তবে এইটি, আমি জানি কত্তা যেদি নিজে থেকে কিছু না বলে, কারুর সাধ্যি নাই যি তাকে যেয়ে বলবে, আর দেরি করা ক্যানে, সোংসার পেথক করে দাও। না, সি সাধ্যি কারুর হবে না। অ্যাকন আবার কত্তাকে দেখে মনে হচে, সে বোধায় এইবারের মতুন নিজের পিতিজ্ঞে ভুলে গেল! আল্লা, তাই যেন হয়। কিন্তুক তাই কি হবে? হঠাৎ একদিন রেতে, কিছুই যেন হয় নাই, এমনি করে কত্তা বললে, ধার করে আনা ধানের চালে সংসার কতদিন চলল, বলতে পারবে?
তা পেরায় চারমাস।
ঠিক করে বলতে হবে। এখনো চাল যা আছে, তাতে কতোদিন চলবে?
কাল বুবুর সাথে যেয়ে দেখেছেলম, দশ-পনেরো দিন যেতে পারে আরও। মাঠের লতুন ধান ভঁচা দেওয়া হয়েছে বুবু বললে। এমন হিশেব করে দেওয়া হয়েছে যি মজুত চাল শেষ হবার আগেই যেন বাড়ির নতুন চাল আসে।
শেষ হবার দু-একদিন আগে আমাকে বোলো।
ইকথা শুনে কত্তা আবার কি করবে? একবার ভাবলম বটে কথাটো নিয়ে, আবার ভুলেও গ্যালম। ই কথা কি কারুর মনে থাকে? কদিন বাদে যেই বলেছি বাড়ির পুরনো চালে আর দিন দুয়েক চলতে পারে, অমনি কত্তা একেবারে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠল।
তোমাকে বলেছিলাম না ঠিক করে জানাবে। দিনকতক, দু-দিন, তিনদিন আবার কি কথা। যাও, দেখে এসে আমাকে জানাও ঠিক কদিন যাবে।
কি করব, দেখে এসে বললম আবার, কাল আর পরশু এই দুদিন যাবে। ভঁচা-বাড়ি থেকে কালকে নতুন চাল দিয়ে যাবে বলেছে।
কি আচ্চয্যি, ঠিক পরের দিনই সাঁঝবেলায় কত্তা উত্তর-দুয়য়ারি ঘরের উসারায় সব ভাইদের ডাকলে। ঘোট দাওর যি শহরে থাকে, তাকেও একদিনের মদ্যে খবর দিয়ে ডেকে আনলে।
সাঁঝবেলায় সারা বাড়ি থমথমে। একটো হেরিকেন জ্বালিয়ে তার চারপাশে ভাইরা সব বসেছে শেতলপাটির ওপর। কত্ত সব শ্যাষে বুনকেও ডেকে নিলে। তাপর আস্তে আস্তে কথা বলতে শুরু করলে। সি কথা শোনা যায় কি যায় না, কান পাতলে তবে শোনা যায়। কিন্তুক পেত্যেকটি কথা পোষ্কার, একবারও থামছে না, একটানা বলে যেছে। ভাইরা ঘাড় নামিয়ে শুনছে। জায়েরা দেখলম নিজের নিজের ঘরের দরজার ছামনে দাঁড়িয়ে কথা শোনার চেষ্টা করছে, নোখ দিয়ে মাটি খুঁড়ছে, আঙুলে কাপড়ের আঁচল জড়াইছে। আমি একটু দূরে দাঁড়িয়ে কত্তার কথা শুনছি। মানুষ কি এমন করে কথা বলতে পারে! গলার আওয়াজে উঁচু-নিচু নাই, কথা হাতড়ানো নাই। এক জেবনের সব বলছে কত্তা। এমন করে বলছে যি মনে হচে কথা শ্যাষ হলে আর একটি কথা যোগও করতে হবে না, বাদও দিতে হবে না। বাপের মিত্যুর কথা থেকে বলতে শুরু করেছে। মা কেমন করে ছেলেপুলেগুলিনকে আগুলে রেখেছে, কেমন করে খাওয়া জুটেছে, মা সারাদিনের পরে ঝিকিমিকি সাঁঝবেলায় দোপরের ভাত খেতে বসেছে, কেমন করে রাত গেল, কেমন করে দিন গেল, মাস গেল, বছর হয়ে গেল।
এইসব কথা বলতে যেয়ে কত্তা মুটেই নিজের কথা সাতকাহন করে বললে না। শুদু ভালোদিন, মদিনের কথা বললে, দুবারের যুদূর কথা বললে, একবার বড় খোঁকার মিত্যুর কথা বললে। কিন্তু তাতে তার গলা কাপল না। মায়ের মিত্যুর কথাও বললে অমনি করে। আকাল মহামারীর কথাও বললে। রাত বাড়ছে, সোমায় গড়িয়ে যেছে কিন্তুক মাঝখানে তাকে থামিয়ে কারুর একটি কথা বলবার জো নাই। ভাইরা বসে আছে আর আমরা বউরা সেই যি দাঁড়িয়ে আছি তো দাঁড়িয়েই আছি।
সব কথা বলা হয়ে যাবার পরে কত্তা ঐ একইরকম গলায় খুব কঠিন কঠিন কথা বলতে লাগল। রাগ করে লয় বটে, তবে সি বড় কঠিন কথা। তার আসল কথাটো হচে, বেপদ মসিবতের সাগর পেরিয়ে আসা হয়েছে, অ্যাকন সবারই নিজের নিজের ছেলেমেয়েদের নিয়ে আলেদা সোংসার চালানোর ক্ষমতাও হয়েছে। নিজের সোংসার ছেলেপুলে নিজেই চালাইতে চায় সবাই, আর মোট একজনা চালাইলে কিংবা সবাই মিলে ঠেলাঠেলি করে চালিয়ে দিলে ভালো লাগে না। কত্তা খুব ভালোমুখে বললে, এক-এক জন এক-এক ভাবে চলতে চায়, এক-এক পথে ছেলেপুলে মানুষ করতে চায়, একান্নবর্তী পরিবারে তা সম্ভব হয় না। সেইজন্যে যুক্তি পরামর্শ করে আলাদা হয়ে যাওয়াই ভালো। সবাই যেটা মনে মনে চাইছে, সেটাই করার জন্যে আজ আমি সবাইকে ডেকেছি।
আমরা তো কেউ সংসার ভাঙতে চাই নাই।
তুই নিজের কথা বল্। আর কেউ কি চেয়েছে না চেয়েছে সে সেই-ই বলবে।
আমি সংসার পৃথক করতে চাই নাই।
আমি দেখলম, সত্যি যে সসাংসার ভাঙতে চায় নাই, আমার ভাশুর–সে এইকথা বললে না, বললে আর একজনা। আমি জানি ছোট দ্যাওর-ও মন থেকে আলেদা হতে চায় নাই, কিন্তুক সিকথা তার বলার সাওস নাই, একদিষ্টে তার দিকে তাকিয়ে আছে ছোটবউ।
এই কথাটি আমি যেন আর একবার কারুর মুখ থেকে না শুনি। মিছে কথা আমি ঘেন্না করি। কে কি ভাবে সেকথা আমি তার নিজের চাইতেও ভালো জানি।
কত্তা আরও কি কি কথা বলতে যেছিল, এই সোমায়, আমার ভাশুর একেবারে কচি শিশুর মতুন হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল। সেই কান্না শুনে কাকে চুপ করতে হলো। ভাশুর ত্যাকন দু-হাতে কপাল চাপড়াইতে চাপড়াইতে মাথার চুল টেনে ছিড়ছে আর মুখে খালি এক কথা, হায় হায়। ই কি হলো, হায় হায় ই কি হলো। ঘাড় পেরায় মাটিতে ঠেকিয়ে ভাইরা। সবাই চুপ করে থাকলে। কত্তাও দেখলম ঘাড় নামিয়ে রয়েছে।
খানিক বাদে ভাশুর থামলে কত্তা আবার ঠিক আগের মতুন গলায় বললে, যুদ্ধ চলছে সারা দুনিয়ায়, এখনো শেষ হয় নাই যুদ্ধ, সেই যুদ্ধ একরকম করে পার হয়ে এইছি। দুর্ভিক্ষ আকাল মারী কিছুই ভেদ করতে পারে নাই এই সংসারের। কতো সংসার ছারখার হয়ে গেল, কতো মানুষ দুনিয়া ছেড়ে গেল, আমাদের কিছু হয় নাই। আর কিছু নয়, বাড়ির ছোটরা যেদিন না খেয়ে উপোস করে দিন কাটালে, আমার মাথায় বাজ পড়ল না, তাদের বাপ-চাচাদের মাথাতেও বাজ পড়ল না। পড়া উচিত ছিল, সংসার ভাঙার জন্যে যে বাপ-চাচারা ছেলেমেয়েদের উপোস করিয়ে অপেক্ষা করতে পারে তাদের মরাই ভালো। সেইদিনই আমি ঠিক করেছি, সকলের মনোবাঞ্ছা আমি পূরণ করব। মানুষ না হয়ে স্ত্রৈণ হয়েছে যে পুরুষমানুষ তার আর এক সংসারে থাকার কোনো দরকার নাই।