখতে পাওয়াই যেচে না। নিজের ঘরটিতে–যে ঘরে বড় খোঁকা মরেছিল, গিন্নি মরেছিল–সেই ঘরে আঁদারের মদ্যে দিনরাত বসে আছে। তার বুনপো, আমাদের ছোট ভাগ্নেটি আজ কদিন হলো নিজের বাড়িতে গেয়েছে, আর বোধায় ফিরবে না। বড় হয়েছে, হয় স্কুলপাশ দিয়ে শহরে পড়তে যাবে, নয় নিজের বাড়িতে বাপ-চাচার কাছে ফিরে যাবে। কথা অ্যাকনো হয় নাই, তবে ননদ ঠিক বুঝে গেয়েছে যি পাখি আর বেশি দিন থাকবে না। আমার ছেলেটি কবে থেকে শহরে পড়ছে কলেজে, বাড়ি পেরায় আসেই না। মেয়েটো-ও শহরের মেয়ে-স্কুলে ভত্তি হয়েছে, থাকে তার মামুর কাছে, আমার সেই মায়ের প্যাটের ভাইটির কাছে। তবে খুকি ঘন ঘন বাড়িতে আসে। বাইরের ঘরটিতে আগের মতুনই আমি ছোট ছেলেদুটিকে নিয়ে থাকি। ওখানে একবার ঢুকে গেলে বাড়ির আর কুনোকিছু আমাকে দেখতে হয় না। কত্তা ঠিক আগের মতুন পরচালিতে লোহার চেয়ারে পিঠ লাগিয়ে ঘণ্টার পর ঘন্টা বসে থাকে। কি ভাবে সেই জানে।