দিলে ধান?
দিলে বৈ কি। আমি জানি চাইলেই দেবে। এমনি এমনি তো নোব–মাঘ মাসের মধ্যে দেড়গুণ ধান ফেরত দিয়ে শোধ দোব।
এই ধানে ই কমাস আমাদের খুব চলে যাবে, খুব খুশি হয়ে আমি বললম, মাঠেলিকিন এবার ধান খুব, খামারে মরাইয়ের জায়গা হবে না।
তা হবে, সে হলে তো ভালোই।
কত্তার কথা শুনে আমি তার মুখের দিকে তাকাই। আসলে ভয় ভয় করছিল বলেই খুশি হবার ভাব দেখাইছেলম। কত্তা কি তার সেই পিতিজ্ঞা ভোলে নাই। না, ভোলে নাই, কত্তার মুখ দেখেই বোঝলম যে ভোলে নাই। ই সোংসার সে আর এক-ভাতে রাখবে না। শাশুড়ি নাই, কত্তাকে জোরের সাথে কথা বলার অ্যাকন আর কেউ নাই। এক উপায়, সব কটি ভাই যেদি তাদের বুনকে সাথে নিয়ে কত্তার কাছে এসে তাকে ধরে। কিন্তুক তাতেও দেরি হয়ে যেচে, উ মানুষের এমনি জেদ যি য্যাতো দিন যায় জেদ তার ত্যাতো বাড়ে আর ভেতরে যি রস-কষ আছে, সব শুকিয়ে যায়। তবে ইসব কথা ভেবে লাভ কি? কেউ তো এল না তার কাছে। আমি বেশ বুঝতে পারছি, মাঠের ধানের দিকে চেয়ে সবাই নিজের নিজের হিশেব করছে। আমি যেমন ভাবছি, তেমন হিশেব সবাই না-ও করতে পারে কিন্তুক সোংসারে অ্যাকন শান্তি আর নাই। সবারই ভেতরে একটো রাগ তুষের আগুনের মতুন ধিকি ধিকি জ্বলছে আর জায়ে জায়ে যি আখেজ দেখছি তাতে রেষারেষির, কুনো ঢাকাচাপা নাই, সব সোমায় পেকাশ পেয়ে যেচে। দেখেশুনে ননদ আর কি করবে, মুখ শুকিয়ে ঘুরে বেড়াইছে। শুদু একটি ভয় তার জানটোকে কুরে কুরে খেচে। বড় ভাগ্নেটি অ্যাকন আর ইখানে থাকে না, শহরে চাকরি করে। সে ঘরের ছেলে ঘরেই ফিরে গেয়েছে বলা যায়। ছোটটি অ্যাকনো ইখানে আছে, কিন্তুক ডামাডোলে সোংসার ভাঙলে সে কি আর ইখানে থাকবে, না তার বাপ চাচা তাকে ইখানে থাকতে দেবে? ত্যাকন বাঁচবে কি করে ননদ?
কত্তা আজকাল শহরে কমই যেছে। কথা খুব কম বলছে। সারাদিন বাড়িতেই থাকে, গাঁয়েও কারুর বাড়ি পেরায় যায় না। কত্তামার বাড়ি যাওয়াও কমতে কমতে আকন পেরায় বন্ধই হয়ে গেয়েছে। গাঁয়ের সেই আবস্তা তো আর নাই। মহামারী যুদ্ধ আর আকাল এসে সব লয়ছয় করে দিয়েছে। ঘরে ঘরে মানুষ উপোস করেছে, অ্যাকননা করছে। রোগে, শোকে-তাপে, না খেয়ে কতো চেনা লোক যি দুনিয়ার মায়া কাটিয়ে চলে গেয়েছে, তার সুমার নাই। কত্তামা, যি কিনা রাজার ভাগ্নি, তাদের না খেয়ে হয়তো থাকতে হয় নাই, তবে যুছু আর আকালের হাওয়া সি সংসারেও যেয়ে লেগেছে। ইসব নিজের চোখে দেখতে হবে বলে কত্তা যি কোথাও যায় না, তা আমি জানি। খামারের দিকে পরচালিতে একটো লোহার চেয়ারে সারাদিন সে বসে থাকে, কথা বলতে গেলেই কেমন খেকিয়ে ওঠে। সকাল দোপর রেতে দুটি খেয়ে আবার ঐ পরচালির চেয়ারে।
ভেতরে-বাইরে লক্ষ্মী ছেড়েছে। তিন-তিনবার গরু-মোষের কি একটো রোগ এল, ঝেটিয়ে গোয়াল খালি হয়ে গেল। চোখের ছামনে বড় বড় হেলে গরু, দুধেল তিনটো গাই, দু-জোড়া হাতির মতুন বড় বড় মোষ দেখতে দেখতে ছটফট করে মরে গেল। এমন দিন ত্যাকন এয়েছিল যি মনে হয়েছিল গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি, মানুষজন কিছুই থাকবে না। অ্যাকন দেখছি কিছু কিছু টিকলে বটে, তবে সব যেন কেমন আড়া-আড়া ছাড়া-ছাড়া। শনি ঢুকেছে গেরস্থালিতে–সবাই যেন ডোকলা, সবাই যেন হাঘরে।
বাড়ির ভেতরে জায়েরা কিসের লেগে যি ইসব করছে কে জানে! এই টানছে, এই ছিড়ছে, মাটির ভাতের হাঁড়ি এমন করে চুলো থেকে নামাইছে, তাতে যি ভাঙছে না এই বড় ভাগ্যি। ঝন ঝন করে কাঁসার থালা ফেলছে, পেতলের ডেকচি, পানির ঘড়া দুম করে নামাইছে মেঝের ওপর, কাঁসার গেলাস ঠন ঠন করে গড়িয়ে পড়ছে উসারা থেকে এগনেয়। শাড়ি শায়াটো এমন করে টান দিচে যি কাপড় শুকনোর তারে লেগে ফাঁস করে ছিড়ে যেচে। কিন্তুক এত যে গামুস-গুমুস করছে, মুখে কুনো কথা নাই। বাড়ির ভেতরে বোদ-বাদারি ময়লা আবজ্জনা, ঘরে ঝটপাট নাই, লেপামোছা নাই, সব জায়গায় চিমসে গন্ধ। ননদ-ও হাল ছেড়ে দিয়েছে, কে কখন আসছে, কখন
যেচে, সি হিশেব সে আর রাখতে পারছে না।
বাইরে গোয়াল তিনটো পেরায় খালি। দলিজ ঘর খাঁ খাঁ করছে। কবে থেকে মানুষের আসা-যাওয়া নাই, খামার জুড়ে একহাঁটু ঘাস আর কন্টিকারির জঙ্গল। এইসব ছামনে নিয়ে কত্তা বসে থাকে, সে-ও যেন সব্বোনাশটোর লেগে অপিক্ষে করছে।
ইদিকে সারা গাঁয়ের মানুষ মাঠের দিকে তাকিয়ে আছে। য্যাতো দূরেই হোক পোষ মাস, তাকে তো শ্যাষ পয্যন্ত আসতেই হবে। ধান পাকছে, সোনার মতো রঙ ধরছে ধানে, কঁচা সোনার রঙ এট্টু এট্টু করে ধানের গায়ে লাগছে। সারা মাঠ ভরা, দু-বছর বাদে কি ধানই না এবার হয়েছে! ঘরে বসে ভাবনা করতে করতেই গরম ভাত মনে মনে খাওয়া হয়ে যেচে। সেই আসবে, তাইলে এতকাল কোথা ছিল পোষ মাস!
অন্য অন্য বার কতো কথা বলে দ্যাওর-রা। ইবার সব মুখে কুলুপ এঁটে মাঠের কাজে নেমেছে। একটি কথা বলে না কেউ। ধান কাটা শুরু হয়ে গেয়েছে, আঁটি বাঁধা, টিপ দেওয়ার কাজও চলছে। তাপর একদিন শুরু হয়ে গেল ধান বওয়ার কাজ। দুটো মোষের গাড়ি ভোর থেকে সারাদিন ধান আনছে। মুনিষরা সারাদিন ধান পিটোইছে। আমি একবার একবার যেয়ে দেখি, ধান গাদা হচে, পিটনোর পাটার গায়ে ঠিক গাদা করা সোনার নোলক। ঐ থেকেই ধোঁয়া ওঠা কুঁদফুলের মতুন শাদা ভাত হবে। সেই ভাত থালায় থালায় ভরে ছেলেপুলেদের সামনে ধরে দেবে ননদ। ভাবনা এই পয্যন্ত যেই এল অমনি বুকের ভেতরটো কে যেন খামচে ধরলে। ছেলেপুলে কোথা পাব? সব তো আলো আলেদা ঘরে নিজের নিজের মায়ের হাতে খাবে।