পেত্যেক দিন রাঁধার সোমায় ননদের সাথে আমি য্যাতম ভাতের চাল আনতে। ঘরের কোণের ঐ বেরাট পয়ার ভেতরে আঁদার দিন-দিন ঘোনো হচে। তার হাতের চাল তোলার টিনের কটোটো খরাৎ খরাৎ করে পয়ার গায়ে লাগে, অ্যানেকটো ঝুঁকেও ননদ পয়ার তলার চাল কটোর নাগাল পায় না। শ্যাষকালে সে মাথা ঢুকিয়ে দিলে পয়ার ভেতরের আঁদারের মদ্যে। স্যারদুয়েক চাল বার করে ঘরের বাইরে এসে দোপরের রোদে এগনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে কেঁদে বললে, আর একটি দানাও নাই। বাছারা আজ রেতে আর কেউ খেতে পাবে না।
কথাটা শুনেই মনে হলো দিনের আলো কেমন মিইয়ে এল, শন শন করে ঠান্ডা হাওয়া বইতে লাগল, আর বুকের ভেতরটা খামচে খামচে উঠতে শুরু হলো।
দোপর বেলায় ছেলেরা সব খেতে বসেছে। খাবার তেমন কিছু নাই। পাতলা ডাল আর ভাত। আগের দিনের মতুনই সব মারামারি হুড়োহুড়ি করছে। খালি বড়গুনোর মন ভার। তারা বোধায় কিছু জানতে পেরেছে। অন্য দিন ননদ রাগারাগি-বকাবকি কতো কি করে। আজ সে একদম চুপ। তাকিয়ে দেখলম, চোখ দিয়ে তার টস-টস করে পানি পড়ছে। ফোলা ফোলা টকটকে লাল মুখ বারে বারে একদিকে পাশ করে পানি মুচছে।
বৈকাল গেল, সারা বাড়িতে কারুর দেখা নাই। দেখলম সুয্যি উঠল, দেখলম সাঁঝ নামল, দেখলম আঁদার ঘোনো হলো। আর একটু বাদে ঝিঁঝি পোকা ডাকতে লাগল। অন্যদিন জোনাকি দেখতে পাই না। বাড়িতে লম্ফ-হেরিকেন জ্বলে, জোনাকি পোকা কে খেয়াল করে; আজ বাড়িতে কোথাও আলো নাই, বাড়িময় আঁদারে জোনাকি ঘুরে বেড়াইছে।
চুলো জ্বলে নাই। ভাত হয় নাই। কেমন করে ছেলেমেয়েগুলিন। বুঝে গেল আজ বাড়িতে রাঁধাবাড়া হয় নাই। রেতে তারা কেউ খেতে পাবে না। তাইলে কি বাপ-মা-ই তাদের শিখিয়ে দিয়েছে যি আজ আর হেঁশেলে খেতে যাস না? আমার কিছুতেই বিশ্বেস হচে না!
সময় যেতে লাগল তবু কেউ কাছে এল না। ননদকেও দেখতে প্যালম না। শ্যাষে বসে থেকে থেকে রাত পেরায় নিশুতি হলে আমি ঐ আঁদারের মদ্যেই গা-মাথা ঢেকে চোরের মতুন পা টিপে টিপে শোবার ঘরে যেয়ে ঢোকলম। ঘর আঁদারই বটে, তবে কত্তার একটা বিদেশী লম্ফ ছিল, সেটায় একবার ত্যাল দিয়ে খুব কম করে জ্বালাইলে তিন-চার মাস জ্বলত। বহুদিন বাদে সেটিকে ঝেড়ে-ঝুড়ে বার করা হয়েছিল। দেখলম, আঁদার ঘরে খালি একটো নীল ফোটা। বোঝলম কত্তা সেইখানেই বসে আছে। আন্দাজে সিদিকে খানিকটো যেয়ে আর যেতে পারলম না। উবুড় হয়ে পড়ে আমি মাটিতে মাথা ঠুকতে লাগলম। ঠান্ডা শক্ত মেঝে, বারকতক ঠুকতেই বুঝতে পারলাম কপাল ফেটে রক্ত ঝরছে। কেমন নেশার মতুন হলো, হাত দিয়ে রক্ত মুছি আর তেমনি করেই মাথা ঠুকি। মুখে খালি আমার একটো কথা : বাড়ির ছেলেমেয়েরা আজ না খেয়ে ঘুমুইতে গেয়েছে। ভোখ প্যাটে সারারাত তারা ছটফট করবে। তুমি কিসের কত্তা, আঁদার ঘরে বসে আছ? কারা দুনিয়ায় এনেছে তাদের? বলো, বলতে হবে তোমাকে। এইসব কথা বলতে বলতেই দেখি, ঘরের আঁদার অ্যানেকটো কমে এয়েছে, আমার খোঁকাদুটি বিছেনায় উঠে বসেছে আর পাথরের মতুন বসে আছে কত্তা।
নীল আলোর ফোঁটাটো টুপ করে নিভে গেল। বোধায় ত্যালের শেষ ফোটাটোও ফুরিয়ে গেয়েছে। আর বেশিক্ষণ গেল না, কত্তা আমার দিকে মুখ না ফিরিয়ে আস্তে আস্তে বললে, আর মাথা ঠুকো না। আমি আজকের এই দিনটির অপেক্ষাতেই বসে ছিলাম। দেখছিলাম, কেউ আসে কি না। ভাই আর ভাই আছে কি না। বউদের আমি গেরাহ্যি করি না। দেখছিলাম ভাইদের কেউ বলে কি না যে চিরকাল তুমিই সব করে এসেছ, এখন এই সংকটে তোমাকেই হাল ধরতে হবে। না, কেউ এল না। তা যাই হোক, ছেলেপুলে একদিন না-ই খাক, শুকিয়ে মরতে তাদের আমি দোব না। কাল আমি যাব। সন্ধের আগেই এক গাড়ি ধান যেখান থেকে পারি আনব। তবে ঐ ধান শেষ হবার আগে সবারই সংসার আমি পৃথক করে দেব এই আমার প্রতিজ্ঞা। যাও, আর মাথা খুঁড়ো না।
আমি আর বিছেনায় গ্যালম না। সেইখানেই আঁচল বিছিয়ে শুয়ে পড়লম। বিছেনার চেয়ে মাটি ভালো।
২৬. ভাই ভাই, ঠাঁই ঠাঁই, সবাই পেথগন্ন হলো
সত্যিই, কত্তা পরের দিনই গেল আর সাঁঝলাগার আগেই গরুর গাড়িতে এক গাড়ি ধান নিয়ে ফিরে এল। এ এমন মানুষ যি জানে, ঘরে এখুনি খাবার নাই, শুদু ধান নিয়ে গেলেই হবে না, ধান তো আর খাওয়া যায় না, চালের দরকার সেই লেগে ধানের সাথে এক বস্তা চালও আনলে।
সাঁঝবেলায় গাড়ি য্যাখন বাড়ির ছামনে এসে দাঁড়াইলে, আমার ননদ ভাইকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল আর বারে বারে বলতে লাগল, বাছারা সব না খেয়ে আছে গো, এই কথা কাকে বলি? মানুষ নাই, এই সাংসারে মানুষ নাই! অ্যাকনো এই ভাইকেই হাতে ধরে খাওয়াইতে হবে সবাইকে।
ভাইকে জড়িয়ে ধরে এত কথা সে বলতে লাগলে বটে, ভাই কিন্তুক চুপ। আমি দেখলম কত্তা বুনকে একটো সান্ত্বনা দিলে না, পাথরের মতুন দাঁড়িয়ে থাকলে। তাই দেখে আমার নতুন করে ভয় লাগতে লাগল। বাড়ির ভেতরে যেয়ে দেখি, ভাইয়েরা সব যেমনকার তেমনি ঘোরাফেরা করছে, কারুর কুনো তাপ-উত্তাপ নাই, যেন কিছুই হয় নাই। ছেলেপুলেরা যি দু-দিন খায় নাই, তার সব দায় যেন একা কত্তার। বোধায় সবারই একটি হিশেব, মাঠ জুড়ে ইবার খুব ধান, কুনো পেরকারে তিন-চার মাস কাটাইতে পারলেই আর ভাবনা নাই। ত্যাকন আর অভাব হবে না।
ধান সব সাথে সাথে গাঁয়ের সেই বেধবা বুনদের বাড়িতে ভাঁচা দেওয়া হলো। কাঠ-কুটো জ্বালটও কিছু জোগাড় করে দেওয়া হলো তাদের। আর ভাবনা নাই, কদিন বাদেই আগন মাস পয্যন্ত খাবার মতুন চাল থাকবে বাড়িতে। রেতে কত্তা বললে, অনেক হীন হয়ে এই ধান আনতে হয়েছে আমাকে। কাছের কোনো গাঁয়ে যাই নাই। আমি, চেনা মানুষের কাছেই গিয়েছিলাম, তবে দূরের এক গাঁয়ে।